শহরাঞ্চলে করোনার বেশি ভয় কেন হয়?
শেখ আনোয়ার
প্রকাশিত: ০৬:০৯ পিএম, ৯ জুন ২০২১ বুধবার আপডেট: ০৬:১০ পিএম, ৯ জুন ২০২১ বুধবার
করোনাভাইরাসের দাপটে গোটা দুনিয়ায় সৃষ্টি হয়েছে আতঙ্কের পরিবেশ। সৃষ্টি হয়েছে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাসের বাতাবরণ ও সামাজিক উৎকণ্ঠা। এর প্রভাব পড়েছে অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে। ভ্যাকসিন? ওটা শতভাগ সুরক্ষাও দেয় না। যতো দিন যাচ্ছে, সংক্রমিতের সংখ্যাও হু হু করে বাড়ছে। বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। রাষ্ট্রপ্রধানরা তাদের সবটুকু দিয়ে জীবনসংহারি এই ভাইরাসকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তবুও করোনা মোকাবেলার প্রস্তুতি নিয়ে শঙ্কা কাটছে না।
গবেষণায় দেখা যায়- ‘যে সব দেশ যতো উন্নত, যে সব দেশে শিল্পাঞ্চল, শহরাঞ্চল বেশি, রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যখাতে যে দেশের ব্যয় যতো বেশি, সে সব দেশেই করোনা সংক্রমণের সংখ্যাটা বেশি। মৃত্যুর হারও বেশি।’ করোনার আতুড় ঘর চীনের উহানের কথাই ধরা যাক। আধুনিক শিল্প শহর, ঘিঞ্চি নগর চীনের এই উহান। আবার দেখা যায়, ইউরোপ বা আমেরিকার অনেক উন্নত ও অতিরিক্ত আধুনিক শহরের দেশগুলোর বিপুল সংখ্যক মানুষ সংক্রমিত? তুলনায় কম উন্নত দেশগুলোতে আক্রান্ত ও মৃত্যু অনেক কম। তাই প্রশ্ন উঠেছে, শহরাঞ্চলের আদর্শিক মাত্রার সঙ্গে করোনা সংক্রমণের কোনও কার্যকারণ সম্পর্ক রয়েছে কি? ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন-এর অধ্যাপক জন কেটস অল্প কথায় বলেন, ‘অর্থনৈতিক উন্নয়নের গোপন মূল্য মানুষ দিতে শুরু করেছে মাত্র। অভিশাপ পূর্বপুরুষের।’
করোনা সংক্রমণের পরিসংখ্যান লক্ষ্য করলে দেখা যায়, শহরাঞ্চল কিংবা তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল, নগরায়ণের মাত্রা যেখানে যেখানে বেশি, সে সকল এলাকায় সংক্রমণের প্রভাব বেশি। গত বছর বাংলাদেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ ছিলো ঢাকায়। পরে যুক্ত হয় নারায়ণগঞ্জের নাম। এরপরই শুরু হয় ঢাকার বাইরে সংক্রমণ। এমন অবস্থায় সামনে আসছে নতুন আলোচনা প্রসঙ্গ। ‘শহরকে শুধুমাত্র বাজারের দৃষ্টিতে না দেখে এর সামাজিক, মানবিক ও দীর্ঘস্থায়িত্বের প্রসঙ্গ সামনে আসছে। প্রকৃতি ও পরিবেশকে সুরক্ষিত রেখে ভারসাম্যমূলক উন্নয়নের ভাবনা এসেছে। যেমনটা করেছে অস্ট্রেলিয়া। তাই পুঁজিবাদী পশ্চিমা দুনিয়ার উন্নয়ন ও শহরায়ণকে অন্ধভাবে অনুসরণ করার বিষয়টাও প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। গবেষকরা বলেন, ‘অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশ নিজস্ব ঐতিহ্যকে স্মরণে না রেখে, দেশের আর্থসামাজিক বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ না করে, শুধুমাত্র জোর দিচ্ছে উন্নয়নের গতির ওপর।’ গবেষকরা বলেন, ‘এ মুহুর্তে সবচাইতে বেশি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন পুঁজিবাদী অর্থনীতির ভবিষ্যৎ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের কাছে পুঁজিবাদী অর্থনীতি এখন অভিযুক্ত। এই গতি বৃদ্ধি করতেই চলছে প্রাকৃতিক সম্পদের নির্বিচার ব্যবহার ও লুট। এতে অবহেলিত হচ্ছে পরিবেশ। ধ্বংস হচ্ছে বণাঞ্চল, গ্রাম ও সামাজিক দীর্ঘস্থায়িত্ব। এই গতি বৃদ্ধির একটি চমকপ্রদ তথ্য হলো, ১৯৭১ সালে বিশ্বে ৩০ কোটি মানুষ বিমানে ভ্রমণ করেছিলো। বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ৪৫০ কোটি।’
একথা কে না জানে, আমেরিকা বা ইউরোপের দেশগুলোতে অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে যেমন শিল্পায়নের সূত্রপাত ঘটে, তেমনই একে কেন্দ্র করে শহরাঞ্চল প্রসারিত হতে শুরু করে। উৎপাদনভিত্তিক শিল্পকে কেন্দ্র করে যে রোজগার শুরু হয়, সেই সময় তার ইতিবাচক ভূমিকা ছিল। বিশেষ করে সেই শিল্পোৎপাদন ব্যবস্থা কৃষির উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তিকে যুক্ত করতে পেরেছিলো। যার ভারসাম্যমূলক প্রভাব পড়ে কৃষি ও শিল্পের উভয়ক্ষেত্রেই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বহু দেশে পুঁজিবাদী নগরায়ণের সূত্রপাত হয়। আবার সোভিয়েত রাশিয়ায় শুরু হয় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় শহর গড়ে তোলার কাজ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বহু দেশে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হয়। তেমনই বহু সদ্য স্বাধীন দেশ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে শিল্পায়ন শুরু করে। একবিংশ শতাব্দীর পুঁজিবাদ কিন্তু নব্য উদারীকরণ আর্থিক নীতিকে ভিত্তি করে বিকশিত হয়েছে। এই অর্থনীতির পরিণতিতে যে কোনও উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশে মোট গার্হস্থ্য উৎপাদনে কমছে উৎপাদনভিত্তিক শিল্প ও কৃষির অবদান। বৃদ্ধি পাচ্ছে পরিসেবা বা টার্শিয়ারি ক্ষেত্র।
বাজার অর্থনীতিভিত্তিক নগরায়ণ প্রক্রিয়ায় শহরগুলো প্রসারিত হচ্ছে বাজারিকরণ বা পণ্যায়নের মাধ্যমে। যাতে স্বল্পসংখ্যক মানুষের হাতে আর্থিক ক্ষমতা ও সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। কোনও কোনও অর্থনীতিবিদ একে রেনসিকিং বলে থাকেন। পুঞ্জীভূত হচ্ছে গ্রিন হাউস গ্যাস। এর প্রভাবে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। উন্নত দেশগুলোর এই অতি উৎপাদন, অতিরিক্ত বিলাসবহুল জীবনযাপন, ব্যক্তিগত যানবাহন ব্যবহার, খাদ্যাভ্যাস বদল, বসবাস, জীবনযাত্রার পদ্ধতির পরিবর্তন, ভূমি বা ভূপৃষ্ঠের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, জীবাশ্ম জ্বালানি ও শক্তি নির্ভরতা, প্রকৃতি ও পরিবেশকে করে তুলছে অসুরক্ষিত। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, ‘বন্য জীবজগতে মানুষের অপরিণামদর্শী দখলদারির জন্য অন্য প্রজাতির শরীরস্থিত অণুজীবরা ক্রমশ লাফিয়ে মানব প্রজাতির উপর আশ্রয় করছে। ফলে অভিযোজিত ও অভিব্যক্তিজনিত নিত্যনতুন ভাইরাসকে প্রতিহত করতে পারছে না মানবসমাজ। বাড়ছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সংখ্যা ও মাত্রা। করোনা তেমন এক রোগের নাম। যার বেশি প্রভাব পড়েছে শহরাঞ্চলের মানুষের দেহে।’
একবিংশ শতাব্দী- বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, উন্নয়ন, আধুনিক শহর সভ্যতার শতক। এই সময়ে শরীর বিজ্ঞানের প্রভূত অগ্রগতি হয়েছে। এরপরও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে স্বাস্থ্যখাতের সুবিধা কম। পক্ষান্তরে উন্নত দেশে স্বাস্থ্যখাতে সুবিধা বেশি হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বজুড়ে দেখা যায়, করোনার মতো বহু রোগ শহর কেন্দ্রিক হচ্ছে। পুঁজিবাদী কাঠামোতে এই শহর এখন করোনা মহামারির সামনে বেসামাল। গবেষকরা বলেন, ‘উন্নত দেশগুলো বেশি নগরায়ণের ফলে করোনায় তুলনামূলক বেশি সংক্রমিত হয়েছে’। অনেক গবেষকের মতামত- ‘যদিও এই সিদ্ধান্ত আসলে সরলীকৃত ও একপেশে। এর জন্য শুধু নগরায়ণকে দায়ী করে লাভ হবে না। আসল কারণ নিহিত রয়েছে নগরায়ণ প্রক্রিয়ার অপরিণামদর্শী পদ্ধতিগত ত্রুটির মধ্যে। অর্থাৎ ত্রুটিপূর্ণ নগরায়ণের ফলশ্রুতিতে করোনাভাইরাস।’ তাই স্বাস্থ্য সুবিধা বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধের পাশাপাশি, শহরাঞ্চলের উন্নয়ন প্রক্রিয়ার পদ্ধতিগত ত্রুটি-বিচ্যুতি শুধরে নেয়ার উদ্যোগ আগামীদিনের স্বার্থে বর্তমান সময়ে অত্যন্ত জরুরি। মনে রাখতে হবে, শহর বর্তমান শতকের অনিবার্য প্রক্রিয়া। এর থেকে পালানোর পথ নেই। তাই সার্বিক অংশগ্রহণমূলক, বিকেন্দ্রীকৃত, পরিবেশবান্ধব উপাদানের সমন্বয়ে শহর তৈরি প্রক্রিয়া, যা শুধুমাত্র বাজারতাড়িত, লোভ ও লাভের একচ্ছত্র আধিপত্য দ্বারা নির্ধারিত হবে না, এমন ব্যবস্থা নিয়ে আলাপ-আলোচনার এখন আদর্শ সময় বৈকি!
বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, বিশেষ করে বর্তমান শতাব্দীর প্রথম থেকে বিশ্বে শহরাঞ্চল তৈরি ও উন্নয়নের নীতিমালা বিষয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে বহু আলোচনা বা শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষ করে দ্রæত শহর সভ্যতাকে ভারসাম্যমূলক করার বিষয়টি প্রাধান্য পেতে শুরু করে। এরই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের রিও শহরে ধরিত্রি সম্মেলনে টেকসই বা স্থিতিশীল উন্নয়নের কথা ঘোষিত হয়। তারপর থেকে চীন তার বাস্তুতান্ত্রিক সভ্যতার মধ্য দিয়ে একুশ শতকের আধুনিক পরিবেশবান্ধব শহর সভ্যতার উন্নয়নের পথে এগোনোর চেষ্টা চালায়। উদ্দেশ্য হলো, শুধু বর্তমানের স্বার্থে নয়, ভবিষ্যতের লক্ষ্যে শহরাঞ্চলের উন্নয়ন। চীন তার দেশের নিয়ন্ত্রণহীন শহর অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্যোগ নিয়েছে।
পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে সবচেয়ে দ্রুত ও বেশি হারে শহর সভ্যতা গড়ে উঠছে। শহরগুলোও অনেকাংশেই অপরিকল্পিত এবং বাজার অভিমুখী। গ্রামীণ অবকাঠামোর ভিতরে ঢুকে পড়েছে শহরাঞ্চলের ছোঁয়া। শিল্প বিপ্লবের কারণে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে দ্রুত গতিতে নতুন নতুন শিল্পস্থাপনা সৃষ্টি হচ্ছে। শহরের চৌহদ্দী প্রসারিত হচ্ছে। শহর লাগোয়া অঞ্চলে বৃদ্ধি পাচ্ছে জনবসতির ঘনত্ব- বস্তি এলাকা। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, নগরায়ণ এবং মানুষের ঘনত্বের কারণে শহরের পার্শ্ববর্তী প্রকৃতি অনেকটা মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছে। পরিবেশ, প্রতিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে। চরম প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীতায় ভুগছে মানুষ।
পরিবেশ দূষণ আর নয়। করোনাভাইরাস সংক্রমণের পরিস্থিতিতে আমাদের আয়নার সামনে দাঁড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, মানুষের প্রয়োজনে শিল্প। শিল্পের প্রয়োজনে মানুষ নয়। মানুষের জীবনমান অক্ষুন্ন রেখে শিল্পকে ঢেলে সাজালে মানব সভ্যতা টিকে থাকবে। শিল্পের কারণে মানুষের জীবন হুমকির মধ্যে পড়ে গেলে মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হবে। বাংলাদেশের শহরের পরিকল্পিত আধুনিকায়ন প্রয়োজন। শহরে কিংবা গ্রামে অপরিকল্পিতভাবে একটি বাড়িও যেনো নির্মাণ করা না হয়, সেদিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া দরকার। স্থানীয় সরকার এবং প্রশাসনের সহযোগিতায় গ্রামের নির্দিষ্ট স্থানে সুন্দর নিরাপদ বাসস্থান গড়ে উঠুক। পরিকল্পিতভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং উপাসনালয়গুলো স্থাপিত হোক। সেজন্য বিপুল পরিমাণ অর্থের চেয়ে সদিচ্ছা বেশি জরুরি।
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।