টিকটক, লাইকি ও সামাজিক অবক্ষয়
শাহাবুদ্দিন শুভ
প্রকাশিত: ০৬:০৭ পিএম, ৪ জুলাই ২০২১ রোববার আপডেট: ০৬:১১ পিএম, ৪ জুলাই ২০২১ রোববার
একবিংশ শতাব্দীতে তথ্য প্রযুক্তি ছাড়া কোনকিছু চিন্তাই করা যায় না। এনালগ থেকে অতিমাত্রায় ডিজিটালের রূপান্তরিত হয়েছে শহর থেকে গ্রামের মানুষ। স্মার্ট ফোন ব্যাবহার করেন কিন্তু ফেইসবুক, ইউটিউব টিকটক কিংবা লাইকির নাম শোনেননি বা ব্যাবহার করেননি এরকম লোক খোঁজে পাওয়া বিরল। অধিকাংশ অ্যাপসের মাধ্যমে ভালো কাজ হতে দেখা গেলেও টিকটকে অ্যাপের ব্যবহারকারী কার্যক্রম অ্যাপসটিকে করেছেন বিতর্কিত। এই অ্যাপসের মাধ্যমে নারী পাচার থেকে শুরু করে মাদক ও কিশোর গ্যাং এর প্রভাব সামনে এসেছে।
১.
আমাদের দেশের মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারী সংখ্যার দিকে যদি একটু নজর দেই তাহলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে। দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বর্তমানে সাড়ে ১৬ কোটি ছাড়িয়েছে (বিক্রি হওয়া সিমের হিসাব অনুসারে)। সম্প্রতি বাংলাদেশ টেলিকম নিয়ন্ত্রক সংস্থা (বিটিআরসি) তাদের ওয়েবসাইটে এ তথ্য প্রকাশ করেছে। ওয়েবসাইটে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যবহারকারীর মোট সংখ্যা প্রকাশ করেছে বিটিআরসি। প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৬ কোটি ৫৫ লাখ ৭২ হাজার।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ইন্টারনেটের গ্রাহক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ কোটি ৯৪ লাখ ২৮ হাজার। যার মধ্যে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বরাবরের মতো বেশি। বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে দেশে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ৯ কোটি ৩৬ লাখ ৮১ হাজার। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী অধিকাংশই সরাসরি টিকটক অ্যাপস ব্যবহার করেন, আবার যারা অ্যাপসটি ব্যবহার করেননি কিন্তু কোন সাামাজিক মাধ্যমে টিকটকে বানানো ভিডিও দেখেনি তা হতেই পারেন।
২.
সম্প্রতি ভারতের বেঙ্গালুরুতে বাংলাদেশি এক তরুণীকে বিবস্ত্র করে পৈশাচিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এরপরই উভয় দেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয় এবং নিন্দার ঝড় ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে ভারত এবং বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও গোয়েন্দা বাহিনীগুলো কঠোর হয়। এরই মধ্যে ওই ভিডিওতে দেখা যাওয়া ভুক্তভোগী তরুণী ও নির্যাতনকারী অন্যতম হোতা টিকটক হৃদয় বাবুসহ অন্যদের গ্রেপ্তার করে বেঙ্গালুরুর পুলিশ।
সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পেয়েছে বেশ চাঞ্চল্যকর তথ্য শত শত তরুণ-তরুণীদের নিয়ে প্রায়ই পার্টির আয়োজন করতেন হৃদয় বাবু। আর এসব পার্টি ছিল হৃদয়ের নারী পাচারের মূল প্ল্যাটফর্ম। হ্যাংআউট পার্টি ও পুল পার্টিই ছিল টিকটক হৃদয়ের নারীদের ফাঁদে ফেলার মূল অস্ত্র। এ দুই ধরনের পার্টির মাধ্যমে বন্ধুত্বের কৌশলে তরুণীদের পাচার করে দিত হৃদয়।
হৃদয় বাবুর পুল পার্টি এবং হ্যাংআউটে অংশ নেওয়া অনেকের কাছেই ছিল স্বপ্নের মতো। কারণ এসব পার্টিতে মিলত তরুণ-তরুণীদের অবাধ মেলামেশার সুযোগ। পার্টিতে থাকতো সব ধরনের আয়োজন। হৃদয়ের পুল পার্টিতে অংশ নিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ত উঠতি টিকটকাররা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিক্রি হয় এসব পার্টির টিকিট। উচ্চ শব্দে মিউজিকের তালে নাচানাচি! সুইমিং পুলে উশৃঙ্খল নাচানাচির মধ্যেই নারীর সান্নিধ্যে আসে তরুণরা। অবৈধ সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা বখাটেরা। উঠতি বয়সী তরুণদের আকৃষ্ট করতে ব্যবহার করা হয় তরুণীদের। আনন্দের আড়ালে চলে নগ্নতা!
পার্টিতে অংশ নেওয়া তরুণীদের মধ্যে থেকেই টার্গেট করা হত। বেশি বেতনে চাকরির লোভ দেখিয়ে পাচার করতো ভারতে। পাচার হওয়ার পর পালিয়ে আসা এক ভুক্তভোগী কিশোরী জানিয়েছেন তার অভিজ্ঞতার কথা। তিনি বলেন, পুল পার্টিতে মাদক সেবন হয় অতি মাত্রায়। ওখানে টিকটক ছাড়াও আরও অনেক কিছু হয়।
গত বছর আগস্টের কথা নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে, ইয়াছিন আরাফাত অপু মোবাইল ভিত্তিক অ্যাপস ‘টিকটক’ ও ‘লাইকি’তে নিজের নানা ভিডিও তৈরি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করার জন্য উত্তরা ছয় নম্বর সেক্টরের আলাওল এভিনিউতে বেশ কয়েকজন অনুসারী নিয়ে রাস্তা দখল করে আড্ডা দিচ্ছিল। এসময় মেহেদী হাসান নামে স্থানীয় এক তরুণ ও তার বন্ধুরা গাড়ি নিয়ে ওই সড়ক ধরে যাবার সময় হর্ন বাজিয়ে রাস্তা থেকে সরে যাওয়ার অনুরোধ করে। সড়কে সাইড দেওয়া নিয়ে মেহেদী হাসান ও তার বন্ধুদের সঙ্গে অপুর অনুসারীদের বাকবিতণ্ডা হয়।
পরে অপু ও তার অনুসারীরা মেহেদী ও তার বন্ধুদের মারধর করে। এই ঘটনায় ভুক্তভোগী একজনের বাবা এস এম মাহবুব হাসান বাদী হয়ে উত্তরা মডেল থানায় অপু ও তার অজ্ঞাত অনুসারীদের নামে মামলা করেন। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলতে থাকে। পরে পুলিশ অপু ও তার সহযোগী নাজমুলকে গ্রেফতার করে।
৩.
টিকটকের যাত্রা শুরু হয় ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে। এটি ২০১৮ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ডাউনলোড করা অ্যাপ্লিকেশন ছিল। টিকটক ভিডিও বাংলা, আরবি, ইংরেজি, হিন্দিসহ প্রায় ৪০টি ভাষায় প্রচলিত। অপর দিকে সিঙ্গাপুর ভিত্তিক বিগো টেকনোলজি ২০১৭ সালের জুলাইয়ে তৈরি করে লাইকি। বিশ্বের নানা দেশে প্রায় ৩৭টি ভাষায় তৈরি করা যায় লাইকি ভিডিও।
টিকটক ও লাইকির লিডারশিপ বোর্ডে থাকা ভিডিও নির্মাতাদের বয়স ২০-২৫ বছর থাকার কথা থাকলেও কম বয়সী ছেলেমেয়ে বা তরুণেরা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করছেন অ্যাপ দুটি। সহজে ভিডিও তৈরি করা, নতুন কোনো বাস্তবতা যুক্ত করা, জুম, স্ক্রিন ছোট-বড়, ঝাপসা করা ইত্যাদি খুব সহজেই দর্শককে আকৃষ্ট করে তুলছে। এতে করে সহজেই বুঝা যায় এর অপব্যবহার কি পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছে ।
অন্যদিকে ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে পর্নোগ্রাফি ছড়ানোর অভিযোগে টিকটক বন্ধের আদেশ দিয়েছিল ভারতের একটি আদালত। সেই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেছিল চীনের ‘বাইটডান্স টেকনোলজি’। টিকটকের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি না করার আবেদন খারিজ করে দিয়েছে মাদ্রাজ হাইকোর্ট। এরপরই টিকটক প্লেস্টোর থেকে ব্লক করেছিল গুগল।
সমাজে কুপ্রভাব ফেলছে, এই অভিযোগ এনে ‘টিকটক’ এর বিরুদ্ধে ঐ সময় একটি জনস্বার্থ মামলা হয়েছিল। ২০১৯ সালের ৩ এপ্রিল মামলাটি মাদ্রাজ হাইকোর্টে ওঠে। আদালত তখন জানিয়ে দিয়েছিল, বহুল জনপ্রিয় এই ভিডিও অ্যাপ পর্নোগ্রাফি ও শিশুর যৌন নিগ্রহের মতো ঘটনাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। অতএব, কেন্দ্রীয় সরকারের এখনই এই অ্যাপ-এর নিষেধাজ্ঞা জারি করা উচিত।
ভারতের কেন্দ্রীয় তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সূত্রের বরাত দিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, সরকার এরপরই অ্যাপল ও গুগলকে চিঠি লেখে। সেই চিঠিতে এই দুই সংস্থাকে আদালতের নির্দেশ মেনে ‘টিকটক’ অ্যাপ বন্ধ করার কথা বলা হয়। গুগল আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী তাদের প্লে স্টোর থেকে তুলে নেয় ‘টিকটক’ অ্যাপটি।
৪.
১৯ শে জুন ২০২১ শনিবার সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মোহাম্মদ হুমায়ন কবির পল্লব এবং ব্যারিস্টার মোহাম্মদ কাউছার ‘ইন্টারনেট প্লাটফর্ম থেকে টিকটক, বিগো লাইভ, ফ্রি ফায়ার গেম পাবজি ও লাইকির মতো অনলাইন গেমস এবং অ্যাপস অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন।
নোটিশের অনুলিপি ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব, বিটিআরসির চেয়ারম্যান, শিক্ষা সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, আইন সচিব, স্বাস্থ্য সচিব এবং পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজি) এই নোটিশ পাঠানো হয়েছে। নোটিশে ক্ষতিকর গেমস ও অ্যাপস বন্ধে ৪৮ ঘণ্টা সময় দেয়া হয়েছে। অন্যথায় জনস্বার্থে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হবে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
নোটিশে বলা হয়েছে, পাবজি এবং ফ্রি ফায়ারের মতো গেমগুলোতে বাংলাদেশের যুব সমাজ এবং শিশু-কিশোররা ব্যাপকভাবে আসক্ত হয়ে পড়েছে। যার ফলে সামাজিক মূল্যবোধ, শিক্ষা, সংস্কৃতি বিনষ্ট হচ্ছে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়ে পড়ছে মেধাহীন। এসব গেমস যেন যুব সমাজকে সহিংসতা প্রশিক্ষণের এক কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে।
এই লেখা প্রস্তুত করার জন্য আমি বেশ কিছু টিকটক ভিডিও দেখলাম সেখান থেকে শেখার মত কিছুই নজরে আসেনি। এসেছে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, যৌনসুরসুরি দেওয়া কথাবার্তা। তাই সামাজিক অবক্ষয় রোধে বাংলাদেশে টিকটক লাইকির মত অ্যাপস নিষিদ্ধ করার জন্য দ্রুত সরকারিভাবে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এই প্রজন্মের জন্য সুন্দর, সাবলীল বিনোদনের ব্যবস্থা করে খেলাধুলাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতামূলক কার্যকলাপে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করতে হবে। সামাজিকভাবে অভিভাবক ও সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসলেই আগামী প্রজন্মকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, সিলেটপিডিয়া।