মাটির নীচে রহস্যময় সেনাবাহিনী
শেখ আনোয়ার
প্রকাশিত: ১২:৫৯ পিএম, ৯ জুলাই ২০২১ শুক্রবার আপডেট: ০১:০২ পিএম, ৯ জুলাই ২০২১ শুক্রবার
প্রাচীন চীনের প্রথম সম্রাটের নাম ছিলো কিন শি হুয়াংদি। ঘাতকের বিষাক্ত ছোরার আঘাত থেকে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি। সৌভাগ্যক্রমে গুপ্ত ঘাতকের অতর্কিত হামলার ঠিক আগ মুহুর্তে টের পেয়ে যান সম্রাট। তৎক্ষনাৎ একটা পাথরের স্তম্ভের আড়ালে আত্মগোপন করেন তিনি। ঘাতকের অস্ত্র গিয়ে আঘাত করে পাথরের স্তম্ভে। আর এভাবেই প্রাণে বেঁচে যান তিনি। পরবর্তীতে সেই ঘাতকের কপালে কি ঘটেছিলো? তা সহজেই আন্দাজ করা যায়। তবে সম্রাট স্বস্তি পাননি বাকি জীবনে। নিজের নিরাপত্তা নিয়ে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েন। প্রাসাদের সব ক’টা প্রবেশপথ বন্ধ করে দেন তিনি। দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার জন্যে যা যা করা দরকার, সবই করেন। কিন্তু এত কড়া প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেও মন থেকে ভয়টা যায়নি তাঁর। মৃত্যু পরবর্তী জীবনের জন্যেও আগাম প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। মাটি দিয়ে কারুকাজ খচিত বিশাল এক সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন নিজের জন্যে নির্ধারিত সমাধিতে। সে এক আজব কান্ড। এই সেনাবাহিনী লোকচক্ষুর আড়ালে ছিলো সূদীর্ঘ দু’ হাজার বছর।
যে পাহাড়ের নিচে কিন শি হুয়াংদির সমাধি, সেটা উচ্চতায় পনেরো তলা দালানের সমান। তবে সমাধির অনেক অংশই অনাবিস্কৃত রয়ে গেছে আজও। প্রত্নতাত্বিকরা এখনও খোঁড়াখুঁড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন অবিরাম। যাতে দু’হাজার বছরের বেশি সময়ের এই পুরাকীর্তি নষ্ট না হয়, সেজন্যে খুব সাবধানে কাজ করতে হচ্ছে তাদের। ফলে কাজটাও এগোচ্ছে ধীর গতিতে। চারপাশ মিলিয়ে এই সমাধি ক্ষেত্রের আয়তন হবে আট মাইলের মত।
শিঞ্জি নামে চীনের এক প্রাচীন রেকর্ড বইতে উল্লেখ রয়েছে- সে সময় এক ধরনের ক্রুস বো ব্যবহার করা হতো। সমাধির অনাহুত শতত্রুদের অলৌকিকভাবে ঠেকানোর জন্যে। আরও উল্লেখ রয়েছে, সেই সমাধি এলাকার ভেতর খুদে নদী এবং পারদের সাগর ছিলো। আর ছিলো প্রাসাদের খুদে মডেল, ব্রোঞ্জের প্যাভিলিয়ন এবং অনেক দামী দামী রত্নরাজি। শিঞ্জি লেখা হয় সম্রাটের মৃত্যুর একশো বছর পর। তবে সাম্প্রতিক গবেষণা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এই সময়কাল নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সমাধির কাছাকাছি মাটিতে যে পারদ লেভেল রয়েছে, সেটা চারপাশের এলাকা থোকে দু’শ গুণ উঁচু। সমাধির নির্মাণ কাজ যখন শেষ হয়, তখন সম্রাট কিন শি হুয়াংদির এক ছেলে সমস্ত শ্রমিকসহ সমাধির প্রবেশ পথ চিরতরে বন্ধ করে দেয়ার আদেশ দেন। ফলে প্রচুর শ্রমিক সমাধি ক্ষেত্রে আটকা পড়ে মারা যায়। সমাধির এই গোপন রহস্যও চাপা পড়ে থাকে দীর্ঘদিন। বর্তমানে প্রত্মতাত্বিকরা নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছেন এ সম্পর্কে আরও বেশি জানার জন্যে। তাছাড়া রাজকীয় সমাধি এলাকার আশপাশের পূরানো খনিগুলোতে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে আরও নতুন কোন চমক আবিষ্কারের আশায়।
এবার জানা যাক, সমাধি অধিপতি চীনা সম্রাটের সংক্ষিপ্ত জীবনী। চীনা রাজবংশে এই সম্রাটের জন্ম হয় খ্রিস্টপূর্ব দু’শ উনষাট সালে। তাঁর নাম রাখা হয় ইংঝেং। তখন আলাদা আলাদা সাতটা রাজ্য নিয়ে গঠিত ছিলো চীন। এই সব রাজ্যের অধিপতিরা ছিলেন ভয়ানক ঈর্ষাপরায়ণ। এক রাজ্যের সঙ্গে আরেক রাজ্যের যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেই থাকতো। এভাবে দু’শ চুয়ান্ন বছর কেটে যায় তাঁদের। ঝেংয়ের বয়স যখন তেরো, তখন বাবা মারা যান তাঁর। ফলে ঝেং ওই বয়সেই উত্তরাধিকার সূত্রে কিন রাজ্যের রাজা হয়ে বসেন। নতুন রাজা সে সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে সক্ষম হন। তিনি বাকি ছয় রাজ্যের রাজাকে পরাজিত করে সব ক’টা রাজ্য নিজের দখলে নিয়ে আসেন। তৈরি হয় বিশাল সাম্রাজ্য কিন, যা এখন চীন নামে পরিচিত। এভাবে সামান্য রাজা থেকে প্রবল পরাক্রমশালী সম্রাটে পরিণত হন ঝেং। তখন নামও পাল্টে যায় তাঁর। ইংঝেং হয়ে যান কিন শি হুয়াংদি। যার অর্থ হচ্ছে, চীনের প্রথম সম্রাট। কিন শি হুয়াংদি নিজের সাম্রাজ্যকে সুরক্ষিত করার জন্যে সীমান্ত বরাবর টানা এ দেওয়াল তুলতে থাকেন যা আজ চীনের মহাপ্রাচীর নামে পরিচিত। তাঁর সময়ে চীনে মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়। জিনিসপত্রের ওজন এবং মাপজোক চালু হয়। এছাড়া গোটা রাজ্যের জন্যে একধরনের লিখনরীতিও চালু হয়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্র সেই ক্রিস্টপূর্ব দু’শ একুশ সাল থেকে উনিশ ’শ এগার সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিলো। অর্থাৎ সময়টা দু’হাজার বছরেরও বেশি। এই বিশাল কীর্তির জন্যে তাঁকে সমাজবিজ্ঞানীরা চীনের মহান সমন্বয়কারী বলে থাকেন।
এদিকে এই সমাজবিজ্ঞানীরাই আবার তাঁকে কিনের বাঘ বলে থাকেন। সম্রাট তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত সমস্ত শত্রুকেই কতল করেন। তারপর শত্রুদের শির বড় বড় খুঁটির মাথায় ঝুলিয়ে রাখেন। যাতে অন্যরা এ থেকে শিক্ষা পায়। তিনি নিজের মাকে পর্যন্ত গৃহবন্দী করে রাখেন এবং বড় ভাইকে পাঠান নির্বাসনে। কিন শি হুয়াংদি তাঁর সাম্রাজ্যে অনেক আইন প্রবর্তন করেন। এই আইন অমান্যের জন্যে কঠোর শাস্তিরও বিধান ছিলো। তিনি তাঁর শাসনামলে চারশত ষাট জন পন্ডিত ব্যক্তিকে জীবন্ত কবর দিয়েছিলেন। গোপন ষড়যন্ত্রকারী সন্দেহে তাদের এরকম নির্মম সাজা দেয়া হয়। যেসব বইয়ে তাঁর গুণকীর্তন থাকতো না, সেসব বই পুড়িয়ে ফেলতেন তিনি। সুদীর্ঘ জীবনের প্রতি বাড়াবাড়ি রকমের লোভ ছিলো তাঁর। দীর্ঘায়ু লাভের জন্যে অনেক কিছুই করেছেন তিনি। বিভিন্ন গাছ-গাছড়ার আরক খেয়েছেন। জীবনের প্রতি অতি লোভই শেষমেষ কাল হয়ে দাঁড়ায় তাঁর। দীর্ঘায়ু লাভের কবিরাজের পদ্ধতি উল্টো আয়ু খাটো করে দেয় তাঁর। খ্রিস্টপূর্ব দু’শ দশ সালে উনপঞ্চাশ বছর বয়সে মারা যান তিনি।
এবার দেখা যাক, সম্রাটের এই গোপন সমাধি আবিষ্কৃত হলো কিভাবে? উনিশ শত চুয়াত্তুর সালে কুয়ো খুঁড়ছিলেন চীনের কিছু কৃষক। এসময় মাটির একটি মূর্তি বেরিয়ে আসে। তারা তখন মূর্তিটাকে আবার মাটি চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কবর খোঁড়াখুঁড়ি বা মৃতদের নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি চীনাদের ঐতিহ্য বিরোধী কাজ। কিন্তু ঘটনাটা চাপা থাকেনি। ইযুয়ান ঝেংই নামে এক প্রত্নতাত্বিক দ্রুত সেখানে পৌঁছে এই রহস্যময় আবিষ্কারের ব্যাপারে অনুসন্ধান চালানোর জন্যে হাত দেন। কয়েক মাসের মধ্যে ব্যাপক খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়ে যায়। আর ঘটতে থাকে একর পর এক বিস্ময়কর কান্ড। সারি, সারি সৈনিক আর অজস্র ঘোড়া বেরিয়ে আসতে থাকে। হাজার হাজার মূর্তি শাবল আর গাঁইতির গুঁতোয় ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। এরপর প্রচুর সৈনিক ও ঘোড়া অক্ষত থাকে। প্রত্মতাত্বিকরা উচ্ছসিত হয়ে ওঠেন খুশিতে। পাওয়া গেছে সেই প্রবল শক্তিধর সম্রাটের গুপ্ত সমাধি।
মাটির পুরু স্তরের নিচে কাঠের গাড়ির ভাঙ্গা টুকরো-টাকরা, বর্শার হাতল, এবং দশ হাজারেরও বেশি ধাতব তীরের মাথা, আর তলোয়ার খুঁজে পান তারা। এই অস্ত্রগুলো এতোই ধারালো যে, দিব্যি চুল কাটা যায়। এগুলোর কিছু ছিলো ক্রোম নামে এক ধরনের ধাতব উপাদানের প্রলেপ দেওয়া। মরচে প্রতিরোধে বেশ ফলদায়ক এই ধাতব প্রলেপ। ইউরোপীয়রা এই ধাতব প্রলেপের ব্যবহার জানার হাজার হাজার বছর আগে থেকেই চীনারা এই কৌশলটাকে কাজে লাগাতো। ইযুয়ান ঝেংই তাঁর এই সাফল্যের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেছেন, এই বিস্ময়কর আবিষ্কারের ব্যাপারটা প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না আমরা।
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।