ফকির আলমগীর: এক শব্দবীরের নাম
তপন বাগচী
প্রকাশিত: ০৬:২৬ পিএম, ২৪ জুলাই ২০২১ শনিবার আপডেট: ০২:০৪ পিএম, ২৫ জুলাই ২০২১ রোববার
বাংলাদেশের গণসংগীত, লোকসংগীত আর পপসংগীতের খ্যাতিমান শিল্পী ফকির আলমগীর (১৯৫০-২০২১)। ষাটের দশকের শেষের দিকে তিনি ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানার প্রত্যন্ত গ্রাম কালামৃধা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন জগন্নাথ কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পড়তে। সেখানে তিনি রাজনৈতিক দীক্ষা লাভ করেন। সেই রাজনীতি ছিল শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের ভাগ্যবদলের রাজনীতি। ছাত্র ইউনিয়ন ভেঙে মতিয়া চৌধুরী ও রাশেদ খান মেননের নামে দুটি ভিন্ন গ্রুপ জন্ম নিলে তিনি মেনন-গ্রুপের নেতা হয়ে ওঠেন। জীবনের শেষ দিকে তিনি বাংলাদেশে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করার ইচ্ছে পোষণ করলেও, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে জীবনচলার ব্রত গ্রহণ করলেও বামপন্থার আদর্শ ও চেতনাকে বিসর্জন দেননি। তাই প্রতিবাদী গানে তাঁকে দেখা গেছে আমৃত্যু সক্রিয় থাকতে।
জগন্নাথ কলেজে অধ্যয়নের সময়েই তিনি ‘ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী’র সঙ্গে যুক্ত হন এবং গণসংগীতের শিল্পী হিসেবে মাঠে-ঘাটে গান গেয়ে বেড়ান। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রেও তিনি কণ্ঠযোদ্ধা ছিলেন। এই বিষয়ে অনেকরকম নেতিবাচক প্রচারণা ছিল। প্রকৃত তথ্য হলো, কণ্ঠশিল্পী হিসেবে তিনি তখন রথীন্দ্রনাথ রায় কিংবা অন্যদের মতো প্রতিষ্ঠিত বা পরিণত ছিলেন না বয়সের কারণেই। ২০ বছরের তরুণ তিনি তখন। তাঁর আগ্রহ ও নিষ্ঠার কথা বিবেচনা করে সংগীত-পরিচালক সমর দাস তাঁকে সমবেত কণ্ঠে গান গাওয়ার জন্য মনোনীত করেন। তিনি বেশ কয়েকটি সমবেত গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। এর জন্য অবশ্যই তিনি স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পীর মর্যাদা পাবেন। তিনি কণ্ঠযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছেন। আমৃত্যই তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রেখেছেন।
স্বাধীনতার পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে জনসংযোগ পেশাকে গ্রহণ করেন। কিন্তু গান ছিল তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী। সত্তরের দশকের শুরুতে গণসংগীতের সঙ্গে লোকসংগীতের মিশেলে পপসংগীতের এক ধারা সৃষ্টি হলো আমাদের দেশে। আযম খান, পিলু মমতাজ, ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফিরোজ সাঁই আর ফকির আলমগীর—এই ৫জন শিল্পী পপগানের ধারাকে অগ্রসর করেছেন। আযম খান রক, ফেরদৌস ওয়াহিদ আর পিলু মমতাজ রোমান্টিক, ফিরোজ সাঁই আধ্যাত্মিক গানকে পপের ধারায় মিলিয়েছেন। ফকির আলমগীর মিলিয়েছেন গণসংগীতের ধারাকে। তাঁর বিশিষ্টতা এখানেই।
‘ও সখিনা গেছস কিনা ভুইলা আমারে,/ আমি অহন রিশ্কা চালাই ঢাহার শহরে’ গান গেয়ে সখিনা নামের এক বিশেষ চরিত্র সৃষ্টি করেন। ৫/৬ টি গান আছে এই সখিনাকে নিয়ে। কয়েকবছর আগে আমাকে ধরলেন সখিনারে নিয়ে একটা গান লিখে দিতে। তাঁর অনুরোধ মানে তো আদায় করে নেওয়া। যতক্ষণ না গান পাচ্ছেন, ততক্ষণ ফোনে ফোনে বিরক্ত করে ছাড়বেন! আমি তাঁরে এই ভালবাসার নির্যাতন এড়াতে যত দ্রুতসম্ভব গান লিখে দিয়ে রেহাই পেতাম। তিনি বুঝতেন, ‘বলতেন বাগচীদাদা, এই সমাজে কেউ সহজে দিতে চায় না। আদায় করে নিতে হয়।’ হ্যাঁ, তিনি আমার কাছ থেকে আদায় করে নিতেন। তিনি আদায় করে না নিলে আমার অজস্র গান লেখাই হয়ে উঠত না। সখিনার গানের জন্য বললেন, ‘আমার সেই সখিনা এখন কেমন আছে তার কথা তুলে ধরতে হবে। ঢাকা শহরের সখিনারা এখন বদলে গেছে, সেই খবরটি জানাতে চাই।’ আমি দুটি গান লিখে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে সুর দিয়ে আমাকে শোনালেন। সখিনাকে নিয়ে লেখা গানগুলো নিয়ে পৃথক ভিডিও-অ্যালবাম করতে চেয়েছিলেন। হলো না আর। সখিনার গান নিয়ে আর রাজপথে দাঁড়াবেন না এই শব্দবীর। কোভিড তাঁকেও কেড়ে নিল—ভাবলে বেদনায় বুক ভারি হয়ে আসে।
ফকির আলমগীরের জন্য আমি যে শতাধিক গান লিখেছি, তার বেশিরভাগই তাঁর অনুরোধে। কারো জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তিনি গান গেয়ে শুভেচ্ছা জানাতেন। আর ২০ মিনিটের মধ্যেও লিখে দিতে হয়েছে গানের কবিতা। শহিদমিনারে কারো প্রয়াণে নাগরিক শোকসভায় ফকির আলমগীর গান ছাড়া হাজির হতেন না। সেইসব গান আমাকে লিখে দিতে হতো পথে যেতে-যেতে মোবাইল সেটের বাটন টিপে-টিপে। একদিন মজা করে বললাম, আপনি তো সবাইকে নিয়ে গান গাইলেন, আপনাকে নিয়ে কে গাইবে? তিনি আমার এই মজার কথায়ও সিরিয়াস হয়ে বললেন, ‘আরে লেইখা তো দেন দেশিভাই। আমি নিজে তো গাইয়া লই।’ তাঁকে নিয়ে লিখেছেন একটি গান-- আত্মপরিচয়মূলক গান। --
---------------------
জন্ম আমার ফরিদপুরে, (আমি) ফকির আলমগীর।
মাতা হাবিব-উননেছা আর বাপ হাছেন ফকির॥
গোবিন্দ ইস্কুল ছেড়ে যে এলাম জগন্নাথে
কত শত গুণী মানুষ পড়ত আমার সাথে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ রাখি শির॥
উনসত্তরে যোগ দিয়েছি গণঅভ্যুত্থানে
সেই ইতিহাস মেনন-রনো সকল নেতাই জানে
একাত্তরে গানে গানে যুদ্ধে রই স্থির॥
নির্যাতিত যত মানুষ থাকে কাছে দূরে
তাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছি পথে সুরে সুরে
গানে গানে লড়াই করা আমি শব্দবীর॥
আমার গানে সখিনারা পায় যে ফিরে প্রাণ
ম্যান্ডেলা আর হেনরিকেও বাঁধছি দিয়ে গান
মালালা আর সুচিত্রা সেন ছন্দে-লয়ে ধীর॥
এই গানটি তিনি অনেক অনুষ্ঠানে গেয়েছেন। ‘আমি শব্দবীর’ লেখাতে তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। বলছিলেন, ‘কণ্ঠযোদ্ধা’ শব্দটি বহুল ব্যবহৃত এবং তা কেবল স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পীদের বোঝায়। তারা অনেকেই আর রাজপথে সংগ্রামী গান নিয়ে থাকেননি। কিন্তু ফকির আলমগীর আমৃত্যু সংগ্রামী ছিলেন গান নিয়ে, শব্দ (অক্ষর এবং ধ্বনি উভয় অর্থেই প্রযোজ্য) নিয়ে, মানুষের প্রতি বুক ভরা ভালবাসা নিয়ে। ফকির আলমগীর তাই এক শব্দবীরের নাম।
করোনার মধ্যেই তিনি নতুন গান নিয়ে মেতে উঠেছিলেন। আমাকে ফোন করে চাইতেন নতুন গানের বাণী। আমার লেখা গান তিনি সর্বশেষ গেয়েছেন মে মাসে। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের আরেক কণ্ঠযোদ্ধা ইন্দ্রমোহন রাজবংশীর স্মরণসভার জন্য লিখেছিলাম সেই গান। গানটির বাণী ছিল এমন—
তুমি যে ইন্দ্র মোহন তোমার পদবি যে রাজ বংশী
তুমি বাঙালির সংগীতগুরু, শুদ্ধ সুরের অংশী।।
যুদ্ধে গিয়েছ, স্বাধীন বাংলা বেতারে গেয়েছ গান
জাতিকে জাগিয়ে মুক্তি এনেছ, ভুলি নাই এই দান
বারুদ হয়েছে রাগরাগিণীরা, অ্স্ত্র হয়েছে বংশী।।
লিখেছ গানের মধুময় বাণী, যোজনা করেছ সুর
কণ্ঠে নিয়েছ লোকসংগীত, অসুর করেছ দূর
সত্যের পথে থেকেছ সদাই, হও নাই বিধ্বংসী।।
আমার মনে হয়, এখানে ইন্দ্রমোহন রাজবংশীর নামের বদলে ফকির আলমগীর নাম জুড়ে দিল্ওে একই অর্থ দাঁড়ায়। ইন্দ্রমোহনের স্মরণসভায় গান গেয়েছিলেন ফকির আলমগীর। এখন ফকির আলমগীরের স্মরণসভার জন্যও গান লিখব ঠিকই, সেই গান তুলে দেব কার কণ্ঠে?
[তপন বাগচীর ৫০ তম জন্মদিনে শিল্পকলা একাডেমিতে আলোচনা করছেন শিল্পী ফকির আলমগীর। পাশে অধ্যাপক কেয়া বালা, ছড়াকার আসলাম সানী, কবি অসীম সাহা, কবি তপন বাগচী, কবি কাজী রোজী, বাংলা একাডেমির বর্তমান মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা ও কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু]
ফকির আলমগীর আমার ‘কাছের মানুষ’ হয়েছিলেন কেবল গানের সূত্রে। তিনি আমাকে সহোদরপ্রতিম মনে করতেন। তাঁর স্ত্রী সুরাইয়া আলমগীর বনলক্ষ্মী আর ভাই ফকির সিরাজকে বলতেন, ‘এই যে তপন, আমাদের আরেকটা ভাই।’ বলতেন আমাদের জন্ম একজায়গায়, শিক্ষা একই বিষয়ে, কর্মই একই রকম, আর গানে তো একজনের কথা, আরেকজনের কণ্ঠ। আমরা তো একই আত্মায় মিলেছিলাম। একজন চলে গেলেও আরেকজনের হৃদয়ে এই সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ থাকবে। অশ্রুজলে আজ তোমাকে বিদায়-- হে গণশিল্পী হে শব্দবীর।
সংগীতের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি সম্মানসূচক ফেলোশিপ আর রাষ্ট্রীয় একুশে পদক পেয়েছেন। গতবছর একজন জাসাস নেতা ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাকে স্বাধীনতা পদক পেতে দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করে স্টাটাস দিয়েছিলেন ফেসবুকে। আমি ফোন করে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলাম, ‘আপনিও পাবেন, মন খারাপ করবেন না।’ তিনি তখন দ্বিগুণ ক্ষোভে বললেন, ‘হ্যাঁ, পাবো, তবে তা মরার পরে’। তাঁর আশংকাই সত্য। আমরা আশা করব তাঁকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক দেওয়া হবে। তাঁর আত্মা শান্তি পাক।
তপন বাগচী: কবি ও গীতিকার। উপপরিচালক, বাংলা একাডেমি।