অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

৫ কোটি মানুষকে খাবার জোগালেন যিনি

বিস্ময়কর ভিকাস

ইন্টারন্যাশনাল ডেস্ক

প্রকাশিত: ০৭:৫৪ পিএম, ১২ অক্টোবর ২০২০ সোমবার  

প্রাণঘাতী করোনা কেড়ে নিচ্ছে মানুষের জীবন। লাশের মিশিল কেবল লম্বাই হচ্ছে দিন দিন। করোনাকালীন সময় মানুষকে অনেক কিছুই দেখিয়েছে। চরম সংকটময় মূহুর্তে মাস্ক কেলেঙ্কারী, চাল চুরির ঘটনা যেমন দেখা গেছে, তেমনি এক ভিখারির ১০ হাজার টাকা দানও মানুষকে মানবতার নতুন গল্প শিখিয়েছে।

তবে এমন অনেককেই ছাপিয়ে গেছেন বিখ্যাত রন্ধনশিল্পী ভিকাস খান্না। এই মহামারীর সময়ে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষকে খাদ্য সরবরাহ করে সৃষ্টি করেছেন মহানুভবতার নতুন এক ইতিহাস। এপ্রিল থেকেই সময় এবং দুরত্বের ব্যবধানকে তুচ্ছ করে সুদূর নিউইয়র্ক থেকে ভারতের অসহায় মানুষদের খাদ্য যোগাতে কাজ করে যাচ্ছেন অ্যাওয়ার্ড জয়ী রন্ধনশিল্পী ভিকাস খান্না।

‘ফিড ইন্ডিয়া’ নামক কর্মসূচিতে এখন পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কোটি মানুষকে খাদ্য সরবরাহ করেছেন তিনি। তার এই কাজকে বলা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় খাদ্য কর্মসুচি। ভিকাস খান্না ভারতের প্রথম রন্ধনশিল্পী যিনি মিশলা স্টার (খাবারের স্বাদ, পরিবেশনা, মান ইত্যাদির উপর পাওয়া পুরষ্কার) পেয়েছেন। ভারতীয় খাবারের উপর তার ৩৫ টি বই আছে। বারাক ওবামার জন্য রান্না করেছেন এবং ভারতের মাস্টারশেফ রিয়েলিটি শোর বিচারক ছিলেন।

তারপরও জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন বলছেন এই  ‘ফিড ইন্ডিয়া’ কর্মসূচিকে। খান্না বলেন ‘যখন আমি শুরু করি তখন আমার মস্তিষ্ক বলে এই কাজ করোনা, তুমি মনযোগ হারাবে। কিন্তু মন বলে তোমার মা ইন্সটাগ্রাম ছবি বা ভিডিও  পোস্ট দেয়ার জন্য তোমাকে বড় করেননি। 

ভারতের প্রান্তিক জনগণের কাছে খাবার পৌছে দিতে প্রথমে সেচ্ছাসেবকদের একটি দল তৈরি করেন খান্না। কিন্তু এসময় লকডাউনে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় এবং মানুষ ঘরে থাকতে বাধ্য হওয়ায় তার কাজের বাস্তবায়ন ছিলো খুবই কঠিন । 

এত বড় পরিসরে কাজ করার পরিকল্পনাও খান্নার ছিলোনা। কিন্তু মার্চের শেষ দিকে তার মেইলে একটি মেসেজ আসে। যেখানে বিদেশে অবস্থানরত ভারতীয়দের নিজ দেশের মানুষদের সাহায্য করার জন্য আবেদন করা হয়।  

খান্না জানান, ‘সে মেইলে একটি ছবি ছিলো যেখানে দেখা যায় এক বৃদ্ধ খাবারের খালি প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।  ছবিটি দেখে আমি কিছু টাকা দান করি এবং আমার সেচ্ছাসবেকদের সে সংগঠনকে সাহায্য করতে উৎসাহ দেই’। 

ছবিটি আমার টিমের একজন সদস্য আগেই দেখেছিলো। সে জানায় ছবিটি সরকারি এক ওয়েবসাইট থেকে নেয়া। অর্থাৎ টাকা চোরের হাতে পড়েছে। কিন্তু ছবিটির দৃশ্য আমার মাথায় গেঁথে যায়। 

এপ্রিলের ১ তারিখ খান্না একটি টু্ইট করেন। সেখানে তিনি মানুষের কাছ থেকে সাহায্য প্রয়োজন এমন  বৃদ্ধাশ্রম, অনাথ আশ্রম ও  কুষ্ঠরোগীদের চিকিৎসা কেন্দ্রের নাম জানত চান। কিছুক্ষণের মধ্যেই ১ হাজার মানুষ উত্তর দেয়। 

তখন ভারতে লকডাউনের প্রথম সপ্তাহ চলছিলো। নিউইয়র্কের অবস্থা ছিলো আরও ভয়াবহ। খান্নার ব্যবসাও তখন ক্ষতিগ্রস্থ। খান্না জানান, ‘সবকিছুই তখন বাজে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। ৩১ মার্চ এক নতুন রেস্টুরেন্ট খোলার জন্য চুক্তি হওয়ার কথা। সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। তারপরিই আমি ‘ফিড ইন্ডিয়া’ তে মনযোগ দেই’।  

প্রথমে তার টিম ভারতের যে শহরের খাবারের বেশি প্রয়োজন সেগুলোর শর্টলিস্ট করে। তারপর শহরের পাইকারী দোকানদারদের থেকে শুকনো খাবার নিয়ে প্যাকেট করে তাদের কাছে পাঠাতে থাকে। এপ্রিলের তিন তারিখ তারা প্রথম খাদ্য সরবরাহ করে ভারতের দুই প্রান্তের দুই শহর উত্তর প্রদেশের বেনারাস ও কার্নাটাকার ম্যাঙ্গালোরে। 

কিন্তু এই পথচলা সহজ ছিলোনা মোটেও। ১০ এপ্রিল তাদের পুরো খাবার ভর্তি ট্রাকই ছিনতাই হয়ে যায়।

সে প্রসঙ্গে খান্না জানান,  এই ঘটনায় আমি খুবই হতাশ হই এবং কর্মসূচি বন্ধ করার চিন্তুা করি। কিন্তু পরবর্তীতে মায়ের উৎসাহে আমি আবার মনযোগ দেই। এসময় একটি বিশ্বাসযোগ্য প্রতিষ্ঠানের সাহায্য প্রয়োজন অনুভব করেন তিনি। সে ভাবনা থেকেই যোগাযোগ করেন ভারতের জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দলের (এনডিআরএফ) প্রধান এসএন প্রধানের সাথে । 

এনডিআরএফ এর সাহায্যে খান্না লাখ লাখ শ্রমজীবী, তৃতীয় লীঙ্গের মানুষ, নারী, যৌনকর্মী, এইডস রোগী, অনাথ এবং বছরের শুরুতে বন্যা কবলিত বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, আসামের মানুষকে খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। প্রথমে নিজের জমানো টাকা দিয়ে শুরু করলেও একে একে তার সাথে যোগ হয়েছে পেপসি, ইন্ডিয়া গেট, হায়াত রিজেন্সি, কোয়াকার ওটস এর মতো প্রতিষ্ঠান। আর খাবার দিয়ে শুরু করা এই কর্মসূচি এখন বিতরণ করছে মাস্ক, সেনিটাইজার এবং জুতাও। 

অথচ এই মানুষটার পথচলা ছিলো অনেক কঠিন। জন্মেছিলেন পায়ের সমস্যা নিয়ে। একসময় হাঁটতে হয়েছিলো কাঠের জুতা পরে। ডাক্তাররা বলেছিলেন খান্না কখনও স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারবে না । তবে শেষ পর্যন্ত তেমনটা হয়নি। তবে এজন্য তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে। কোনো কিছুর সহায়তা ছাড়া ১১ বছর বয়সে হাঁটতে পেরেছিলেন খান্না। 

স্কুলে বন্ধুরা খেপাতো বলেই বেশিরভাগ সময় ঘরে থাকতেন এই বিশ্বখ্যাত পাচক। সেখানেই দাদির কাছে রান্নার প্রথম তালিম নেন তিনি। ২০০০ সালে নিউইয়র্কে গিয়ে একবছর কাজ করেছেন ডেলিভারি বয়, বাসন পরিষ্কারকারী হিসেবে। তারপর ২০০৪ সালে এক রেস্টুরেন্টে কাজের সুযোগ পেয়ে নিজের রন্ধন প্রতিভা প্রকাশের সুযোগ পান ভিকাস খান্না। এখন নিউ ইয়র্ক ও দুবাইতে তার বেশ কয়েকটি রেস্টুরেন্ট আছে।