বরেন্দ্রর রাখাল রাজারা
কাইসার রহমানী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে
প্রকাশিত: ০১:০৫ পিএম, ৮ জুলাই ২০২১ বৃহস্পতিবার আপডেট: ০৬:২৩ পিএম, ৮ জুলাই ২০২১ বৃহস্পতিবার
এ যেন পল্লী- গ্রাম নয়, এক টুকরো স্বর্গ যেন ধরিত্রীর ভিতরে। এসব পল্লীর পরিবেশের শুভ্রতা, স্নিগ্ধতা আর সৌন্দর্যে মনে হয় যেন স্বর্গের কোন একটা অংশ নিশ্চুপ হয়ে ছবির মতো ফ্রেমে আটকে গেছে। এখানে যতদূর চোখ যায় কিংবা তার থেকেও বেশিটা জুড়ে বিস্তির্ণ সবুজ মাঠ আর নীরবতা। প্রকৃতি এখানে মনমতো নিজেকে সাজিয়েছে। যেখানে গাছ-গাছালি, সবুজ ঘাস, পদ্মফোটা পুকুরের স্বচ্ছ জল স্বপ্নের এক পৃথিবী তৈরি করে। প্রকৃতির এই সৌন্ে র্যে মুগ্ধ হয়ে বুঝি কবিগুরু লিখেছিলেন- নিখিলের এত শোভা এত রূপ, এত হাসি গান। ছাড়িয়া যাইতে মোর কভু নাহি চাহে মন-প্রাণ। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলার বংপুর, চামড়াদহ, লক্ষীপুর, চাড়ালডাঙ্গা আর হুক্কাপুরের এমন প্রাকৃতিক পরিবেশ আপনার বেঁচে থাকার ইচ্ছাটাকে আরো বাড়িয়ে তুলবে। ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করবে না। আর এসব স্থানেই বছরের প্রায় ছয় থেকে সাত মাস বাড়িঘর ছেড়ে খোলা আকাশের নীচে বাস করে বরেন্দ্র অঞ্চলের রাখাল রাজারা। তাদের সঙ্গে থাকে ৪০০ থেকে ৫০০ গরুর পাল।
আগের দিনের ডাক হরকরারা যেমন হারিকেন আর হাতে লাঠির মাথায় ঘন্টা নিয়ে ছুটতেন ভোর হবার আগেই চিঠির বস্তা পৌঁছে দিতে, বরেন্দ্রর রাখাল রাজারাও ৪০০ থেকে ৫০০ টি গরুর পাল নিয়ে রাতের বেলা ছোটেন এক স্থান থেকে অন্যস্থানের তৃণভূমিতে পৌঁছানোর জন্য। রাখালেরা তাদের গরুর পাল নিয়ে ঘর ছাড়েন ছয় থেকে সাত মাসের জন্য। উদ্দেশ্য বরেন্দ্র অঞ্চলের বিভিন্ন মাঠে-তৃণভূমিতে গরুগুলো থাকবে, সবুজ-সতেজ ঘাস খেয়ে বড় ও স্বাস্থ্যবান হবে। বাড়িতে রেখে এতগুলো গরু পুষলে, তাদের খাবারের যোগান দিতে হাজার হাজার টাকা খরচ হয়। আর বাইরে কোন তৃণভূমিতে গরুগুলোকে মাসের পর মাস চড়ালে কোন টাকাই খরচ হয়না তাদের পেছনে। আর্থিকভাবে লাভবান হতেই ৪০০ থেকে ৫০০ গরুর পাল নিয়ে বরেন্দ্র এলাকার এক শ্রেণির রাখালরা ঘর ছাড়েন ছয় সাত মাসের জন্য।
রাখালেরা গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে গরুগুলো সংগ্রহ করেন। অনেক গরুর মালিক চুক্তিতে রাখালদের গরু চড়ানোর জন্য দিয়ে দেন। এতে গরুর মালিকেরও অর্থের সাশ্রয় হয়। আবার পালে রাখালদের নিজেদের গরুও থাকে। এমনই রাখাল রাজা তাসাউর, আল আমিন, হাসিব ও কামালের সঙ্গে দেখা হলো অপরাজেয়বাংলা’র প্রতিবেদকের।
এক রাতে ভোর চারটার সময় ৪৫০টি গরুর পাল নিয়ে তারা যাচ্ছিলেন গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুরের খোয়াড়মোড় দিয়ে। কোথায় যাচ্ছেন এত গরু নিয়ে? এমন প্রশ্নে রাখালরা জানান, তারা হুক্কাপুরের বিলের নীচের অংশের মাঠে যাচ্ছেন। তাদের মধ্য থাকা রাখাল সর্দার তাসাউর বলেন, তাদের বাড়ি শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট। গরু নিয়ে তৃণভূমির উদ্দেশ্যে তারা ঘর ছেড়েছেন চারমাস আগে। গত চারমাস চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন বিল, তৃণভূমি, বাগান আর মাঠে ছিলেন। এবার তারা যাবেন গোমস্তাপুর উপজেলার হুক্কাপুরসহ বিভিন্ন তৃণভূমিতে। অপরাজেয় বাংলার সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদককে তারা তাদের সঙ্গে নিতে রাজি হলেন। শুরু হলো রাখালদলের সঙ্গে ক্লান্তিহীন পথ হাঁটা।
রাত থেকে ভোর পর্যন্ত গরুর পাল নিয়ে তারা রাস্তায় হাঁটছেন তো হাঁটছেন। তাদের নিদ্রাহীন চোখ দেখে দেখে রাখছে প্রত্যেকটা গরুকে। গরুগুলোও যেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, কোন ঝামেলা না করেই দলবেঁধে চলছে সামনের দিকে। গন্তব্য যেন তাদের চেনা। হাঁটতে হাঁটতে রাখাল আল আমিনকে প্রশ্ন করা হলো, শত শত গরু। এত গরু দেখে রাখেন কিভাবে, পাল থেকে একটা-দুইটা গরু হারিয়ে গেলে বুঝতে পারেন কিভাবে? গামছায় মুখ মুছে তার সরল জবাব, ‘গরু পালা হামাদের কালচার। এদের দিয়াই হামাদের জীবন চলে। পালে চোখ বুলাইলে বুইঝা লি গরু ঠিক আছে নাকি কম আছে।’ হাঁটতে হাঁটতে সূর্য উঠে গেছে। একটু আগেই যা অন্ধকারের জন্য ঠিকমতো দেখা যাচ্ছিলোনা এখন তা পরিস্কার। এখনো হেঁটে চলছেন রাখালেরা। এরা যেন সেক্সপিয়রের ম্যাকবেথের মতো। ‘ম্যাকবেথ আর ঘুমাবেনা’- সংলাপের মতো, রাখালরাও যেন ঘুমায়না।
রাখালেরা গরুর পাল নিয়ে সাধারনত রাতে এক স্থান থেকে আরেক স্থান, এক উপজেলা থেকে আরেক উপজেলায় যাতায়াত করেন। প্রায় দুই ঘন্টা হাঁটার পর বিস্তীর্ণ তৃণভূমি হুক্কাপুরের বিলের নিচের অংশটি পছন্দ হলো রাখাল রাজাদের। রাখাল সর্দার তাসাউর সিদ্ধান্ত দিলেন, এখানেই তারা আস্তানা গাঁড়বেন। বিশাল মাঠের এক কোণায় একটা বড় বট গাছের তলায় তারা তাদের পিঠে ঝুলানো ব্যাগগুলো রাখালেন। ছয় থেকে সাতদিনের জন্য এই গাছতলা হয়ে যাবে তাদের বাড়ি-ঘর।
এদিকে মাঠের সবুজ সতেজ ঘাস পেয়ে গরুগুলোও ব্যস্ত ঘাস খেতে। এখন সারাদিন-রাত মাঠে চড়বে তারা আর তাদের দেখে রাখবে রাখাল রাজারা।
এখানে রাখালদের কাজ শুধু একটাই, সারাদিন গরুগুলো মাঠে চড়ানো। সবুজ ভূমিতে ৪০০-৫০০ গরুর পাল মনমুগ্ধকর পরিবেশ তৈরি করে। এই অপরূপ সৌন্দর্য মনে আনে প্রশান্তি। কিছুক্ষণ পরপর রাখাল রাজারা বিশেষ শব্দ করে গরুকে শাসন করেন। গরু অন্যদিক চলে গেলে তারা ঠিক স্থানে নিয়ে আসেন। গরুগুলোও যেন ইচ্ছা করে চোর-পুলিশ খেলা করে। রাখালরা ছুটে যান গরুর কাছে। এপাশ থেকে অপাশে সরিয়ে দেন। সবুজ মাঠ ভরে উঠে সাদা-কালো বিভিন্ন রঙের গরুর পালে। যে দিকেই দৃষ্টি দেয়া যায়, শুধু গরু আর গরু। দূরন্ত বাছুরগুলোও বেশ মজায় থাকে। খুনসুটি করে ক্লান্ত হয়, মায়ের দুধ খেয়ে এসে আবারো দূরন্তপনা। এরপর আবার নিজের বয়সি বন্ধুর সঙ্গে গম্ভীর হয়ে বসে থাকা, ভাবটা যেন অনেক বয়স হয়ে গেছে তাদের।
গরুগুলো ঘাস খেতে খেতে এগিয়ে যায়। তাদের সঙ্গে রাখালেরাও এগিয়ে যায়। রাতে আবার সব গরুকে এক জায়গায় রাখা হয়। রাখাল সর্দার তাসাউর জানালেন, প্রায় ১৫ বছর ধরে এই পেশাতে আছেন তিনি। তার বাবা-দাদারাও রাখাল ছিলেন। তাদের কাছ থেকেই এই পেশার কাজ শিখেছেন। বরেন্দ্র এলাকার গরুর পালগুলোতে সাধারন ৫ থেকে ৭ জন রাখাল থাকে। তাদের দলে ৫ জন আছেন। রাখাল কামাল বলেন, তিনি এ পেশায় ১০ বছর থেকে আছেন। তারা বাবাও রাখাল ছিলেন। মাসের পর মাস তারা খোলা আকাশের নীচে থাকেন। যেখানে রাত হয়ে যায় সেখানেই তারা ঘুমানোর ব্যবস্থা করেন।
রাতের বেলা রাখাল হাসিবকে দেখা গেল ব্যাগ থেকে পলিথিন বের করছেন। পলিথিনটি মাটিতে সুন্দর করে বিছালেন। ব্যাগটিকে মাথার নীচে দিয়ে বালিশ বানিয়ে ফেললেন। অপরাজেয় বাংলার প্রতিনিধিকেও একটা ব্যাগ দিলেন তিনি। বললেন, ভাই মাটিতে বিছানো পলিথিনই তাদের বিছানা। ব্যাগ তাদের বালিশ। এভাবেই ঘুমান তারা। পাশে শুয়ে প্রশ্ন করা হলো, দিনের পর দিন বাইরে থাকেন আত্মীয়-পরিজন ছেড়ে। কষ্ট হয়না? তিনি বলেন, তাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। তাছাড়া খুব বেশি খারাপ লাগলে দুই মাস পর একবার বাড়ি যান তারা। মাঠে ঘুমানোতে এক সমস্যা, বিলের পাশের মাঠগুলোতে জোঁক হয় প্রচুর। একবার ধরলে শরীর থেকে ছড়ানো যায়না। প্রচুর রক্ত খায় তারা।
বট গাছের নীচে, সঙ্গে আনা দা দিয়ে চুলো তৈরি করা হয়েছে। রাখাল আল আমিন রান্না করছেন। তারা তাদের রান্না নিজেরাই করেন। অথবা শুধু রান্না করার দায়িত্ব দেয়া হয় একজনকে। ডেরাতেই তারা গোবরের স্তূপও তৈরি করেন। সারের জন্য তাদের এসব গোবরের স্তুপ কিনে নেন কৃষকেরা। চালের বিনিময়েও গোবরের স্তুপ কেনা হয়। আল আমিন জানালেন, খরার সময় আশেপাশের কৃষকরা সার পেতে রাখালদের চাল দেন। শর্ত থাকে গরু তাদের জমিতে চড়াতে হবে। কারণ, গরুর যে গোবর জমিতে পরে তা জমিকে খুব উর্বর করে। ফসল ভাল হয়। আবার গ্রামের কোন বাড়িতে রাখালরা আগে থেকেই ভাত রান্নার কথা বলে রাখেন, পরে সেখান থেকেও অল্প টাকা দিয়ে তারা সেসব সংগ্রহ করেন।
রাতে রাখাল সর্দার তাসাউর গরুর পাল থেকে বাছুরগুলোকে আলাদা করেছেন। প্রায় ৬০টি বাছুর। সারারাত তাদের আলাদা করে রাখা হবে, যেন মায়ের দুধ খেতে না পারে। সকালে গরুর দুধ দুয়ানোর পর তাদের মায়ের কাছে যেতে দেয়া হবে।
সকাল বেলা তৃণভূমির একটা স্থানে গরু আর বাছুরগুলো জড়ো করা হয়। বাছুরগুলোও আলাদা। এখন দুধ দোয়ানো হবে। পাত্রগুলো জমির ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া পানিতে পরিস্কার করছেন রাখালরা। চমৎকার এক দৃশ্য দেখা গেল। দুধ দোয়ানোর জন্য গরুর নাম ধরে ডাকছেন রাখালরা। গোলাপী, আলাপী, জরিনা, সুন্দরী, আলকাপী, শাবানা ইত্যদি নাম ধরে ডাকছেন আর সেই নামের গরু তার বাছুরের দিকে ছুটে আসছেন। বাছুরকে একটা দড়ি দিয়ে গরুর সামনের পায়ের কাছে বেঁধে রেখে দুধ দোয়ান রাখালেরা। তাসাউর বলেন, দিনে ৬০ থেকে ১২০ লিটার দুধ তারা পেয়ে থাকেন। এই দুধ বিক্রি করে দেন। মূলত গরুর দুধ আর গরু বিক্রি করে বছরে তাদের ১ লাখ থেকে শুরু করে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় হয়। এছাড়া অন্য যাদের গরু পালা রাখা হয় তারাও বকশিশ দেন।
বিশাল নীরব মাঠে কখনো কখনো শূণ্যতা তাদের মনেও ভর করে। মনে পড়ে যায় ফেলে আসা গ্রামের কথা, বাড়ির কথা, স্বজনদের কথা। সুযোগ পেলে তাই মনের মানুষগুলো কেমন আছেন জেনে নেন। খুব খারাপ লাগলে তারা নিজেদের মধ্যে গল্প করেন, মোবাইলে গান শোনেন। কখনো কখনো নিজেরাও গান করেন।
জানা যায় এসব অঞ্চলে ২০ থেকে ২৫ টি রাখালের দল ৩০০ থেকে ৫০০ গরু নিয়ে বের হন বোরো ধান কাটার পর। বর্ষার সময় আমন ধান আবাদ শুরু হলে একে একে পালগুলো বাড়ি ফিরে আসে। চৈত্র্য মাসে চৈতালি ফসল কাটার পর তারা গরুর পাল নিয়ে আবার মাঠে নামেন। আমন ধান কাটার পর আবারও বরেন্দ্রর মাঠে মাঠে দেখা যাবে বহু গরুর পাল। ছয় মাসে তারা প্রায় ১৮ থেকে ২০ টি জায়গা বদল করেন। মাইলের পর মাইল হেঁটে গরু নিয়ে যান তৃণভূমিতে।
তখন বিকেল। সূর্য অস্ত যাবে। গোধূলী বেলা হুক্কাপুরের তৃণভূমিতে সুন্দর এক ছবি তৈরি করেছে। রাখালেরা তখনো ব্যস্ত গরু নিয়ে। বিশাল শূণ্য মাঠে গরুর পেছনে বিশেষ শব্দ করে তাদের ছুটে চলা ভিন্ন এক পরিবেশ তৈরি করছে। আস্তে আস্তে নেমে আসে অন্ধকার। হারিকেন আর টর্চের আলো ছাড়া কিছুই দেখা যায়না। নীরব মাঠে শুধু মাঝে মাঝে কিছু নাম কানে আসছে। আলাপী, জিলাপী, শ্যামলী, আলকাপী, জরিনা, সুখী... বুঝতে পারলাম গরুর নাম ধরে ডেকে রাখালরা গরু ঠিক আছে কিনা তা নিশ্চিত হচ্ছেন।