মহানায়ক ও কালপেঁচার মহাপ্রয়াণ দিবস
রাজীব নন্দী, শিক্ষক ও গবেষক
প্রকাশিত: ১১:২৪ পিএম, ২৪ জুলাই ২০২১ শনিবার আপডেট: ০৯:৪০ এএম, ২৫ জুলাই ২০২১ রোববার
‘নায়ক’ সত্যজিৎ রায় পরিচালিত বাংলা চলচ্চিত্র যার শ্রেষ্ঠাংশে উত্তম কুমার এবং শর্মিলা ঠাকুর। উত্তম কুমারের জীবনী অবলম্বনেই ‘নায়ক’-এর চিত্রনাট্য লিখেছিলেন সত্যজিৎ রায়। উত্তম এখানে অভিনেতা অরিন্দম মুখার্জির চরিত্রে। ছবির কাহিনি বিখ্যাত নায়ক অরিন্দম মুখার্জীর ট্রেন সফরকে কেন্দ্র করে। ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড নিতে ট্রেনে করে তিনি কলকাতা থেকে দিল্লি যাচ্ছেন। ট্রেনের খাবার কামরাতে আচমকাই দেখা মেলে 'আধুনিকা' ম্যাগাজিনের চটপটে সাংবাদিক মিস অদিতির সাথে। অদিতির ভূমিকায় শর্মিলা ঠাকুর। সিনেমার প্রায় পুরোটাই স্বপ্নবিভ্রম আর স্মৃতি রোমন্থন। যার মূল বক্তব্য- কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা হয়েছে অরিন্দমের কিন্তু একাকিত্ব ঘোচেনি। টাকার পাহাড় থেকে একাকিত্বের কংকালের হাড়ের হাত তাকে ছুঁতে চায়।
আজ ২৪শে জুলাই নায়ক উত্তম কুমারের প্রয়াণ দিবস। এককালের মহানায়ক উত্তম কুমার আজকের ‘লাভ ইন দ্য টাইম অফ ফেসবুক’-এ ভীষণ অচল। উত্তমের মতো তীব্র অনুভূতিগুণ কিংবা সুচিত্রার মতো গণবিমুখ নিঃসঙ্গতা উপভোগের যোগ্যতা আমাদের নেই। স্থবির যুগের মহানায়ক উত্তম আজ নেই, তাই ফেসবুক যুগে আমাদের সকলের অধম হইবার এত বাসনা!
‘নায়ক’ উত্তমের কেরিয়ারের ১১০তম ছবি। ১৯৪৮ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত মোট ২১২টি ছবি করেছেন তিনি। তাঁর সবকটি সিনেমাই ভারতীয়, বিশেষ করে বাংলা সিনেমার অলঙ্কার।
বিশেষত, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘সপ্তপদী’, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাস নিয়ে ১৯৫৮ সালে ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’। ১৯৬৩ সালে শেক্সপিয়রের ক্ল্যাসিক নাটক ‘কমেডি অফ এররস’ অবলম্বনে নির্মিত ‘ভ্রান্তিবিলাস’, ১৯৭১ সালে বিমল মিত্রের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘স্ত্রী’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যদিও উত্তম কুমার বলতেই অনেকেই 'হারানো সুর' (১৯৫৭ সালে) ছবিটির কথাই সবার আগে বলবেন। এটি পুরোপুরি বাণিজ্যিক ঘরানার, উত্তম-সুচিত্রা জুটি যেখানে অভিনয়গুনে কালোত্তীর্ণ হয়েছে। মহানায়কের আর বুড়ো হয়ে ওঠা হয়নি। মাত্র ৫৩ বছর বয়সে ‘ওগো বধু সুন্দরী’ ছবির শ্যুটিং চলাকালীনই তাঁর স্ট্রোক হয় এবং পরে হাসপাতালে মহাপ্রয়ান।
আজ আরো একজনের প্রয়াণদিবস যিনি কলকাতার উঠতি মধ্যবিত্তকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন- মন! মন আবার কে? মধ্যবিত্ত জীবনে টাকশাল আমাদের মন গড়ে ভাঙে। তিনি বিনয় ঘোষ!
আজকের সমাজবিজ্ঞান চর্চা ও সমাজতত্ত্বের ব্যাখ্যায় বিনয় ঘোষের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রাসঙ্গিক। তাঁর সমগ্র রচনা বাংলা সমাজতাত্ত্বিক আলোচনায় কোনভাবেই উপেক্ষণীয় নয়। সমাজ, শাসন, শ্রেণিভেদ, দেশ ও ঐতিহ্যকে জানতে বারবার ফিরে যেতে হয় তাঁর কাছে। ইউরোপীয় চশমা ছুঁড়ে ফেলে তিনি ভারতবর্ষীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে সমাজকে দেখেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন। সমাজ-মানসকে জানার ও বোঝার অসীম আগ্রহ ছিল তাঁর।
জন্মের একশো বছর পরে বিনয় ঘোষের সাহিত্য আজো প্রাসঙ্গিক। এর কারণ, তিনি সমাজের অন্তস্থ মৌলিক চিন্তা করতে ও প্রকাশ করতে জানতেন। তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল এই বিচিত্র ও বহুমাত্রিক বাংলাকে সরেজমিন দেখে বীক্ষণকোণ থেকে উন্মোচন করা।
১৯৮৪ সালে বেরোয় তাঁর ‘বাংলার নবজাগৃতি’ বই। এর পরে প্রধানত ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় তিনি লিখতে থাকেন ‘কালপেঁচা’ ছদ্মনামে তুমুল জনপ্রিয় কলাম। অন্য ধারার এক অবলোকন-মূলক জীবনভাষ্য। যেখানে পর্বে পর্বে আছে কলকাতা মহানগরকে উন্মোচনের চেষ্টা! ‘কলকাতা কালচার’ (১৯৫৩), ‘টাউন কলকাতার কড়চা’ (১৯৬১), ‘মেট্রোপলিটন মন : মধ্যবিত্ত : বিদ্রোহ’ (১৯৭৩), ‘কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত' (১৯৭৫) এসব গদ্য রচনার পাশে রঙ্গব্যঙ্গ ঢঙে কালপেঁচার কলমে লেখা গদ্যের যেমন কোনও মিল নেই। একজন গবেষক কিভাবে এই দুটি সত্তাকে মেলাতে পারেন তা বিবিধ আশ্চর্যের বিষয়। দু’ধরনের রচনাশৈলীর মধ্যে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে প্রকাশভঙ্গি কি চাট্টিখানি কথা?
হুতোমি–তীক্ষ্ণ সমাজবীক্ষণ ‘কালপেঁচার নক্শা’ (১৯৫১), ‘কালপেঁচার দু’কলম’ (১৯৫২) ও ‘কালপেঁচার বৈঠকে’ (১৯৫৭) তিনটি বইয়ে সুচারু রসব্যঞ্জনায় চিত্রিত। আবার ঠিকই ১৯৬৭ সালে ‘মেট্রোপলিটন মন’ নিবন্ধে তিনি লিখলেন- '‘কেবল রমণ করেছে এবং খবরের কাগজ পড়েছে এমন একটি জীব হল আধুনিক মানুষ। ... দুটোই যান্ত্রিক অভ্যাস, কোনটাতেই প্রাণ নেই মন নেই। যেমন রমণের ধরন, তেমনই খবরের কাগজের পড়ন।ধনতান্ত্রিক যান্ত্রিক সমাজে এই হল মানুষের চূড়ান্ত পরিণতি।’'
উত্তমকুমার নায়ক সিনেমায় সাংবাদিক অদিতির কাছে ধরাশায়ী হয়েছিলেন। বিনয় ঘোষ সংবাদপত্রকে সমাজের সামনে ন্যাংটা করে দিলেন। সমাজবিদ্যা, যোগাযোগবিদ্যা, সাংবাদিকতার বিদ্যায়তনিক পরিসরে এই দু'জনের দুটি কাজ দারুণ প্রাসঙ্গিক। বলা বাহুল্য বিনয় ঘোষ আমাদের ছাত্রজীবনে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে অবশ্যপাঠ্য ছিলো। কিন্তু কালপেঁচা বিনয় ঘোষকে আবিস্কার করি ছাত্রজীবন শেষে সাংবাদিকতা জীবনে প্রবেশদ্বারে এসে। ফলে কালপেঁচা সমগ্র পড়া পত্রিকায় ফিচার লেখার একটি চমৎকার মন ও চিন্তার গড়ন তৈরি হয়ে যায়।
মহাপ্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধা, মহানায়ক খ্যাত উত্তমকুমার ও কালপেঁচার নকশা খ্যাত বিনয় ঘোষকে!
রাজীব নন্দী, সহকারী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়