এক দশকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জয়যাত্রা
শেখ আনোয়ার
প্রকাশিত: ১১:৪৫ এএম, ২৬ জুলাই ২০২১ সোমবার আপডেট: ১২:৫৫ পিএম, ২৬ জুলাই ২০২১ সোমবার
একবিংশ শতাব্দিতে উন্নয়নের ধারণাগুলো এখন আর কেবল অবকাঠামো আর সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিতে আটকে নেই। বরং ইতিবাচক পরিবর্তনগুলোকে আরও টেকসই তথা ‘সাসটেইনেবল’ করার প্রশ্নটিই এখন প্রধান ভাবনার জায়গায় চলে এসেছে। আর এই টেকসই উন্নয়নে রাষ্ট্রের পরিপূরক হিসেবে ব্যক্তি খাত ও অ-সরকারি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাও এখন আগের চেয়ে বেশি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে। এ কারণে উন্নয়ন প্রক্রিয়ার প্রধানতম চালিকা শক্তি হিসেবে ব্যাংকিং সেক্টর বা আর্থিক সেবা খাত সামনে চলে এসেছে। আর্থিক সেবা খাতের নিয়ন্ত্রক হিসেবে এক্ষেত্রে মূখ্য ভ‚মিকা পালন করার দায়িত্ব প্রতিটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপরই বর্তায়। ফলে আগের প্রচলিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকিংয়ের ধারণার জায়গায় চলে এসেছে উন্নয়নমুখী কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং তথা ‘ডেভেলপমেন্টাল সেন্ট্রাল ব্যাংকিং’।
সকলের জন্য সমতার ভিত্তিতে উন্নয়নের সুফল নিশ্চিত করতে আর্থিক সেবা খাতের কার্যকর ভূমিকার কথা আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশি বেশি করে বলছেন। ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অর্থনীতিবিদ ক্রিস্টিন ল্যাগার্ড এ প্রসঙ্গে বলেছেন- “আর্থিক খাতকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে যাতে এর গতিপথের সঙ্গে বৃহত্তর সামাজিক মূল্যবোধের একটি সাজুয্য রক্ষা করা যায়। এর মাধ্যমে যেনো গ্রাহক, কর্মী, শেয়ারহোল্ডার, স্থানীয় মানুষ থেকে শুরু করে আগামী প্রজন্ম পর্যন্ত সকল অংশীজনের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়।” আজ ২০২১ সালে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের এসব কথার প্রাসঙ্গিকতা টের পাওয়া সহজ। এ সুযোগে স্মরণ করা যেতে পারে, বাংলাদেশে কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব বিষয় নিয়ে উদ্যোগী হয়েছিলো এক দশকেরও বেশি সময় আগে, সেই ২০০৯-১০ থেকেই। তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে যথাযথভাবেই ব্যাপকভিত্তিক আর্থিক অন্তর্ভুক্তির উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো। মূল লক্ষ্য ছিলো ‘রিয়েল ইকোনমি’তে অর্থায়ন। ফলে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছিলো কৃষি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশে। একই ধারায় তরুণ প্রজন্ম ও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ সরবরাহ বাড়াতে নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো। ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক সেবাদানকারীদের সবুজ অর্থায়নে উৎসাহিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই এক্ষেত্রে উদাহরণ তৈরি করে গেছে একের পর এক। আর দ্রুত এবং কম খরচে নির্ভরযোগ্য আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিতকরণের জন্য ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার উৎসাহিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের দিন বদলের শুরু ২০০৯ সাল থেকে। ‘দিন বদলের সনদ’ শিরোনামে নির্বাচনী ইশতেহারে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটি উন্নত দেশ, সমৃদ্ধ ডিজিটাল সমাজ, একটি ডিজিটাল যুগের জনগোষ্ঠীর রূপান্তরিত উৎপাদন ব্যবস্থার কথা ঘোষণা দেয়। যার মাধ্যমে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত করা সম্ভব। এমন সমাজ গঠনের প্রেরণা ও স্বপ্ন দেখিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সময় অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের নীতি-কৌশল বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে যারা কাজ করেছেন, তাদের অন্যতম বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রফেসর ড. আতিউর রহমান। সে সময় থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংক প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের পাশাপাশি উন্নয়নমূলক ও মানবিক ব্যাকিং ধারণা প্রবর্তিত হয়। সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে আর্থিক সেবায় অন্তর্ভুক্ত করতে উন্নয়নের বাস্তবভিত্তিক দুরন্ত এবং দুর্দান্ত অভিযান পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন সে সময়ের গভর্নর। নিম্ন আয়ের মানুষ বিশেষত রিকশাওয়ালা, মহিলা পোশাক শ্রমিকদের কথা মাথায় রেখে তিনিই প্রথম বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং এবং এজেন্ট ব্যাংকিং চালু করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় ব্যাংকিং সেক্টরে- বিকাশ, ক্রেডিট কার্ড, এটিএম বুথ, অনলাইন ব্যাংকিং ইত্যাদির সফল রূপান্তর ঘটে। মহামারী করোনাকালে কেনাকাটা থেকে শুরু করে অনেক কিছুই হয় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। তৎকালে প্রবর্তিত মোবাইল ব্যাংকিংয়ের বর্তমান এপ্রিল ২০২১ মাস পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী গ্রাহক সংখ্যা ৯ কোটি ৬৪ লাখের অধিক। দৈনিক গড়ে লেনদেন প্রায় ২,১১৫ কোটি টাকা। একইভাবে এজেন্ট ব্যাংকিং ব্যবস্থায় খোলা মোট হিসাব সংখ্যা ১,১৪,৫৩, ১৩৯টি, যার মধ্যে শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে খোলা ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা প্রায় ৩.৬ গুণ বেশি। বিভিন্ন ব্যাংক সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় দশ লাখেরও বেশি মানুষকে ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের মাধ্যমে (ইএফটি) ভাতা প্রদান করছে।
গ্রিন ব্যাংকিং, কৃষি, এসএমই ও পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগে অর্থায়ন বেড়েছে। গত দশক জুড়েই বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষক-বান্ধব নানা উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে। কৃষকের ১০ টাকার অ্যাকাউন্টের সংখ্যা প্রায় ৩৭ শতাংশ। এসব হিসেবে ৩,৬৭৫ কোটি টাকা জমা পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলায় গ্রীন ব্যাংকিং নীতিমালা প্রণয়ন ও বাংলাদেশ ব্যাংকে ‘সাসটেইন্যাবল ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্ট’ ও সকল ব্যাংকে ‘গ্রীন ব্যাংকিং ইউনিট’ চালু রয়েছে। পরিবেশবান্ধব পণ্য-উদ্যোগের জন্য ২০০ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিলকে ৪০০ কোটিতে উন্নীত করা হয়েছে। পরিবেশবান্ধব ইটভাটা স্থাপনে এডিবি’র অর্থায়নে ৪০০ কোটি টাকার তহবিল চালু হয়েছে। রপ্তানিমুখী টেক্সটাইল, চামড়া ও পাট শিল্পকে পরিবেশবান্ধব করার জন্য ২০০ মিলিয়ন ডলারের ‘গ্রীন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড’ গঠন করা হয়। ২০১৯ সালে সকল রপ্তানিমুখী শিল্পকে এই ফান্ডের আওতায় আনা হয়েছে। বলা যায় সবুজ অর্থায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক গোটা বিশ্বের জন্য অগ্রপথিক বা পাইওনিয়ার হিসেবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।
গত এক দশক ধরেই বাংলাদেশের ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক সেবাদাতাদের মানবিক ব্যাংকিংয়ে উৎসাহিত করা হয়েছে। সিএসআর নামে ব্যাংকিং খাতের অর্জিত মুনাফার একটি অংশ জনকল্যাণে ব্যয় করার নিয়ম চালু হয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোর স্কলারশীপ নিয়ে গ্রাম-গঞ্জের হাজার হাজার সুবিধাবঞ্চিত, দরিদ্র মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য সাবেক গভর্নর সূচনা করেন স্কুল ব্যাংকিং। ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে স্কুল ব্যাংকিং হিসাব সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৭,৮৫,৫১৩টি এবং সঞ্চয়ের পরিমাণ ১,৯৮৬ কোটি টাকা। নারীর ক্ষমতায়ন ও কর্মসংস্থানকে উৎসাহিত করতে নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে। কুটির শিল্প, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা এবং নারী উদ্যোক্তাদের মাঝে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি এসএমই ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে। এই খাতের বিকাশ, নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করতে বাংলাদেশ ব্যাংকে এসএমই বিভাগ চালু এবং যুগোপযোগী এসএমই ঋণ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। জুন ২০১১ থেকে জুন ২০২০ পর্যন্ত ১০,৯৬,৯৮৩ কোটি টাকা ঋণ প্রদান করা হয়েছে। এই ঋণের মধ্যে নারী উদ্যোক্তাদের ৪৫,৮৩৯ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
আর্থিক সেবা খাতে ডিজিটাইজেশন এবং প্রান্তজনমুখী নীতির ফলে একদিকে যেমন যুগান্তকারী ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে অন্যদিকে নতুন নতুন ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে। সাইবার আক্রমণ এসব নতুন ঝুঁকিগুলোর মধ্যে অন্যতম। আন্তর্জাতিক সাইবার সিকিউরিটি ফার্ম ম্যাকাফির জরিপ বলছে ২০২০ সালে বৈশ্বিক জিডিপির ১ শতাংশ (১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার) হারিয়েছে সাইবার আক্রমণের কারণে। কাজেই সাইবার আক্রমণ থেকে আর্থিক সেবা খাতকে নিরাপদ রাখাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া কর্তব্য। তবে অনলাইন ব্যাংকিং এবং ডিজিটাইজেশনের পথ থেকে সরে আসা কিন্তু এ সমস্যার সমাধান নয়। গবেষকদের মতে, বাংলাদেশকে আরও সচেতন হতে হবে। যাতে আর্থিক সেবা খাতের ডিজিটাইজেশন বাঁধাগ্রস্ত না করেই পুরো ব্যবস্থাকে আরও নিরাপদ করে তোলা যায়। বর্তমান উন্নত বিশ্ব তাই করছে। সাইবার আক্রমণ মোকাবেলার জন্য ২০২০ সালে ১৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করা হয়েছে। কোথাও ডিজিটাল আর্থিক লেনদেনের গতি কমানো হয়নি। আশার কথা, বাংলাদেশ ব্যাংকও সে পথেই এগিয়েছে। উত্তর কোরিয়া সমর্থিত হ্যাকার গ্রুপের সাইবার আক্রমণের শিকার হওয়ার পরও, বাংলাদেশ ব্যাংক ও দেশের অন্যান্য কর্তৃপক্ষগুলো ডিজিটাল লেনদেনকে নিরুৎসাহিত করেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বরং নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ এবং ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সাইবার অপরাধীদের অর্থ সরানো থামাতে মিলেমিশে কাজ করেছে। তাদের সুবিবেচনাভিত্তিক পদক্ষেপের কারণে হ্যাকাররা শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি সফল হতে পারেনি (হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে পাচার হওয়া টাকার একাংশ ফিরিয়ে আনা গেছে)। হারানো টাকা ফিরিয়ে আনার জন্য এখন একটি আন্তর্জাতিক মামলা চলছে। তবে দুঃখের বিষয়, দেশের ভেতরেই কিছু ব্যক্তি বুঝে বা না-বুঝে এই সাইবার আক্রমণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে তথা পুরো আর্থিক খাতের ডিজিটাইজেশন প্রক্রিয়াকে অযথা দোষারোপ করে যাচ্ছেন। এতে করে একদিকে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে চলে যাওয়া টাকা পুনরুদ্ধারে করা মামলাটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মনোবল ভেঙ্গে যাওয়ার শঙ্কাও তৈরি হচ্ছে।
পরিকল্পিত উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে দূর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্যকন্যা রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাংলাদেশ। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৪৫ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ৫শ কোটি মার্কিন ডলার। বেড়েছে মাথাপিছু আয়ও। ২০১০-২০১১ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিলো ৯২৮ মার্কিন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়ে হয়েছে ২,২২৭ ডলার। মানুষের প্রকৃত আয়ও বেড়েছে। সর্বশেষ ২০১৯-২০ করোনা মহামারীর মধ্যেও প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫.২৪ শতাংশ। সেই বিচারে পৃথিবীর তিনটি দ্রুততম প্রবৃদ্ধির দেশের একটির নাম বাংলাদেশ। মিথ্যা ভিত্তিহীন গুজব, নানান ষড়যন্ত্র তত্ত্ব মোকাবেলা করেই এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ এবং দেশের ব্যাংকিং খাত। নির্দ্ধিধায় বলা যায়, আর্থিক অন্তর্ভূক্তি নীতি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনেই শুধু নয়, টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করায় বড় অবদান রেখে চলেছে। মাত্র এক দশক সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশে প্রভাব ফেলেছে আর্থিক অন্তর্ভূক্তি। করোনা মহামারিকালে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের প্রধানতম অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক বহন করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমনটি করা সম্ভব হচ্ছে বড় আকারের রিজার্ভের কারণেই।
শেখ আনোয়ার: লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।