বাবাহীন অব্যাখ্যেয় কষ্টের পৃথিবী
কবির য়াহমদ, সাংবাদিক ও লেখক
প্রকাশিত: ০৫:৫৭ পিএম, ২০ জুন ২০২১ রোববার আপডেট: ০৬:১১ পিএম, ২০ জুন ২০২১ রোববার
কবির য়াহমদ
একটা প্রকাণ্ড বটবৃক্ষ ছিলেন আমার বাবা। জীবদ্দশায় এতটা টের পাইনি। তাঁর মৃত্যুর পর যত দিন যাচ্ছে তত বেশি করে অনুভব করছি। বুঝতে পারছি মাথার ওপর ছায়া দেওয়ার মত আকাশটা আর নেই। তাই প্রবল রোদে পুড়ে যাচ্ছি, তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়ে পড়ছি। শীত নেই, বর্ষা নেই, ঋতুভেদে প্রকৃতির পরিবর্তনগুলো বিবিধ চাপে আগের মত আর অনুভব করতে পারি না। একটা দুঃসহ কাল অতিবাহিত করছি, নীড়ে থেকেও আশ্রয়হীন। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আছে বলে ভেবে বসে থাকা আমিও অনেক ক্ষেত্রে পড়ছি গোলকধাঁধার ঘূর্ণনে।
২০১৯ সালের জুন। ক্যালেন্ডারের হিসাবে দিনটা ছিল শুক্রবার, ১৪ তারিখ। বিকালে আমার বাবা যাকে আমরা ‘আব্বা’ বলে ডাকতাম তিনি শেষ ঘুমে মগ্ন হয়েছিলেন। শেষ ঘুমের আগে প্রকৃতির নিয়মে জাগতিক অনেক ঘুমে যেতেন তিনি। আমরা কেউ জানতাম না সেদিনের সেই ঘুম ছিল তাঁর শেষ ঘুম। আগের দিন থেকেই তীব্র জ্বর ছিল তাঁর। খানিক বিরতি দিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন, জেগেও ওঠছিলেন। কিন্তু শুক্রবারের দুপুরের পর থেকে যে ঘুমে মেতেছিলেন তার পর থেকে আর জাগেননি। এই ঘুমের সময়েই তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছিলেন। বারবার তাঁর শরীরের তাপমাত্রা মাপতে এসে একটা সময়ে টের পেলাম সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তাঁর। জাগাতে চেয়েও পারিনি। শেষমেশ যখন তীব্র ঠান্ডা জমেছিল তাঁর শরীরে তখন পায়ের তলার মাটিগুলো সরে গিয়েছিল আমার, আমাদের।
বাবাহীন হতে পারি আমরাও- এমন ভাবনা তাঁর অসুস্থ হওয়ার ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়লেও বিপদ ভেবে সেটা দূরে সরিয়ে রাখছিলাম। কেন আমরা বাবা-হারা হবো; আমাদের কী বাবার আশ্রয়ের দরকার নেই- এমন ভাবনায় তাঁর কাছাকাছি থেকেছিলাম শেষ কবছর। এর মধ্যিখানে কোথাও জরুরি প্রয়োজনে গেলেও তিনি ফোন দিয়ে ‘কখন ঘরে ফিরছি’ এমনটা জানতে চাইতেন বারবার। সন্ধ্যা হলেই এমন হতো নিয়মিত। ফিরে এসে খোঁজ করার কারণ জানতে চাইলে প্রতিবারই বলতেন- ‘ঘরে থাকলে ভরসা পাই, মনে শক্তি পাই’। প্রথম প্রথম একথাগুলোর গুরুত্ব বুঝতে না পারলেও একটা সময়ে বুঝতে পারি কতটা ভরসা আর ভালোবাসা থাকলে এমন প্রশ্ন, কাছে রাখার এমন আকুতি ঝরত তাঁর। স্বজনদের কাছ থেকে শুনেছি এবং ছেলেবেলার যতটুকু মনে পড়ে আব্বা আমাকে ‘অন্ধের যষ্টি’ বলে ডাকতেন। এ কারণেই বুঝি সেই ছোটকালের যে স্বপ্ন বড়কালেও এসে সেটার ছাপ রয়ে গিয়েছিল পুরোটাই, যদিও জানি অন্ধের যষ্টি হওয়ার মত যোগ্যতা অর্জন করতে পারিনি আমি।
আব্বা একাধিকবার স্ট্রোক করেছিলেন, হাই ব্লাড প্রেসার ছিল, কোলেস্টেরল সমস্যা ছিল, হার্টে রিঙ পরানো ছিল তাঁর। শেষ সময়ে এসে মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর আগে থেকে কিডনিজনিত রোগ ছিল। ওটাই ভুগিয়েছে তাঁকে। ঢাকায়-সিলেটে একাধিকবার তাঁর কিডনি ডায়ালাইসিস করতে হয়েছিল। শেষবার যখন হাসপাতালে ছিলেন তখন ১০ দিনের বেশি সময় ছিলেন আইসিইউতে। আইসিইউতে থাকাকালে ওই ইউনিটে সবসময় ঢোকা যেত না, বাইরে পায়চারি করতাম। রাতের পর রাত ঘুমহীন থেকে তাঁর সামান্য চোখ মেলার অপেক্ষা করতাম। সামান্য নড়লেচড়লে মনে হতো প্রাণ ফিরেছে আমারও দেহে। আইসিইউ থেকে কেবিনে নেওয়ার পর সামনাসামনি থাকার সুযোগ হয়েছিল। অসুস্থ তবু মনে শান্তি ফিরত, সামনে ত আছেনই। এরপর বাড়িতে নিয়ে আসার সময়ে মনে হচ্ছিল যেন যুদ্ধজয় করে ফিরছি। তাঁর চিকিৎসাকালে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের করার কিছু ছিল না, কিন্তু ফিরিয়ে নিয়ে আসার সময়ে সত্যি সত্যি যুদ্ধজয়ের সেনাপতি ভাবছিলাম। এভাবে কয়েকবার, বেশ কয়েকবার। প্রতিবারই একই অনুভূতি হতো।
আব্বাকে প্রতিদিন একগাদা ওষুধ খেতে হতো। ডা. ফয়সল আহমদ, ডা. নাজমুস সাকিব, ডা. আবদুল লতিফ রেণুসহ অনেক চিকিৎসক আব্বাকে চিকিৎসা দিয়েছেন। বিভিন্ন সময় হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসার পর যখনই দরকার পড়েছে চিকিৎসকবন্ধু এনামুল হক এনাম, ডা. আলিম আল রাজি, ডা. সুমন দে, ডা. জোবায়ের আহমেদদের কাছে নানা পরামর্শ পেয়েছি। তাদের কারণে মনে হতো আমার আব্বা পুরোটা সময়ই আছেন চিকিৎসকের পরামর্শাধীন। তাদের সকলের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নাই।
আমার আব্বার সঙ্গে আমার ছেলে রাইআনের দুরন্ত সম্পর্ক ছিল। কিডনি রোগ তাই টক জাতীয় কিছু খেতে ডাক্তারের বারণ ছিল। তবু মাঝে মাঝে দেখতাম আব্বা আর রাইআন দুজনে মিলে আমের আচার, বরইয়ের আচারসহ বিবিধ আচার খাচ্ছেন। দাদা-নাতির এই আচার খাওয়ার সময়টাতে অনেকবার বাধা দিয়েছি মূলত চিকিৎসকের পরামর্শের কারণে। আব্বা রাইআনকে ‘দাদা’ সম্বোধনে ডাকতেন। রাইআন যখন খুব ছোট ছিল তখন তার সামান্য কান্নাতে আব্বা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তেন। রাইআনের খাবারদাবারের সমস্যা হচ্ছে কি না এনিয়ে সতর্ক দৃষ্টি ছিল তাঁর। রাইআনের দুধসহ খাবারদাবারের টাকাগুলো আব্বাই দিতেন। সময়ে সময়ে জিজ্ঞেস করতেন তার কিছুর দরকার কি না, আবার সামান্য অথচ বাচ্চাদের স্বাভাবিক কান্নাকাটিতেও ভাবতেন তার বুঝি খাবারদাবারের সঙ্কট! স্কুলে ভর্তির টাকা তিনিই দিয়েছিলেন। রাইআন-আয়ানের মাসে-মাসে স্কুলের বেতনের টাকা তিনিই দিতেন। এত বেশি কেয়ারিং ছিলেন তাদের প্রতি।
আব্বা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, বঙ্গবন্ধুর সময়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন, ছিলেন সাবেক জনপ্রতিনিধি। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-মসজিদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল তাঁর। ছিলেন সালিশ ব্যক্তিত্ব। নিজেদের উপজেলাসহ আশপাশের এলাকার মাঝেও পরিচিত ছিলেন তিনি। যেকোনো প্রয়োজনে এলাকায় কিংবা দূরে কোথাও গেলেও মুরুব্বিদের কারও সঙ্গে দেখা হলে এলাকার নাম বললে স্বাভাবিক প্রশ্ন ছিল- ‘আজিজ উদ্দিন চৌধুরী ভাইস চেয়ারম্যান সাহেবের কিছু হই কি না?’ পরিচয় দেওয়ার পর বিভিন্ন এলাকার মানুষদের কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছি সেটা ভুলার মত নয়। এগুলো আদতে অর্জন। আব্বা নেই আজ দুই বছরের বেশি সময় হয়ে গেছে, অথচ সেই একই পরিচিতি, একই ভালোবাসা আমরা পেয়ে যাচ্ছি। এগুলো দেখে মনে হয় আব্বা দৈহিকভাবে হয়ত নেই কিন্তু তাঁর পরিচিতি এখনও রয়ে গেছে। এগুলো দেখে একদিকে গর্ব হয়, আবার অন্যদিকে নিজেকে পিতৃহীন ভেবে বুকটা হাহাকার করে ওঠে! এই হাহাকারের যন্ত্রণা যে কতটা ভারী সেটা ঠিক ঠিক টের পাই; আমি নিশ্চিত জগতের অধিকাংশ পিতৃহীনেরাই টের পায়।
আজ বাবা দিবস। দেশে দেশে আছে এর দিবসী আয়োজনও। দিবসী এসব আয়োজন নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে যত মত-প্রতিমতই থাকুক না কেন ‘বাবা’ শব্দটাই স্বতন্ত্র আবেগের, নির্ভরতা আর আশ্রয়ের। ২০১৯ সালের ১৪ জুন আমার বাবা, আমার আব্বাকে হারিয়ে আমি এবং আমরা যে নির্ভরতা আর আশ্রয় হারিয়েছি সেটা অব্যাখ্যেয়। অনেক কিছু থাকা আমাদের ঘরে বাবা নেই- এরচেয়ে কষ্টের আর কিছু থাকতে পারে না!