ডেল্টা করোনা কেন বেশি ভয়ংকর?
শেখ আনোয়ার
প্রকাশিত: ০১:৪৯ পিএম, ৪ জুলাই ২০২১ রোববার
করোনার হানায় বদলে গেছে দৈনিক রোজনামচা। গতি হারিয়েছে স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ। মরনব্যাধির দাপটে পর্যুদস্তু জনজীবন। দিনরাত এক করে বিজ্ঞানীরা আলোচনা, গবেষণা চালালেও এখনও পর্যন্ত অধরা এই রোগ থেকে মুক্তির উপায়। যার ফলে দিন যতোই যাচ্ছে ততোই নিত্যনতুন উপসর্গ নিয়ে হাজির হচ্ছে করোনাভাইরাস। বাংলাদেশে রূপবদলানো ডেল্টা করোনাভাইরাসের দাপট স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের কাছে আতঙ্ক ও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনকার করোনা শুধু নামেই করোনা। এর আড়ালে জন্ম নিয়েছে নতুন প্রজাতির ভাইরাস। আগে শরীরে তৈরি হওয়া ভাইরাসের অ্যান্টিবডি দিয়ে আটকায় না ডেল্টা করোনাভাইরাস। এমনকি আগে একবার করোনা সংক্রমিত হলেও সুরক্ষা নেই। ঠিক ধুরন্ধর রাজনীতিবিদদের মতো ধূর্ত ও জঘন্য এই ডেল্টা করোনাভাইরাস। যা মিউটেশন করে নিজের প্রোটিনের গঠনকে রদবদল করে ফেলার ক্ষমতা রাখে। এই ভাইরাসের প্রাণভোমরা এতোটাই ভয়াবহ যে, এটি হাজার হাজার বার কপি করে ফেলে ভাইরাসের আরএনএ জিনোমকে। এক একটি কপি থেকে তৈরি হয় এক একটি জ্যান্ত ভাইরাস। অন্যদিকে ভাইরাসের আরএনএ ছাড়াও তৈরী হয় বিভিন্ন রকমের মেসেঞ্জার আরএনএ। তার থেকে তৈরী হয় বিভিন্ন রকমের প্রোটিন যা আরএনএ জিনোমের সঙ্গে মিশে তৈরী করে আরও নতুন ভাইরাস। এই নতুন ভাইরাস বানাবার সময় নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে নেয় দেহ কোষের গলগি বডি (নিউক্লিয়াসের নিকটে অবস্থিত দু’স্তরবিশিষ্ট ঝিল্লী দিয়ে বেষ্টিত নালিকা, জালিকা, ফোস্কা, থলি ইত্যাদি আকৃতির সাইটোপ্লাজমীয় অঙ্গাণুকে গলগি বডি বলা হয়।) যন্ত্রকে চাকর হিসেবে ব্যবহার করে। তারপর সোজা পৌঁছে যায় কোষের মেমব্রেনে। মেমব্রেনের লিপিডকে ছিনিয়ে নিয়ে নিজেকে ঢেকে নেয় বর্মে। আবার আক্রমণ করে নতুন দেহ কোষকে। ঘটনাগুলো ক্রাইম সিরিজের গল্পের মতো শোনালেও এই সাংঘাতিক মৃত্যুদূতের ভেতরে থাকা সত্যি উপাদানগুলো বিজ্ঞানীরা সংগ্রহ করেছেন ল্যাবরেটরিতে কালচার করে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, অতি সংক্রামকের পাশাপাশি ডেল্টা করোনায় চেনা উপসর্গ সব সময় দেখা যায় না। তখন তাকে ওষুধ দিয়েও রোখা যায় না। বিজ্ঞানীরা জানান, ‘এভাবে যতো করোনার প্রজাতির বিবর্তন ঘটবে, ড্রাগ কাজ নাও করতে পারে। ততোই টিকার শক্তি হ্রাস হওয়ার একটা আশঙ্কা রয়ে যায়।’ সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, ‘ভাইরাসের ডেল্টা প্রজাতির সামনে ক্রমে শক্তি হারাচ্ছে টিকা।’ তাই ডেল্টা প্রজাতি আতঙ্কে চিন্তা বাড়ছে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের। ডেল্টার মিউটেশন একদিনের মধ্যে হয়নি। যতো নতুন মানুষের শরীরে ভাইরাস ঢুকেছে, ততো নতুন মিউটেশন হয়েছে। এভাবে জিনের পরিবর্তন জমা হতে হতে একদিন আবির্ভূত হয়েছে এই ডেল্টা নামের রক্তবীজের বংশ। দারুণ সংক্রমণের ক্ষমতা। হু হু করে ছড়িয়েছে শহর থেকে শহরে, তারপর গ্রামে। সম্প্রতি প্রতিবেশী দেশ ভারতে করোনার ভয়াবহতায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করে। দেশটিতে অক্টোবর ২০২০ তে প্রথম এই প্রজাতি দেখা দেয়। ৩১ শে মে, ২০২১-এ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে নতুন করোনা ভাইরাসের শ্রেণীবিভাগ প্রকাশ করে, সেখানে ডেল্টা, ডেল্টা প্লাস এবং আরও তিন প্রজাতির সঙ্গে রয়েছে ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্নড শ্রেণীতে। মানে এই ভ্যারিয়েন্টকে নিয়ে পৃথিবীজুড়েই দুশ্চিন্তা রয়েছে।
বিজ্ঞানীরা দেখেন, সেই দেড় বছরের আগের শিশু করোনাভাইরাসের তুলনায় এই ডেল্টা প্রজাতিতে রয়েছে ১২ বা তারও বেশি মিউটেশন! দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি অল্প সময়ের মধ্যে মারাত্মক শারীরিক জটিলতা তৈরির মাধ্যমে ডেল্টা ভারতকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। ভারতের পর নেপালে কী পরিমাণ সর্বনাশের কারণ হয় বিশ্ববাসী তা দেখেছে। হাসপাতালগুলোতে রোগী উপচে পড়ে। হাজার হাজার মানুষ মারা যায় প্রতিদিন। ভারত জুড়ে তান্ডব চালানোর মধ্যেই এটি বাংলাদেশে এসেছে। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকা শহরে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে ৬৮ শতাংশ রোগীর শরীরে অতিসংক্রামক ভারতীয় ডেল্টা (বি.১.৬১৭.২) ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি পাওয়ার তথ্য আইসিডিডিআরবি’র গবেষণায় উঠে এসেছে। এখন মহাসাগর পেরিয়ে ইউরোপে পাড়ি দিয়েছে। ডেল্টা সংস্করণ নিয়ে দুশ্চিন্তায় জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল। ব্রিটেনে করোনা ভাইরাসের দৈনিক সংক্রমণ প্রায় চার মাস পর আবার দশ হাজারের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। নতুন করে আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৯৫ শতংশই ডেল্টা সংস্করণ বহন করছে। ফলে হাসপাতালের ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটের উপর চাপ এবং মৃতের সংখ্যা বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। ব্রিটেনে শিশুদের মধ্যে এই সংস্করণ ছড়িয়ে পড়ার কারণে শিশুদেরও টিকা দেবার কথা আলোচনা হচ্ছে। ব্রিটেনের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেক দেশেও করোনায় আক্রান্তদের মধ্যে এই ভেরিয়েন্টের অনুপাত বেড়ে চলেছে। ডেল্টা সংস্করণের প্রসার নিয়ন্ত্রণ করতে পর্তুগালের রাজধানী লিসবন দেশের বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। রাশিয়ার রাজধানী মস্কো থেকেও ডেল্টা সংক্রমণের হার বাড়ার খবর পাওয়া যায়।
বিজ্ঞানীরা জানান, ’সাধারন করোনাভাইরাস রোগীর শরীরে বেশিদিন বেঁচে থাকে না। কিন্তু সাত থেকে চৌদ্দ দিনের মধ্যেই ভাইরাস যখন কোষের মধ্যে বংশবৃদ্ধি করে, তখনই মিউটেশন হয়। অর্থাৎ, ভাইরাস যতো নতুন নতুন মানুষের শরীরে ঢুকবে, ততোই নতুন মিউটেশন হওয়ার আশঙ্কা! করোনার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সেই ২০১৯ সালের ভাইরাস এখন শুধু নামেই রয়েছে। এখনকার ভাইরাসের জিনে ইতোমধ্যে ঘটে গেছে আমূল পরিবর্তন।’ মানুষ যেমন তার ওষুধ, ভ্যাকসিন ইত্যাদি অস্ত্র নিয়ে জীবাণুজগতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে, তেমন ভাইরাসেরও অস্ত্র রয়েছে সেই আক্রমণ প্রতিহত করার। মিউটেশন হলো সেই গোপন অস্ত্র। জিনের পরিবর্তন ভাইরাসের বাহ্যিক রূপে বদল এনে ভয়ংকর করে তুলে। আগের ওষুধ, আগের ভ্যাকসিন, সবই তখন অচল, অসহায় হয়ে যায়! বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ‘অপ্রতিরোধ্য ডেল্টা প্রজাতির করোনাভাইরাসকে ভ্যাকসিন দিয়েও মারা যায় না। করোনার এই ধরনটি এখন বাংলাদেশেও বড় উদ্বেগের কারণ। বিভিন্ন জেলায় করোনাভাইরাস শনাক্তের হার ফের বাড়তে বাড়তে যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে মহামারী শোচনীয় পরিস্থিতির দিকে মোড় নিতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ডেল্টা প্রজাতিতেই করোনার মহামারীর শেষ নয়। হয়তো কিছুদিন পরে আবার আসবে নতুন মিউটেশন। তার ধ্বংসের ক্ষমতা হয়তো হবে আরও বেশি। কিংবা আমাদের সৌভাগ্য হলে, হয়তো কমে যাবে ভাইরাসের তেজ। ভ্যাকসিন নেওয়া থাকলে তাতে কিছুটা হলেও সুরক্ষা দেবে। তাই ভ্যাকসিন নিতেই হবে।
এদিকে বিশ্বজুড়েই এখন ভ্যাকসিনের সঙ্কটকাল। অনেক দেশ এখনও ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু করতে পারেনি। তার মধ্যেও শেখ হাসিনা সরকার ছয় মাস আগে বাংলাদেশে ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু করে। ভ্যাকসিন সঙ্কটের কারণে সাময়িক ভ্যাকসিন কর্মসূচি ব্যাহত হলেও আবারও শুরু হয়েছে ভ্যাকসিন দেওয়া। ভ্যাকসিন হিরো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘যত টাকাই লাগুক আরও ভ্যাকসিন সংগ্রহ করা হবে।’ আমাদের রাষ্ট্রনায়কের এই দৃঢ় উচ্চারণে দেশের মানুষের মনে আবার সঞ্চারিত হয়েছে প্রত্যাশার প্রাণ। করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত নিম্ন আয়ের লাখ লাখ পরিবারকে সরকার নগদ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে দেশের মানুষের জীবন-জীবিকাকে প্রাধান্য দিয়ে প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কল্যাণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি কার্যকর করার জন্য মাস্ক পরা ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা নিশ্চিত করতে দেশব্যাপী চলছে লকডাউন। বলা যায়, করোনা পরিস্থিতিতে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশই এখন সব থেকে ভালো অবস্থানে রয়েছে। এখন মৃত্যু কমিয়ে আনার জন্য সবাইকেই সহযোগিতা করতে হবে। নিজ নিজ ঘরে থেকে পালন করতে হবে সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর জীবন। নির্মূল করতে হবে ডেল্টা করোনাকে। আগে জীবন তারপর জীবিকা। জীবন বাঁচাতে, লকডাউনে জীবিকা কিছুদিন স্থগিত না করে উপায় নেই।
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।