ভার্চুয়াল ডায়রি- পর্ব ৩
অপরাহ্নের সামগীতি: সুদীর্ঘ বিকেলে সমুদ্র নদী আর স্কট দম্পতির গল্প
রিফাত ফাতিমা, সাউথ বেন্ড, ইন্ডিয়ানা থেকে
প্রকাশিত: ০৯:০৪ এএম, ২৫ জুন ২০২১ শুক্রবার আপডেট: ১১:১৯ এএম, ২৫ জুন ২০২১ শুক্রবার
রিফাত ফাতিমা
রিফাত ফাতিমা। এখন একজন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিক। বছর খানেকের কিছুটা বেশি সময় ধরে বাস করছেন ইন্ডিয়ানা রাজ্যের সাউথবেন্ডে। সেখানকার প্রকৃতি, জীবনাচার এসব নিয়ে নতুন বিষ্ময়ের আবিষ্কার করেই চলেছে সদ্য দেশ ছাড়া এই সংবাদকর্মীর কৌতুহলী মন। সেগুলো তিনি লিখে রাখছেন ভার্চুয়াল ডায়েরিতে। করোনা ভাইরাসের মহামারি কালে যুক্তরাষ্ট্র যে ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে তার পর আবার যে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে সেসব চাক্ষুস করছেন কিংবা জানছেন। এর সাথে মিলিয়ে দেখছেন পৃথিবীর অপরপীঠ বাংলাদেশকেও। অপরাজেয় বাংলা'র পাঠকদের জন্য আমরা তুলে আনছি লেখাগুলো রিফাত ফাতিমার ডায়রি থেকে। যার তিনি নাম দিয়েছেন অপরাহ্নের সামগীতি।
সুদীর্ঘ বিকেলে সমুদ্র নদী আর স্কট দম্পতির গল্প
প্রতি শুক্রবারেই আমার মন ছুটি ছুটি করতে থাকে। আসলে ছুটি তো শনি, রবিবার। এই সপ্তাহান্তে বাচ্চাদের ধরে-বেঁধে আমাদের শহর থেকে একঘন্টা দূরত্বের একটা বিচে গিয়েছিলাম। বসে বসে সমুদ্রের ঢেউ ভাঙার শব্দ শুনতে শুনতে বই পড়ার মত আরাম আর আনন্দের কিছু নেই জগতে। মাথার উপর খোলা উদাত্ত আকাশের চাঁদোয়া, তাতে ধবধবে সাদা গাঙচিল কেবলি পাক খেয়ে খেয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। ধীরে ধীরে মানুষের ভীড় বাড়লে আমরা ফিরে আসি। মনে পড়ে পেনাং থাকতে প্রায়ই ছুটির দিনে এসপ্লানেডে যেতাম, পাশেই সমুদ্র, পাথুরে তীরে কাঁকড়াদের ছুটোছুটি দেখতে দেখতে ছোট্ট মন্ময় উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করত,‘‘দেখো বাবা, উইরে এত্তা সেবাস্টিয়ান।” আবার ওয়েট মার্কেটে মাছ কিনতে গেলে যদি ডালায় সাজানো কাঁকড়া দেখতো, হাউমাউ করে কাঁদত-‘‘আমার সেবাস্টিয়ানকে মেরে ফেলল।’’একবার আমরা লঙ্কাউয়ি গিয়েছিলাম। সাথে আমার বড়মামা ও ছোটবোন নিশাত। পেন্টাই চেনাং বিচে সমুদ্রে নামব, এমন সময় মন্ময় আমার মামাকে হুঁশিয়ারি দিল, ‘‘নানাভাইইই, ওদিকে যেওনা, ওদিকে শরম পোশাক।’’ মানে সে সাঁতারের পোশাকে নানাবর্ণের নরনারী দেখেছে তাই ওর ওই হুঁশিয়ারি।
এখনকার বিকেলগুলো সুদীর্ঘ। ব্যাটেল পার্কে হাঁটতে গেলে দেখা যায় কিশোর বয়সী হাঁসের ছানাপোনা। নদীর ধার ঘেঁষে পড়ে আছে তাদের ঝেড়ে ফেলা নরম পালক, কখনো বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে। সেন্ট জো’র শান্ত পানিতে মাছ ধরছে শৌখিন মৎসশিকারি। হাওয়ার্ড পার্কের লাগোয়া অংশে মনে হল নদীর গভীরতা বেশি। আর নদীর ধারের শ্যাওলা ও দামের মধ্যে ছোট ছোট মাছের পোনা, হঠাৎ দেখলাম দুটো বড় বড় মাছ। খানিকটা ট্রাউট মাছের মত মত মনে হল, শান্তিপূর্ণভাবে পরস্পরকে অতিক্রম করে গেল। ওপারের ঘরবাড়ির প্রতিবিম্ব পড়ছে নদীতে। সকালের তেতে উঠা রোদে বেগুনী, সাদা ও হলুদ ছোট ছোট ফুলেরা দোল খাচ্ছে। তাহিয়া স্যাট পরীক্ষা দিচ্ছিল সেন্ট জোসেফ হাই স্কুলে, মেয়েকে নিয়ে ঘরে ফিরি।
মঙ্গলবার (২২ জুন) হোয়াইট হাউস স্বীকার করেছে যে, জুলাইয়ের ৪ তারিখ নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ৭০ শতাংশ অন্তত প্রথম ডোজ কোভিড টিকা পাবে বলে যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের, সে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না। ওই সময়ের মধ্যে কেবল ২৭ বছর ও তদূর্ধ্ব নাগরিকেরা টিকা পাবেন।
নিউইয়র্ক টাইমসের বিশ্লেষণ দেখাচ্ছে, বর্তমানে এক সপ্তাহে যে হারে প্রাপ্ত বয়স্কদের টিকা দেওয়া হচ্ছে তাতে করে শতকরা ৬৭ শতাংশ মানুষ আংশিকভাবে টিকা গ্রহণ করবে। হোয়াইট হাউজের প্যানডেমিক রেসপন্স কোঅর্ডিনেটর জেফ্রি ডি জিয়েন্টস এটাকে তেমন গুরুত্ব না দিয়ে এক সংবাদ ব্রিফিং এ বলেছেন, ‘‘কোভিডের বিরুদ্ধে আমরা একটা অপ্রতিদ্বন্দী নতুন ধরনের জাতীয় টিকাদান কর্মসূচি শুরু করেছিলাম। এটা একটা উল্লেখযোগ্য অর্জন।’’
সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে কোভিডে নতুন আক্রান্ত, হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যু উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। এই সোমবারের পরিসংখ্যান দেখাচ্ছিলো- গত এক সপ্তাহ জুড়ে দিনে গড় আক্রান্তের হার ছিল ১১ হাজার ২’শত তেতাল্লিশ জন। যা গত দু’সপ্তাহের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ কম।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা সাবধান করছেন এই বলে যে, টিকা নেওয়ার হার কমে যাওয়ার কারণে আগামী শীতে যখন মানুষ ঘরবন্দী হবে তখন নতুন করে করোনার প্রকোপ বাড়ার আশঙ্কা। এবং যেখানকার মানুষ টিকা দিয়ে নিজেদের সুরক্ষিত করেনি এমন এলাকাগুলোতে প্রতিদিন মৃত্যুহার বেড়ে যেতে পারে।
ভারতে সোমবার ৮ দশমিক ৬ মিলিয়ন টিকা দেওয়া হয়েছে। চীন ব্যতীত ভারতই একমাত্র দেশ যেটি এক দিনে এত বেশি সংখ্যক টিকা দেওয়ার রেকর্ড করলো। নতুন করে নেওয়া এক নীতিতে সকল প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ফ্রি টিকা দেওয়ার প্রথম দিনে এই রেকর্ড গড়লো ভারত। তবে এই হার সম্ভবত সাময়িক হবে কারন সরবরাহ অনুযায়ী আগামী সপ্তাহগুলোতে এত বেশি সংখ্যক টিকা দেওয়া যাবে না।
আগেই বলেছি গরমের এই বিকেলগুলো সুদীর্ঘ। এরকম এক বিকেলে ডিনারের দাওয়াতে গিয়েছিলাম ফাহমিদের কলিগ কারেন ও স্কট দম্পতির নাইলসের বাসভবনে। পাঁচ একর জুড়ে ঘন অরণ্যে ঘেরা তাদের বাড়ি। সামনের বারান্দায় সাজানো রংবেরংয়ের পিটুনিয়া। ডিনার শেষে লাল টুকটুকে জিপে করে এলম ও ওক গাছের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে আমাদের নিয়ে গেল নদীর তীরে। পথটা যেনো সোজা নদীতে গিয়ে মিশেছে। আমি ভয় পেয়ে বললাম, ‘‘স্কট, প্লিজ! নদীর উপর দিয়ে জিপ চালিয়ে দিও না।” হাসির হুল্লোড় উঠল।
ফেরার পথে দেখি গাছে মোটা দড়ির দোলনা ঝুলিয়ে রেখেছে, বড় বড় পাথরও সাজানো। দোলনা নাতি নাতনির জন্য, যদিও তারা কেবল বসতে শিখেছে। মোবাইলে আমাদের ছবি দেখালো। আর পাথর সাজানো হয়েছে যদি তাদের মেয়ে এসে শখ করে বাইরে রান্না করে সেজন্য। পাশেই গ্যারেজে যাবতীয় আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত বিশাল ঝা চকচকে ক্যাম্পার। স্কট বলল,‘‘মানুষ জিমে গিয়ে টাকা খরচ করে ব্যায়াম করে, আর আমি সারাদিন কাজ করি, আমার জিমে যাবার খরচ বেঁচে যায়।"
আরও বললো, "আমি ভাবতেও পারি না বুড়ো বয়সে আমি নার্সিং হোমে আছি একা একা। কোভিড নিয়েও ভাবতে চাই না, তাই এ সংক্রান্ত খবর পড়ি না।’’
আমি বললাম, ‘‘তুমি এখনও অনেক তরুণ। জীবন উপভোগ কর।’’ স্কট প্রগাঢ় চোখে তার স্ত্রীর দিকে তাকাল। কারেনও সলজ্জ চোখে তার দিকে তাকাল।
আমি চিৎকার করলাম,‘‘লুক কারেন! হিজ আইজ আর নটোরিয়াস।’’
‘‘আই নো’’, কারেনের স্মিত জবাব।
আবার কখনো দেখা হবে এই আশ্বাসে বিদায় নিলাম আমরা। বাইরে তখন পাইন গাছের চূড়ায় চূড়ায় সূর্য তার রক্তাভ তুলির শেষ আচড় টেনে চলেছে।
চলবে
পর্ব-২: ইদ, মা, বাইডেন, নোয়াহ ও পত্রপল্লবের গল্প
রিফাত ফাতিমা
২৩ জুন, ২০২১, সাউথ বেন্ড, ইন্ডিয়ানা, যুক্তরাষ্ট্র।