ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২
প্রকাশিত: ০৫:৩১ পিএম, ১৫ অক্টোবর ২০২০ বৃহস্পতিবার আপডেট: ০৭:০৬ পিএম, ২২ অক্টোবর ২০২০ বৃহস্পতিবার
শঙ্কিত পদযাত্রা
ধারাবাহিক আত্মকথা
। খ. ম. হারূন ।
খ্যাতিমান টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব খ ম হারূন। দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে সম্পৃক্ত রয়েছেন দেশের টেলিভিশন এবং মঞ্চের সাথে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্বর্ণময় সময়ে যে কয়েকজন নির্মাতা-প্রযোজকের নাম ছোট পর্দার কল্যাণে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে
খ ম হারূন তাদের একজন। দীর্ঘ বর্ণিল ক্যারিয়ারে অসংখ্য উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন তিনি।
এখনো রয়েছেন সমান সক্রিয়।
দেশের গণমাধ্যম জগতের বরেণ্য এই ব্যক্তিত্বের আত্মকথা ‘শংকিত পদযাত্রা’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে অপরাজেয় বাংলা’য়।
[পর্ব-২]
সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক নাট্য আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতেন ম হামিদ। তিনি ছিলেন আমার দু বছরের সিনিয়র। নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী, আল-মনসুর, সেলিম আল-দীন এরা সবাই ছিলেন আমার সিনিয়র। আল-মনসুর ছিলেন অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ-এর ছোট ভাই। দারুন প্রতিভাবান। নাটক রচনা, নির্দেশনা, অভিনয়, সঙ্গীত, মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনা- সব বিষয়ে সেই ছাত্রাবস্থাতেই সে ছিলো বিশেষ দক্ষ। তাকে আমারা সবাই ঈর্ষা করতাম। আল-মনসুর আমার সিনিয়র ছিলেন কিন্তু অজানা কারণে নিয়মিত পরীক্ষাগুলি দিতেন না। ফলে দীর্ঘদিন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। নাট্যচক্রে তার লেখা প্রথম নাটক রেভ্যুলিশন এবং খৃষ্টাব্দ সন্ধান যার নির্দেশকও তিনি। সেই নাটকে তিনি হঠাৎ করেই আমাকে নির্বাচিত করেছিলেন নাটকের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করার জন্য। আসাদুজ্জামান নূর তখন সংস্কৃতি সংসদ-এর সভাপতি। চিত্রালীতে লিখতেন। একদিন দেখি রেভ্যুলিশন এবং খৃষ্টাব্দ সন্ধান-এর উপর তার লেখা একটি দীর্ঘ সমালোচনা। নাটকের পাশাপাশি আমার অভিনয়েরও তিনি উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন।
আমি আসলে অভিনেতা হতে চাইনি। তবে আল মনসুরের নাটকে অভিনয় করার কারণে আমাকে পরবর্তীতে সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকীর প্রথম নাটক ‘অস্থির সুস্থিতি’ (প্রথম মঞ্চায়ন ২৮ নভেম্বর ১৯৭২), রোকেয়া হলের আখতার কমল রচিত রংহীন সিগনাল (প্রথম মঞ্চায়ন ১১ ডিসেম্বর ১৯৭২) নাটকে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করতে হয়। এর মাঝে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শক্তিশালী অভিনেতার আগমন ঘটতে থাকে। যার মাঝে রাইসুল ইসলাম আসাদ, পীযুষ বন্দোপাধ্যায়, অনুতোষ সাহা, দুলাল ভৌমিক, বাসন্তী গোমেজ, কামালউদ্দিন নীলু, নরেশ ভূঁইয়া, বাবুল রশিদী, খায়রুল আলম সবুজ, রেজাউল একরাম রাজু অন্যতম। ফলে আমার জন্য অভিনয় থেকে নির্দেশনায় মনোযোগী হওয়া সহজ হয়ে যায়।
নাট্যচক্রের সদস্য হওয়া মানে নিয়মিত প্রশিক্ষন ও নাট্যচর্চা। তিন বছর পর দিল্লি থেকে ফিরে এসে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নাট্যচর্চা। এরমধ্যে ম হামিদ ১৯৭৭ সালে নাট্যশিক্ষাঙ্গন নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালু করেছেন টিএসসিতে। অনেক ছাত্রছাত্রী সেখানে। ম হামিদ আমাকে এই প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষকের দায়িত্ব প্রদান করেন। সেই সাথে রাজা রাজা খেল্ নাটকের নির্দেশনার দায়িত্ব (প্রথম মঞ্চায়ন ২০ জানুয়ারী ১৯৮০)। নীলকণ্ঠ সেনগুপ্তের এ নাটকটি দারুণ দর্শকপ্রিয়তা লাভ করে, যা দীর্ঘদিন মহিলা সমিতি মঞ্চে প্রদর্শিত হয়েছে। নাটকটির মূল বিষয় ছিলো সমাজের অস্থিরতা। রাজা যায়, রাজা আসে - কিন্তু সাধারণ মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটে না। প্রতিটি শো‘র আগে ঐ নাটকে প্রতিটি চরিত্রের মেকআপ আমি নিজ হাতে প্রয়োগ করতাম। আস্তে আস্তে অভিনেতারা নিজ নিজ মেকআপ নেয়া রপ্ত করে ফেলেন।
নাট্যশিক্ষাঙ্গন-এর পাশাপাশি আমি পারফরমিং আর্টস একাডেমিতেও নাট্য প্রশিক্ষক হিসেবে যোগদান করি। আমার সাথে সেখানে এনএসডি‘র আরেক প্রতিভাবান তরুন প্রশিক্ষক ছিলেন । জামিল আহমেদ। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও সঙ্গীত বিভাগের অধ্যাপক ড. জামিল আহমেদ। পারফরমিং আর্টস একাডেমীর নির্বাহী পরিচালক ছিলেন মুস্তাফা মনোয়ার। পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে তাকে বিটিভি থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার পরে জাতীয় গণমাধ্যম ইনষ্টিটিউট, চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একডেমীর মহাপরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। বিটিভিতে একবার স্বল্প সময়ের জন্য ফিরেও এসেছিলেন। কিন্তু বেশি দিন থাকতে পারেননি।
দিল্লি থেকে ফিরে আসার পর নাট্যশিক্ষাঙ্গন, পারফরমিং আর্টস একাডেমী’র বাইরে আমার একটি চাকুরি জুটে যায়। ইউনিসেফ-এর একটি প্রকল্পে আমি কাজ শুরু করি।কাজটি আমার কাছে ছিলো দারুন। আমি মূলত: বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ও মিউজিয়াম থেকে ফোক মোটিভ সংগ্রহ করতাম। এরপর সেই মোটিভের আধুনিক ডিজাইন করতে হতো। যেসব ডিজাইন কারিকা, আড়ং এই সব প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করতো। ইউনিসেফ-এর ঐ কাজে আমার উর্ধতন সহকর্মী ছিলেন মাইক কার্নিয়েক। পোলিশ বংশোদ্ভূত একজন আমেরিকান। এনএসডি হতে নাটকের জন্য যে কসটিউম ডিজাইন শিখে এসেছিলাম, এখানে এসে তা পোশাক-এর নতুন নতুন ডিজাইনে ছড়িয়ে দিয়েছিলাম।
১৯৮০ সালে হঠাৎ করেই আমার চাকুরীটা হয়ে যায় বিটিভিতে। ম হামিদ, নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু দুজনই ১৯৭৩ সালে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে চাকুরী পেয়ে যান। কিন্তু সে চাকুরীতে তারা যোগদান না করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা ও একই সাথে নাটচর্চা চালিয়ে যান। ১৯৮০ সালের মার্চে তারা বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রযোজক পদে যোগদান করেন। আমি যোগ দেই ঐ বছরের ১৭ জুলাই।
জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে আমি আমার মোটর সাইকেল নিয়ে পুরোনা ঢাকায় গিয়েছিলাম একজন ফোক মোটিভ সংগ্রাহক-এর সাথে কথা বলতে। ফেরার পথে বাংলাদেশ ব্যাংকে ঢুকে পড়ি। সেখানে আমার দু’বন্ধু কর্মরত ছিলেন। নজরুল হুদা লাডলা এবং মুরশীদ কুলী খান। মুরশীদ আমার অত্যন্ত প্রিয় বন্ধু। একসাথে পিরোজপুর কলেজে পড়েছি ১৯৬৮ থেকে ৭০ পর্যন্ত। তারপর এক সাথে ঢাকা এসেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে। সে ভর্তি হয় অর্থনীতিতে আর আমি দর্শনে। সূর্যসেন হলে ১৯৭৬ পর্যন্ত আমরা পাশাপাশি রুমেই ছিলাম। মুরশীদ ও লাডলা থাকতো ৪৩৪ নম্বর কক্ষে আর আমি ৪৩৩ নম্বরে। মুরশীদের সাথে আমার যোগাযোগ সবসময়ই ছিলো। যখন আমি দিল্লি চলে যাই, তখন সে আর লাডলা বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগদান করে। দু‘জনই বাংলাদেশ ব্যাংকে ডেপুটি গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ঐ দিন মুরশীদ আমাকে একটি পত্রিকা দেখায়। বিটিভিতে প্রডিউসার নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি। সে জিজ্ঞাসা করে আমি আবেদন করেছি কিনা। আসলে আমি ঐ বিজ্ঞপ্তি খেয়ালই করিনি। আবেদন করার শেষ তারিখ আছে আর মাত্র একদিন।
দেরি না করে সাথে সাথেই আমি সেগুন বাগিচার শিল্পকলা একাডেমীতে চলে আসি। লাইব্রেরীতে বসে আমার আবেদনপত্র প্রস্তুত করি। শিল্পকলা একাডেমীর সে সময়ের উপ-পরিচালক এস এম মহসীন-এর রুম থেকে বিটিভিতে কথা বলি ম হামিদ-এর সাথে। তিনি প্রবেশপত্রের ব্যবস্থা করে দেন। আমি হাতে হাতে আমার আবেদনপত্রটি বিটিভি’র প্রশাসন বিভাগে জমা দিয়ে আসি।
আবেদনপত্র জমা দিলেও বিটিভি’র চাকুরীতে যোগ দেবার কোনো ইচ্ছে আমার ছিলো না। যদিও বিটিভি’র প্রযোজকের পদটি একজন প্রথম শ্রেনীর সরকারী কর্মকর্তার পদ - তবুও বেতন স্কেল ভালো ছিল না। আমি তখন ইউনিসেফ-এর যে চাকুরী করি তার তুলনায় বেতন মাত্র চার ভাগের এক ভাগ।
জুন ১৯৮০। কয়েকমাস আগে নতুন বাসা নিয়েছি সিদ্বেশ্বরী লেনে। বাসার নাম তরুতল। তিনতলায় এক রুমের বাসা। আলাদা রান্নাঘর, দুটি বাথরুম এবং খোলা ছাদ। দু‘জন মানুষের জন্য চমৎকার। আমার স্ত্রী তখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। একদিন বিকেলে অফিসের কাজ শেষে বাসায় ফিরে দেখি বাংলাদেশ টেলিভিশনের পত্রবাহক আজাদ আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি একটা চিঠি নিয়ে এসেছেন। চিঠিটা ছিলো একটি ইন্টারভ্যু লেটার। পরদিন বিটিভি’র রামপুরা কার্যালয়ে ইন্টারভ্যু। জিজ্ঞাসা করলাম আমি তো ডাকে কোনো চিঠি পাইনি। সবার কাছে কি আপনি হাতে হাতে চিঠি পৌঁছে দিয়েছেন। তিনি বললেন, সবার চিঠিই ডাকে গেছে। তবে বিটিভি’র মহাপরিচালক কয়েকজনের চিঠি হাতে হাতে পৌছে দিতে বলেছেন, তার মধ্যে আপনিও আছেন। আজও ইন্টারভ্যু হচ্ছে। আগামীকাল শেষদিন।
পরদিন নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছে গেলাম রামপুরাতে। অনেকে এসেছেন। টিভি ভবনের তিনতলার সভাকক্ষে ইন্টারভ্যু চলছে। আমার ডাক পড়লো। রুমে ঢুকলাম। বোর্ডের কাউকে চিনি না। তবে পরবর্তী সময়ে তারা সবাই আমার শ্রদ্ধাভাজন ও ঘনিষ্ঠ হয়েছেন। বোর্ডের প্রধান ছিলেন মহাপরিচালক এম এ সাঈদ (পরবর্তী সময়ে যিনি বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার হয়েছিলেন) অন্যদের মধ্যে ছিলেন অনুষ্ঠান পরিচালক খালেদা ফাহমী, জেনারেল ম্যানেজার মোস্তফা কামাল সৈয়দ। আরো ছিলেন তথ্য মন্ত্রনালয় ও পিএসসি’র সদস্যবৃন্দ।
ইন্টারভ্যুতো ভালো হলো। তবে কবে নাগাদ চাকুরী হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারন ম হামিদ সহ অন্যরা তাদের ইন্টাভ্যু’র প্রায় তিন বছর পর চাকুরীর নিয়োগপত্র পেয়েছিলেন। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে সময় লাগলো মাত্র তিন সপ্তাহ। ১৯৮০ সালের ১৬ জুলাই বিটিভি’র সেই পত্র বাহক আজাদ তথ্য মন্ত্রনালয় হতে আমার চাকুরীর নিয়োগপত্র হাতে হাতে আমার বাসায় পৌছে দেন। আমার স্ত্রীর মন খারাপ। বিটিভিতে যোগদান করলে সংসার চলবে কিভাবে! বন্ধু জামিল আহমেদও মন খারাপ করলো। সে বললো, বিটিভিতে যাওয়া আপনার জন্য ঠিক হবে না। ম হামিদের মাঝেও দ্বন্দ। তার ধারনা বিটিভিতে যোগদান না করে ইউনিসেফ-এ থাকলেই আমি ভালো করবো। সেই সন্ধ্যায় ছুটে গেলাম মুস্তাফা মনোয়ারের বাসায়। তিনি বললেন কালই যোগদান করবে। সব দ্বিধা সংকোচ দুর করে ফেলো।
মুস্তাফা মনোয়ারের কথা মতো পরদিন সকালে চলে গেলাম ইউনিসেফ থেকে পাওয়া আমার মটর সাইকেলটি নিয়ে শেরে বাংলা নগর। সিভিল সার্জনের কাছ থেকে মেডিকেল সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে, চাকুরীর যোগদানপত্র টাইপ করে, আনুষাঙ্গীক কাগজপত্র রেডি করে ছুটে চলেছি রামপুরার দিকে। বাংলামটর ক্রসিং এর কিছুটা আগে একটি বাস কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার পাশ দিয়ে এমনভাবে সামনে এগিয়ে গেল যে আমার চোখে আঁধার নেমে এলো। মটর সাইকেল নিয়ে আমি উঠে গেলাম রাস্তার মাঝে উঁচু ডিভাইডারের উপর।
আমার প্যান্ট ও শার্ট ছিড়ে গেছে। হাত পা দিয়ে রক্ত ঝরছে। মটর সাইকেলের সামনের চাকা বাঁকা হয়ে গেছে। তবে কাগজপত্র সব ঠিক আছে । বাংলা মটরের আগে একটি গ্যারেজ থেকে সাইকেলের চাকা ঠিক করে রামপুরা না গিয়ে চলে এলাম সিদ্বেশরী বাসাতে। বাথরুমে ঢুকে পোশাক বদল করলাম। ক্ষতস্থানে এন্টিসেপটিক লাগালাম। তারপর নীচে নেমে মটর সাইকেল নিয়ে ছুটে গেলাম রামপুরা।
[চলবে]
আগের পর্ব পড়ুন: