নজম: এক কাহিনী
রায়ান নূর
প্রকাশিত: ০১:৫১ পিএম, ৩০ জুন ২০২১ বুধবার
পশ্চিমে সূর্য ডুবে গেল ৷
চারপাশে কাকের আনাগোনা। রাস্তার পাশে কাওকে দেখলেই ছোঁ মারে। মানুষ একরকম অতিষ্ঠ। রাত নামে ৷ কাকেরা নিশ্চুপ হয়ে যায় ৷ নওশাদ এখনো গভীর ঘুমে ৷ জীবনে না পাওয়ার হতাশায় ঘুমের ঔষুধ খেয়েছে ৷ তার ঘুম ভাঙেনা ৷ পৃথিবীটা এখন ধীরে ধীরে তার কাছে রঙিন হয়ে ওঠে ৷ ভীষণ অন্ধকার আলোয় ভরে যায় ৷ নিজেকে আবিষ্কার করে এক কামড়ায় ৷
কিরে পৃথিবীর বিদ্যা কি শেষ হয়ে গেল? আকবরের কর্কশ কণ্ঠে নওশাদের চেতন হলো ৷ কি যেন মগ্নতা ভর করেছিল তার ৷ কূলকিনারাহীন ভাবনায় ছেদ ঘটে গেল ৷ হতচকিত দৃষ্টিতে গলার স্বর বেরোয়,
: পৃথিবীর বিদ্যা ! আচ্ছা,আমাদের বয়স কত?
আকবর উত্তর দিতে পারল না ৷
: আচ্ছা,ঐ সন্ধ্যা-তারা কি আমাদের দেখতে পায়? আকবর নিরুত্তর ৷
দুজনেই কেমন চুপচাপ ৷ নীরবতা ভেঙে গেল আকবরের কণ্ঠে ৷
: কখনোই না ৷ সন্ধ্যা তারার কাছে আমরা ধূলির মতোও নই, তারও কম ৷
: জীবনের অর্থ কী?
: অর্থহীন ৷
: এই অর্থহীনতার মধ্যেই কি লুকিয়ে নেই সব অর্থ?
: থাকতে পারে ৷
নওশাদ আওড়ালো মুখে,
যাকে ভুলে যেতে চাই, সরে রাখি দূরে
সে-ই দুঃখ হয়ে আসে বারবার, আসে নিকটে ৷
মনে ভেসে ওঠে ৷
একদিন নওশাদ অনেকগুলো ছেড়া কাগজ নিয়ে ঘরে বসেছিল ৷ কাগজগুলো ছিল গবেষণার প্রমাণপত্র ৷ সব অর্থহীন ভেবে কিছু কাগজ ছিড়ে ফেলে ৷ কিছু রেখে দেয় ৷ ছেড়া কাগজগুলো গুছাতে গুছাতে তার মনটা হু হু করে কেঁদে ওঠে ৷ সবকিছুই কি তার শেষ হয়ে গেল ! এতদিনের শ্রম ৷ কি হলো তার! ভাবনার কোন কূল কিনারা নেই ৷ সাগরসমান বিদ্যার কোন সঙ্গতি নেই ৷
তার চোখটা ঝাপসা হয়ে আসে জলে ৷ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ছড়ানো কাগজগুলোর দিকে ৷
আকবর ঘরে ঢোকে একটা পান হাতে ৷ কোন কথা না বলেই তার মুখে গুজিয়ে দেয় ৷ নওশাদ কোন উত্তর করে না ৷ হঠাৎই কি যেন খুঁজে পায় কাগজের বিবর্ণ বর্ণগুলোর মাঝে ৷
নওশাদের বিষণ্ণ মনটা হঠাৎ প্রফুল্ল হয়ে ওঠে ৷ চোখ ছল ছল করে ৷
:পেয়েছি অর্থ ৷
: কিছু ধার দে ৷
: অনেক অর্থ ৷
: ব্যবসা করব ৷
আকবরের উত্তরে তর্ক করে না নওশাদ,কেবল একগাল হেসে বলে, দশ টা টাকা দে পান খেয়ে আসি ৷
: পৃথিবীর বিদ্যা কি শেষ হয়ে গেল ৷
নওশাদ বলল, কেবল শুরু ৷
নওশাদ হাঁটতে থাকে রাস্তা ধরে ৷ সব জর্দা মিশ্রিত পানের দোকান এক কিলোমিটার দূরে ৷ সূর্য মাথার উপরে সাদা হয়ে আছে ৷ সূর্য বড় একা তার কোন সঙ্গী নেই,তার কোন শত্রুও নেই ৷ যার আকাশ ভরা নক্ষত্র, তার বুকে চাঁদ নেই ৷ ছোটকালের একটা কথা মনে পড়ে গেল ৷
হাতের কাছে কলম ছিল
দেখি তাতে কালি নাই
সোনার চামুচ হাতে দেখি
বাটি আছে খাবার নাই ৷
মানুষের বৈশিষ্ট্যকে নক্ষত্রে রূপ দিতে দিতে দোকানে হাজির ৷ বাজারে অনেক মানুষ ৷ হরেক রকম মানুষ ৷
পান মুখে দিয়ে বাজারের মানুষগুলোর দিকে তাকায়, সবকিছুই তার কাছে বৈচিত্র্যময় প্রাণীর মতো মনে হয় ৷
মনে উদয় হয়, হারিয়ে যাওয়া নক্ষত্র কখনো ফিরে আসে না ৷ মানুষ বড় বিচিত্র, বিচিত্র কাকের মতোই ৷
মনে ভেসে ওঠে ৷
একদিন রাত্রীবেলা আকাশের নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে থাকে ৷ আকাশ ভরা তারকা, বিচিত্র সে মায়াজাল ৷ বারোটি প্রাণীর মাঝে মানুষের সকল বৈশিষ্ট্য লিপিবদ্ধ করে নওশাদ ৷
আকবর: তাহলে মানুষ আর প্রাণী স্বভাব তো সমান হয়ে গেল ৷
নওশাদ: না
আকবর: তাহলে
নওশাদ: সূর্য, নক্ষত্র আর চন্দ্রের মতো যার স্বভাব তারা অনেক উর্ধ্বে ৷ আর প্রাণীর মতো তারা সাধারণ ৷
আকবর : তাহলে পার্থক্য কোথায়?
নওশাদ: মনুষ্যত্ব ৷
নওশাদ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে ৷ তাকিয়ে থাকে বিচ্ছিন্ন সব তারকার দিকে ৷ কোন অর্থ নেই, কোন সম্পর্ক নেই ৷ তারপরও সবাই কেমন স্থির অথচ চলমান ৷ চোখ বুঝে আসে তার ৷ সে দেখে কয়েকটি তারকা ছোটাছুটি করছে ভয়ানকভাবে ৷ একটি খসে পড়লো কক্ষপথ থেকে ৷ স্থানটি ফাঁকা হয়ে গেল ৷
নওশাদ নিজেকে আবিষ্কার করলো এক প্রাচীন মহলে ৷
সব কিছুই তার চোখে স্পষ্ট ৷ পাশে গুনগুন করে এক নারীর কণ্ঠ শুনতে পায় ৷ তার কোন চেহারা নেই, ছায়া নেই ৷
:জীবন অর্থহীন ৷ তুমি কিসের আশায় এই মহলে ৷ এখানে আসে পাগলেরা ৷
: আমি কি পাগল হয়ে গেছি ৷ এই ব্রহ্মাণ্ডের সকল সৃষ্টির কি কোন উদ্দেশ্য নেই? সঙ্গতি নেই?
: আছে ৷
নওশাদ আবার তাকায় আকাশের দিকে ৷ মনোনিবেশ করে গবেষণায় ৷ হাজার হাজার তারকার মাঝে হঠাৎই কে যেন রেখা এঁকে দেয় ৷ তৈরি হয় বিশাল নকশা ৷ তৈরি হয় এক গুঢ় রহস্য,গুঢ় অর্থ ৷ নওশাদ বুঝতে পারে, এটাই পৃথিবীর বিদ্যা, এটাই জীবনের অর্থ ৷ তার চোখ ঝলমল করে ওঠে ৷
মনে আবছা ভেসে ওঠে ৷
অনেকদিন পর নওশাদ তার সকল গবেষণার কাগজ ঝুড়িতে রেখে ঘুমে গেছে ৷ সকালে উঠে দেখে ৷ ঝুড়ি শূন্য ৷ মাথায় কোন কিছুই তার খেলে না ৷ কোথায় গেল আকবর ? আকবর ৷
তার বন্ধু রেহমান বলছে নওশাদ কি হয়েছে ৷
নওশাদ বলে, পৃথিবীর বিদ্যা ! আর কিছুই মনে নেই তার ৷ কেবল কানে বাজতেছে আকবর বলে গেছে, তুমি আর কাওকে এই বিদ্যা বলিও না ৷ মানুষ মানুষই থাক ৷ আকবর কোথায়? রেহমান বলে, কই আকবর নামে কেউ তো ছিল না ৷
নওশাদ সকালের সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে ৷ সত্যিই আকবর নামে কেউ ছিল না ৷ তার ঘুমের ঘোর কেটে গেছে ৷