ইউসুফ খান থেকে লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনের জীবনে দিলীপ কুমার
এন্টারটেইনমেন্ট ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩:০০ পিএম, ৭ জুলাই ২০২১ বুধবার আপডেট: ০১:৩৫ পিএম, ৮ জুলাই ২০২১ বৃহস্পতিবার
পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখাওয়া প্রদেশের রাজধানী পেশোয়ারের প্রাণকেন্দ্র কিস্সা খাওয়ানি বাজারের ইতিহাসে ১৯২২ সালের ১১ ডিসেম্বর তারিখটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই তারিখেই খাওয়ানি বাজারে এক পাঠান মুসলিম পরিবারে জন্ম নেন হিন্দি সিনেমার ইতিহাসের সর্বকালের সেরা সুপারস্টার দিলীপ কুমার। এই কিংবদন্তীর বাবা মায়ের দেওয়া নাম হলো ইউসুফ খান।
দিলীপ কুমারের বাবা ছিলেন একজন ফল ব্যবসায়ী, ব্যবসার কাজে তিনি বোম্বে আসতেন। বাবার সঙ্গেই ১৯৩৫ সালে এই অভিনেতার বোম্বে আসা। সেখানে ১৯৩৭ এ ১৯৩৭ সালে বোম্বের আনজুমান ইসলাম হাই স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন। কিছুদিন পর বোম্বে থেকে ১৮০ কিলোমিটার দূরে বাবার ব্যবসার কাজে তার পরিবার দেওলালিতে চলে গেলেও কয়েক বছরের মধ্যে তারা আবার বোম্বেতে ফিরে আসেন। ভর্তিহন বিখ্যাত খালসা কলেজে। সে সময়ে পরিচয় হয় হিন্দি সিনেমার আরেক কিংবদন্তী রাজকাপুরের সাথে। যার স্থায়ীত্ব ছিল আজীবন।
বাড়িতে রাগারাগি করে একসময় ঘর ছাড়েন দিলীপ কুমার। জীবনের কঠিন রঙ্গমঞ্চে পুনে শহরে দিলীপ কুমারের পরিচিত কেউ ছিলো না। পুনে শহরে এক রেস্টুরেন্টে কাজ যোগাড় করে দিলীপ কুমার বেশ পরিচিতি পান। হাজার পাঁচেক রুপি জমিয়ে তিনি বোম্বের উদ্দেশ্যে পুনে ছাড়েন।
বোম্বে টকিজ তখন হিন্দি চলচ্চিত্র প্রযোজনার একচ্ছত্র প্রতিষ্ঠান। এর সবকিছু দেখাশোনা করতেন মিস দেবিকা রানী। দিলীপ কুমার তখন পর্যন্ত কোনো সিনেমাই দেখেননি। এক পরিচিতজনের সাথে তিনি একবার বোম্বে টকিজের অফিসে যান। দেবিকা রানী প্রথম দেখাতেই দিলীপ কুমারকে পছন্দ করে ফেলেন। মাসিক ১,২৫০ রুপি বেতনে তিনি বেতনভুক্ত অভিনেতা হিসেবে নির্বাচিত হন বোম্বে টকিজের। সালটা ছিলো ১৯৪২।
আরও পড়ুন: ৯৮ এ চলে গেলেন দিলীপ কুমার
জুহুতে সমাহিত হবেন দিলীপ কুমার
প্রথম দুমাস দিলীপের কাজ ছিলো শুধু শ্যুটিং স্পটে উপস্থিত হয়ে ছবির কাজ দেখা। অশোক কুমার তখন সুপারস্টার।
সেই মুহুর্তে একটা বিরাট ব্যাপার ঘটে গেলো। বোম্বে টকিজের মালিক দেবিকা রানী ঘোষণা দিলেন, খুব শিগগিরই তিনি এই নবাগত পাঠান যুবক ইউসুফ খানকে নিয়ে একটি সিনেমা বানাবেন। হলো নাম বদল, সেই থেকে তিনি দিলীপ কুমার।
১৯৪৪ সালে দিলীপ কুমারের প্রথম সিনেমা ‘জোয়ার ভাটা’ মুক্তি পায়। তারপর ‘প্রতিমা’ (১৯৪৫) এবং ‘মিলন’ (১৯৪৭) সিনেমা দুটি মুক্তি পায়। তবে ১৯৪৭ সালের শেষদিকে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘জুগনু’ই হচ্ছে তার প্রথম হিট ছবি।
অভিনেত্রী কামিনী কুশলের সাথে দিলীপ কুমারের সার্থক জুটি গড়ে উঠে সে সময়। ‘নদীয়া কে পাড়’ (১৯৪৮) এবং ‘শবনম’ (১৯৪৯) নামে পরপর দু’বছরে দুটি সুপারহিট সিনেমা তৈরি হয় দিলীপ কুমার আর কামিনী কুশলকে নিয়ে।
অশোক কুমারের পর হিন্দি সিনেমার সবচেয়ে বড় তারকা হয়ে উঠেন দিলীপ কুমার। এরপর পুরো পরিবারকে নিয়ে বোম্বের বেভারলি হিলস খ্যাত অভিজাত এলাকা বান্দ্রায় বসবাস করা শুরু করেন তিনি।
১৯৫৫ সালে অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত সিনেমায় নাম ভূমিকায় অভিনয় করে ‘ট্রাজেডি কিং’ উপাধিতে ভূষিত হন। তারপর দিলীপ কুমার অভিনীত প্রায় প্রতিটি সিনেমা, যেমন- নয়াদৌড় (১৯৫৭), মুসাফির (১৯৫৭), মধুমতি (১৯৫৮), পয়গাম (১৯৫৯), কোহিনুর (১৯৬০) সুপার-ডুপার হিট হয়। হিন্দি সিনেমার স্বর্ণালী যুগের বিখ্যাত নায়িকা নার্গিস, মধুবালা, নিম্মি, বৈজয়ন্তীমালা, মীনা কুমারী, ওয়াহিদা রেহমান- সবাই দিলীপ কুমারের বিপরীতে অভিনয় করার জন্য মুখিয়ে থাকতেন।
রোমান্টিক চরিত্রে অভিনয়ের জন্য দিলীপ কুমারের কোনো বিকল্প ছিলো না। দিলীপ কুমারের সৌভাগ্য বলতে হবে যে, হিন্দি সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম সেরা কয়েকজন পরিচালককে তিনি পাশে পেয়েছিলেন। পরিচালক কমরুদ্দিন আসিফের অনবদ্য সৃষ্টি মুঘল-ই-আজম (১৯৬০) হিন্দি সিনেমার ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত ছবির একটি। সম্রাট আকবরের চরিত্রে রাজকাপুরের বাবা পৃথ্বিরাজ কাপুর ও সম্রাট জাহাঙ্গীর ওরফে প্রিন্স সেলিমের চরিত্রে দিলীপ কুমার দুর্দান্ত অভিনয় করেন।
১৯৬২ সালে বৃটিশ পরিচালক ডেভিড লিয়েন দিলীপ কুমারকে লরেন্স অব অ্যারাবিয়া সিনেমায় শেরিফ আলীর ভূমিকায় অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু দিলীপ কুমার তাকে না করে দেন। এই চরিত্রে পরে অভিনয় করেন মিশরীয় অভিনেতা ওমর শরীফ। দিলীপ কুমারের নিজের প্রযোজিত ছবি ‘গঙ্গা যমুনা’ (১৯৬১) খুব বিখ্যাত একটি ছবি। নিজের ভাই নাসির খানকে এই ছবিতে অভিষিক্ত করেন তিনি। সেটাতে তিনি নিজেও করেন দুর্দান্ত অভিনয়।
সত্তর দশকে ত্রিমুর্তি দিলীপ-দেব-রাজের দাপট কমে যায় রাজেশ খান্না ও পরবর্তীতে অমিতাভ বচ্চনের আগমনে। অবশ্য বয়সও হয়ে গিয়েছিল তাদের। এছাড়া ওয়াহিদা রেহমানের সাথে দিল দিয়া দরদ লিয়া (১৯৬৬), রাম আউর শ্যাম (১৯৬৭) বক্স অফিসে তুমুল ব্যবসা করে।
অমিতাভ বচ্চনের সাথে অভিনীত তার শক্তি (১৯৮২) সিনেমাটিও হিট হয়। তারপর তিনি বিধাতা (১৯৮২), দুনিয়া (১৯৮৪), মশাল (১৯৮৪), কর্ম (১৯৮৬) ও সওদাগর (১৯৯১) সিনেমায় অভিনয় করেন। ১৯৯৮ সালে কিলা সিনেমায় সর্বশেষ অভিনয় করেন। এর মধ্য দিয়ে শেষ হয় দিলীপ কুমারের রূপালী পর্দার বর্ণাঢ্য জীবন।
১৯৬৬ সালের ১১ অক্টোবর সহশিল্পী সায়রা বানুকে বিয়ে করেন দিলীপ কুমার, ৪৪ বছর বয়সে। সায়রা বানু দিলীপ কুমার থেকে ২২ বছরের ছোট। এই দম্পতির কোনো সন্তান হয়নি।
দিলীপ কুমার ১৯৮০ সালে বোম্বে নগরীর শেরিফ নির্বাচিত হন। কংগ্রেস পার্টির সাথে ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। জওহরলাল নেহেরুর খুব কাছের বন্ধু ছিলেন তিনি। ২০০০-০৬ সাল মেয়াদে তিনি রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন ।
১৯৮৮ সালে দিলীপ কুমার তার জন্মভূমি পাকিস্তানে যান। পাকিস্তানের সামরিক শাসক জিয়াউল হক তাকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ঘোষণা করেন। সেটাই ত্রিশের দশকের পর তার প্রথমবার পাকিস্তান যাওয়া।
এরপরে ১৯৯৮ সালে তিনি শেষবারের মতো পাকিস্তান যান।সেবার পাকিস্তান সরকার তাকে তাদের সর্বোচ্চ বেসামরিক সন্মান ‘নিশান-ই-ইমতিয়াজ’ খেতাবে ভূষিত করে।
দিলীপ কুমার বলিউডে এমনই দাপুটে অভিনেতা ছিলেন যে, ৮ বার তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। আর ১৯ বার তিনি এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন! তার এই দুটি রেকর্ড আজও অম্লান।
হিন্দি সিনেমাজগতের সবচেয়ে বড় সম্মান 'দাদাসাহেব ফালকে' পুরস্কারেও তাঁকে সম্মানিত করা হয়েছিল। ২০১৫ সালে সরকার দিলীপ কুমারকে দেশের দ্বিতীয় বড় সম্মান 'পদ্মভূষণ'–এ সম্মানিত করেছিল।