ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
ওমর, দ্য টেন্টমেকার ।। অনুবাদ: কবির চান্দ ।। মূল: নাথান হাসকেল [কিস্তি-দশ]
কবির চান্দ, লেখক ও অনুবাদক
প্রকাশিত: ০৯:৫৬ এএম, ৯ জুন ২০২১ বুধবার আপডেট: ১১:৩৮ এএম, ৯ জুন ২০২১ বুধবার
কিস্তি-১০ প্রমোদের ফাঁকে ফাঁকে কাজের আলাপ
এরই মধ্যে জোহরের নামাজের সময় চলে এল। তিন বন্ধু পানোন্মত্ত হয়ে যাননি। ওমর যদিও সুরার গুণ গেয়ে ধর্মাচারবিরোধী চতুষ্পদী লিখেছেন, তিনি অত্যন্ত মিতাচারী ছিলেন। যে-কোনো বিলাসিতার আতিশয্য যে ক্ষতিকর, তা তিনি জানতেন। নিষিদ্ধ বলেই হয়তো তিনি এতে বেশি আনন্দ পেতেন, কিন্ত নিজের স্বাধীনতার অপব্যয় করতেও তিনি রাজি ছিলেন না।
তিন বন্ধু, তাদেরকে তো বন্ধু বলাই যায়, নিষ্ক্রিয়তার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলেন। নামাজ পড়ার পর তারা বাগানের সুবাসিত পথ ধরে পায়চারি করতে বেরুলেন। যেতে যেতে সুলতান বললেন:
“মাঝে মাঝে কাজ থেকে ছুটি ও আরাম করা শরীর ও মন উভয়ের জন্য ভালো। আমরা তা করেছি, সকালটা আমাদের মোটামুটি বিনা কাজেই গেছে। আমাকে এখন অনেক বিষয়ে চিন্তা ও পরামর্শ করতে হবে। প্রথমেই হাসান বিন সাবাহকে নিয়ে কথা বলা যাক।”
অবশ্য, তার বিষয়ে কিছু বলা শুরু না করে সুলতান একটু থামলেন। নিচের নদীর দিকে তাকালেন। নদীটা এখানে কিছুটা প্রশস্ততর, এবং দুপাড়ে ঝাউগাছে ভর্তি। কয়েকজন বালক কাঠের ভেলা বানিয়ে খেলা করছিল। দুজন বালক ভেলায় চড়ে বৈঠা বেয়ে মাঝনদীর স্বচ্ছ পানিতে যাবার চেষ্টা করছিল। অন্যরা তীরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে তাদেরকে উৎসাহিত করছিল। বাতাসে তাদের আনন্দের হুল্লোড় ভেসে আসছিল। অনেক দূরে পাহাড়গুলো তাঁদের খাঁজকাটা চূড়া তুলে দাঁড়ানো। নিচের সমতল জুড়ে নানান ধরনের অগণিত কারখানা গড়ে উঠেছে। এমন সমৃদ্ধি দেখে সুলতানের মনে একটা ভাবনা এল। ইরানিদের একটা প্রাচীন নাম ছিল কিজিল বাশ বা লাল মাথা। সে নামে সম্বোধন করে তিনি ওমরকে বললেন,
“আপনারা, লালমাথারা, উন্নত ও সুখী জাতি। এই জনপদে কয়টি জলের ধারা ও খাল আছে বলতে পারেন?”
“এখানে বারো হাজার নালা আছে, আর আছে বারোটি বড় প্রবাহ। অনেকগুলো জলাধারও আছে, যেগুলো খরার সময়ে পানির অভাব দূর করে। সুলতান যদি তার মহান চক্ষুদ্বয় সামনে প্রসারিত করেন তাহলে বিভিন্ন দিকে গম্বুজ দেখতে পাবেন। এগুলো ঐসব জলাধারকে ঢেকে রেখেছে। উন্নত সেচপ্রণালীর কারণেই ভূমি এতটা উর্বর, আর গ্রীষ্মকালের আবহাওয়া এতটা মনোরম।”
ওমর তার প্রখর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বুঝতে পারছিলেন সুলতানের প্রশ্নমালা কীসের ইঙ্গিত করছে। কর আরও বাড়তে পারে এ আশঙ্কার সঙ্গে তার নিজের দূরতম সংযোগের চিন্তাও তাকে দুঃখিত করল।
“এর আগে হাসান বিন সাবার কথা বলছিলাম, সে একজন মনে ধরার মতই লোক বটে। গত সন্ধ্যায় আমি তাকে ডেকেছিলাম। নানা বিষয়ে তার জ্ঞান অত্যন্ত গভীর এবং নির্ভুল। নিজের সম্পর্কে এবং নিজের দক্ষতা সম্পর্কে তার ধারণাও খুব উঁচু। আলাপ শুরু হতে না হতেই সে বলছিল যে নিশাপুর অত্যন্ত বিশাল এবং বর্ধিষ্ণু নগর, কিন্তু রাজকোষাগারে খুব সামান্য কর দেয়। আপনার কী মত, হে নিজাম-উল-মুলক? সব বিষয়ে তো আপনিই দেখাশোনা করেন।”
“সৌভাগ্যক্রমে নিশাপুরে সাম্প্রতিককালে বাইরের কোনো আক্রমণ ঘটেনি,” উজির বললেন। “একসময় এর অনেক দুর্দশা গেছে। কিন্তু এর অবস্থানটা ভালো, এবং যে ক্ষতই ঘটুক না কেন শীঘ্রই তা উপশম করে ফেলতে পারে। এই টিলাটা থেকে দেখে মনে হয় যেন শহরটা যুগ যুগ ধরে এভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু বছর পঞ্চাশেক আগেই এটাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছিল আর এর অনেক অধিবাসীকে আফগানিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পাহাড়গুলো আক্রমণকারীদের আড়াল করে রাখে, ফলে তাদের আক্রমণ সম্পর্কে আভাস পাওয়া যায় না। বিচক্ষণ শাসকগণ তাই সেগুলোতে শক্ত পাহারার বন্দোবস্ত করেন।”
“যাই হোক, আমার মনে হয় শহরটা আরেকটু চাপ সইতে পারবে। খনি? এখানে নিশ্চয়ই খনি আছে, তাই না?”
মাত্র গতকালই আবু ইসহাকের বিখ্যাত ফিরোজা পাথরের খনির ব্যবস্থাপক দেখা করতে এসেছিল। সে সুলতানের জন্য সেই বিখ্যাত পাথরের অনেকগুলো চমৎকার নমুনা উপহার হিসেবে নিয়ে এসেছিল।
“পাহাড়গুলো খনিজ পদার্থে ভর্তি,” ওমর বললেন। “সীসা আর দস্তা, রুপালি খাদ আর লোহা, মার্বেল পাথর আর সাবান বানানোর পাথর পাওয়া যায় এখানে। দক্ষ খনি ব্যবস্থাপক থাকলে শহরের বণিকদের উপর কর না বাড়িয়েও সুলতানের রাজকোষ পূর্ণ করে দেয়া সম্ভব।”
“হাসান বিন সাবাহও কাল বলছিল যে ব্যবস্থাপনার অভাবেই খাজনা কম পড়েছে,” সুলতান বললেন। “সে আরও বলছিল যে তাকে রাজ্যের কোষাধ্যক্ষ বানানো হলে এমন একটি ধনী প্রদেশ থেকে আরও অধিক আদায় করতে পারবে।”
“হে বিশ্ববাসীদের মহান নেতা!” উজির বললেন, “কোষাধ্যক্ষ হলে সে যা করত তাকে সেই বাজেট তৈরি করতে বললে কেমন হয়? ওটা প্রণয়নের জন্য তাকে ছয় সপ্তাহ সময় দেয়া যেতে পারে।”
“খুব ভালো প্রস্তাব! সে যদি তা করতে পারে তাহলে তাকে আমরা পুরস্কার দেব। যদি না পারে তাহলেও ক্ষতি নেই। দক্ষতা এবং শক্তি দুটোই তার আছে। নিশাপুর এসে সত্যিকার ভাবেই আমরা লাভবান হয়েছি। সেদিন যে শিকার পার্টি হল তেমনটা আর সহসা পাব বলে মনে হয় না। বর্শা দিয়ে কীভাবে বুনো শূকরটাকে বিদ্ধ করেছিলাম খেয়াল করেছিলেন কি?”
এটুকু বলে, উজিরের উত্তরের অপেক্ষা না করেই, তিনি এমনভাবে স্মৃতিতে মশগুল হলেন যেন এখনও শিকারেই রয়েছেন। তিনি চরম উত্তেজনায় সেই মূহূর্তটার কথা স্মরণ করলেন যখন আহত শুকরটা হঠাৎ করে ঘুরে দাঁড়াল আর সুলতানকে আক্রমণ করল।
“মনে হচ্ছে ওটা যেন চোখের সামনে ভাসছে,” মালিকশাহ বললেন। “জন্তুটার চোখ দুটো যেন আগুনে জ¦লছে আর চোয়াল থেকে রক্তাক্ত ফেনা ঝরছে। সে আমার দিকে তেড়ে আসছিল। ইব্রাহিম নিয়াল চেঁচিয়ে আমাকে সাবধান করল। কিন্তু আমি আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলাম। বর্শাটা তার দিকে নিশানা করে বাগিয়ে ধরলাম। ওটা এমন হিংস্রভাবে ছুটে এল যে হাতিয়অরটা সোজা হৃৎপি-ে ঢুকে গেল। আফসোস হচ্ছে ওর মাথাটা বাঁধিয়ে রাখতে পারলাম না বলে। সবাই বলছিল যে বহু বছর ধরে পাহাড়ে এতবড় শূকর কেউ দেখেনি। আমারও তাই বিশ্বাস। চলুন, এবার ফেরা যাক, দুপুরের খাওয়া সারতে হবে।”
আগের কিস্তিসমূহ:
[কিস্তি-১: সুলায়মান পয়গম্বরের যাদুর গালিচা] [কিস্তি-২: গিরিপথ] [কিস্তি-৩ পাহাড়ি উদ্যান] [কিস্তি-৪. পুরনো বন্ধুদের সাক্ষাৎ] [কিস্তি-৫: হাসান বিন সাবাহর কাহিনী] [কিস্তি-৬. প্রাচ্যের দ্বারমণ্ডপ] [কিস্তি-৭: উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনাকারী] [কিস্তি-৮: কবির শিক্ষাজীবন] [কিস্তি-৯: বাগিচায় একদিন]
তারা সামিয়ানায় ফিরলেন আর দেখতে পেলেন যে সবকিছুই প্রস্তুত আছে। সুস্বাদু মিষ্টান্ন আর নানাবিধ ফল খেয়ে তারা হাঁটাহাঁটিতে বৃদ্ধি পাওয়া ক্ষুধা নিবারণ করলেন। এবারে তাদের সামনে নতুন ধরনের বিনোদনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হল। একজন ভারতীয় বাজিকর নানারকমের কৌশল দেখিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করলেন। কোনো সহকারী ছাড়াই সে জাদু দেখিয়ে যাচ্ছিল। গোলাপ-প্রেমিক ওমর বিশেষ করে মুগ্ধ হল সে যখন সবার চোখের সামনে বাতাস থেকে শত শত ফুলসহ গোলাপগাছের আস্ত একটা টব নিয়ে এল। পরমূহূর্তেই দেখা গেল টবটি শূন্য পড়ে আছে, গাছ বা ফুল কিছুই ওটাতে নেই। তার মাথায় একটা পাগড়ি ছিল, যার বর্ধিত অংশ দিয়ে সে মুখে পর্দা টেনে রেখেছিল। এরপর সে তার পাগড়ি খুলে ওটা দিয়ে টবটাকে ঢাকল। এবার পাগড়ি উঠাতেই দেখা গেল ওখানে সবুজ পাতা মেলে একটা গোলাপ গাছ দাঁড়িয়ে আছে। এরপর আবার পাগড়ি দিয়ে ঢাকল এবং উঠালো। এবার দেখা গেল গাছটিতে কুঁড়ি এসেছে। এভাবে যতবার পাগড়ি দিয়ে ঢাকল আর সরিয়ে নিল গাছটাকে প্রস্ফুটিত গোলাপ সম্ভারের তত কাছাকাছি দেখা গেল। পুরোপুরি প্রস্ফুটিত হলে সে টবটা দর্শকদের কাছে নিয়ে গেল এবং সবাইকে ফুলের ঘ্রাণ শুঁকতে দিল।
সে আরেকটা যা কাজ করল সেটাও কম চমকপ্রদ নয়। একটা লম্বা সিল্কের দড়ি বেড় করে সে উজিরকে পরীক্ষা করতে দিল। সুলতানও এটা দেখতে চাইলেন, তারপর মন্তব্য করলেন যে এটা দিয়ে পাহাড়ের বুনো গাধা ধরার চমৎকার ফাঁস বানানো যাবে।
জাদুকর এবার রশিটা ফেরত নিল। একটা অদ্ভুত ঘূর্ণি তৈরি করে সে ওটাকে শূন্যে ছুড়ে দিল। ওটা বাতাসেই ঝুলে থাকল, যেন কোন খুঁটি বা থামের গায়ে বাঁধা আছে। কিন্তু জাদুকরের মাথার ওপর কিছু ছিল না, ফাঁকা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে সে খেলা দেখাচ্ছিল। রহস্যময় দড়িটাকে আটকে রাখার জন্য খুঁটি বা থাম তো দূরের কথা, কোনো গাছের ডালও ছিল না। সে চাইনিজদের মত দেখতে একটা ছোটো বালককে ডাকল। বিড়বিড়িয়ে মন্ত্র পড়ে রশিটার উপরের মাথার দিকে আঙুল দিয়ে দেখাল। মনে হল যেন রশিটার শেষ মাথাটা আকাশে বিলীন হয়ে গেছে। বালকটা দড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল। উঠতে উঠতেই সে নাই হয়ে গেল। জাদুকর তাকে জোরে জোরে ডাকল বা ডাকার ভান করল: “নেমে আয়, নেমে আয়।” কিন্তু কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। একটা তলোয়ার মুখে নিয়ে তখন জাদুকরও দড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর মেঝেতে একটা কাটা পা পড়ল, তারপর একটা হাত। এভাবে যখন সবগুলো অঙ্গ নিচে পড়ল, তখন উপর থেকে ধড়টা নেমে এল, বুক বরাবর তলোয়ার গাঁথা। সবশেষে বালকটার মাথা হাতে করে জাদুকর নিজে নামল।
রক্তপাত দেখে অভ্যস্ত মালিকশাহের মত মানুষের কাছেও দৃশ্যটা ভয়ঙ্কর মনে হল। ভাব দেখে মনে হচ্ছিল যে তিনি এখনি কোনো কর্মচারীকে ডাকবেন এর এই নিষ্ঠুর খুনিকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাবেন। কিন্তু সে রকম কিছু ঘটে যাওয়ার পূর্বেই জাদুকর পাগড়ি দিয়ে নিচের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো ঢেকে দিল। ওটা তুলে ফেলতেই দেখা গেল বালক যেমন ছিল তেমনি আছে। সে মাথা নিচু করে সবাইকে অভিবাদন জানাল। খেলা শেষ করে জাদুকর হাঁটু গেড়ে মাটিতে চুমু খেল। ওমর তার জন্য বাটিভর্তি মদের আদেশ দিলেন। নিজাম-উল-মুলক দিলেন একতোড়া স্বর্ণমুদ্রা। জাদুকর আবার অভিবাদন করল।
বাজিকর চলে যাবার পর পুনরায় কাজের কথা উঠল। উজির অনেক দিন ধরেই বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর কথা ভাবছিলেন। এখন তাঁর মনে হল প্রস্তাবটা সুলতানের সামনে পাড়ার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। তিনি জানতেন যে ওমরও তাঁর কথা জোরালোভাবে সমর্থন করবেন। তাঁর আশা বিফল হয়নি। ওমর প্রাঞ্জল ভাষায় প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার দোষক্রটিগুলি তুলে ধরলেন। তিনি শিক্ষকদের অজ্ঞতা ও সাধারণ জ্ঞানের অভাবের অনেক উদাহরণ তুলে ধরলেন, এবং বিস্তৃত এবং উদারনৈতিক শিক্ষার রূপরেখা কেমন হতে পারে সুলতানের অনুরোধে সেটাও ব্যাখ্যা করলেন।
“জ্ঞান অর্জনের ক্ষুধা নিয়ে ছাত্ররা নিশাপুর আসে,” ওমর বললেন। “কিন্তু তাদেরকে শুকনো ভুসি খেতে দেয়া হয়। ওস্তাদেরা, যাদের ওপর নজরদারি করার কেউ নেই, একটা থামে হেলান দিয়ে অলসভাবে বসে ছাত্রদের সামনে প্রচলিত নিয়ম-কানুন নিয়ে বক্তৃতা দেয়। তারা উদ্ভিদ ও প্রাণী সৃষ্টির নিরস ও উদ্ভট তত্ত্ব দিয়ে শিক্ষার্থীদের মন বোঝাই করে। নিজস্ব মর্জি ও মত মাফিক হাদিসের ব্যাখ্যা করে, যে ব্যাখ্যা সাধারণ জ্ঞান-বুদ্ধির সঙ্গে খাপ খায় না। সবচেয়ে যেটা খারাপ, তারা কেবল এর বাইরের দুষ্পাচ্য খোলস নিয়ে পড়ে থাকে, আর যারা শব্দের ভেতরের নরম ও সুস্বাদু মাংসের সন্ধান দেয়ার চেষ্টা করে তাদের আক্রমণ করে।”
“তুমি হলে এ বিষয়ে কী করতে?” উজির জিজ্ঞেস করলেন। তিনি চাচ্ছিলেন ওমর যেন তার মতামত আরও খোলাসা করে বলেন, কেননা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে সুলতান বিষয়টিতে গভীরভাবে উৎসাহিত হয়ে উঠেছেন।
“আমি সব বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসতাম,” ওমর বললেন। “অদক্ষ, নিরস ও গোঁড়া অধ্যাপকদের বদলে তরুণ বিশেষত বিজ্ঞানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ করতাম। পাঠ্যতালিকায় সুরাসমুহের ব্যাখ্যার পাশাপাশি অঙ্ক ও জ্যোতির্বিদ্যা অন্তর্ভূক্ত করতাম। পরিশ্রমী ও দক্ষ বক্তা দিয়ে কবিতার আলোচনাও চালু করতাম। একইভাবে শিক্ষার্থীরা যেন ইতিহাসের বিস্তৃত ভূভাগে ভ্রমণ করতে পারে সে ব্যবস্থাও করতাম। ধর্ম বিষয়ে পড়াশোনা তুলে দিতে চাই না, তবে অলাভজনক বিষয়ের গুরুত্বহীন বিষয়ের বিস্তারিত আলোচনা করে মূল্যবান শক্তির অপচয়ের পক্ষপাতীও নই। আমি বরং এগুলোর পরিবর্তে উদারনৈতিক বিষয়ে পাঠদানে আগ্রহী।”
কথা বলার সময় ওমরের সুন্দর মুখ যেন উদ্দীপনায় জ্বলজ্বল করছিল, আর তিনি প্রাঞ্জল ভাষায় তার যুক্তি পেশ করছিলেন। একই রকম উদ্দীপনা ছিল নিজাম-উল-মুলকের মধ্যেও। ওমরের মত তিনিও তো গোটা শিক্ষাব্যবস্থাটাকে ঢেলে সাজাতে চান।
আলোচনাটার ফল হল এই যে সুলতান এসকল প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন, এবং ওমরের সহায়তা নিয়ে উজির বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের একটা রূপরেখা দাঁড় করালেন। এ দিক থেকে ভাবলে বাগানের এই বিকেলটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফল বয়ে এনেছিল। এরপর থেকে কেবল নিশাপুরেই যে পরিবর্তনের হাওয়া লাগল তা নয়, বরং সাম্রাজ্যের নানা জায়গায় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হল। বিশেষ করে নিজাম-উল-বাগদাদে যেটি স্থাপন করলেন, সেটি বিখ্যাত হয়ে গেল। উজিরের নামেই এর নাম দেয়া হল। এটা কয়েকশত বছর টিকে ছিল, যদিও কালের বিবর্তনে এর শিক্ষাপ্রণালী পুনরায় সেই গতানুগতিক ধারায় ফিরে গিয়েছিল।
এ আলোচনা করতে করতেই বিকেল কেটে গেল। সূর্য অস্ত যাবার পথে। বৃক্ষের ছায়ারা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে নদীর তীর জুড়ে বিস্তৃত হচ্ছিল আর বাগানে নাইটিঙ্গেল পাখিরা সন্ধ্যার আগমনী গান গাইছিল। শেষ বিকেলের আলো যেন সুন্দর থেকে সুন্দরতর দেখাচ্ছিল। দূরের পাহাড়গুলো গোলাপী রং ধারণ করছিল এবং মণিমুক্তার স্তুপের মত আভা ছড়াচ্ছিল। বাতাস না থাকায় নদীটি এখন কাঁচের মত স্বচ্ছ হয়ে তার প্রশান্ত বুকে গাছ এবং ঝোপের প্রতিচ্ছবি ধারণ করেছে। যদিও কখনো কখনো চড়ুই পাখির ডানার ঝাপটায়, পতঙ্গের পতনে বা কোনো মাছের ঘাই দেয়ায় সে ছবি মাঝে মাঝে ভেঙেও যাচ্ছিল। তাঁরা তিনজন যখন শহরে ফিরছিলেন তখন সন্ধ্যার শীতলতা নামতে শুরু করেছে। ফিরতে ফিরতেই তারা নানা বিষয়ে, বিশেষত আজকের এই বেড়ানোটা নিয়ে মনের সুখে গল্প করছিলেন। বাজিকরের সেই অদ্ভুত খেলাটা, যেটা দেখে মালিকশাহ গ্রেফতার করার আদেশ প্রায় দিয়ে ফেলছিলেন, এবং ওমরও এর কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাননি। সম্মোহন বিদ্যার নাম তখনও কেউ জানে না, যদিও নানান রূপে নানান দেশে ব্যাপারটা শত শত বছর ধরেই ছিল। তারা হাসান বিন সাবাহ এবং তাকে নতুন পদে নিয়োগ করা হলে কী সুবিধা হবে সে বিষয়েও কথা বলছিলেন। তবে বারবারই ঘুরেফিরে আসছিল নতুন শিক্ষাপদ্ধতির পরিকল্পনার কথা।
তারা শহরের তোরণে পৌঁছুতে পৌঁছুতে আঁধার নেমে এল। এসময় পশ্চিম আকাশে লালাভ থেকে ধূসর বর্ণে বদলে যাওয়া ভাসমান মেঘখণ্ডের আড়াল থেকে হঠাৎ করেই চাঁদ উঁকি দিল। মনে হল আকাশজুড়ে সারাদিন আলো যে ফসল ফলিয়েছে সেটা ঘরে তুলতেই বুঝি তার উদয় হওয়া।
“হে প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের রাজপুত্র! আমাদের আরও একটা রুবাই শোনান,” সুলতান অনুরোধ করলেন। গ্রিক তরুণীর কথা ভাবতে ভাবতে ওমর যে অসাধারণ চতুষ্পদীটি রচনা করলেন, তাতে ফার্সি ‘মাহ’ শব্দটি তিনটি আলাদা অর্থ প্রকাশ করে:
চুন ওহদে নেমি কুনাদ কাসি ফারদরা
হালি খুশ কুন তু ইন দেলে শেইদারা
মেইনুশ বেনুরে মাহ এইমাহ কে মাহ
বেসিয়ার বেজুইয়াদ ও নাইঅবাদ মারা।
অর্থ হলো-
“কাল কী হবে কেউ করেনি নিশ্চয়তা দান,
কাজেই তুমি তৃপ্ত রাখো প্রেম পিয়াসী জান,
চাঁদবদনি চাঁদনি রাতে শরাব করো পান, -
একটা সময় মোদের খুঁজে চাঁদ হবে হয়রান।”
“কবিতা যেন সব সময়ই তৈরি!” বন্ধুর প্রতিভায় গর্বিত উজির জোর গলায় বললেন। তারপর যোগ করলেন,“ আমরা তোমাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌছে দিয়ে বিদায় নেব।”
“আপনাদেরকে আরেকবার আপ্যায়নের সুযোগ পেলে আমার বৃদ্ধ মাতা খুশি হবেন,” সুলতানের দিকে তাকিয়ে ওমর বললেন। “আমি নিশ্চিত যে তিনি কচি খাসির মাংস রান্না করে আমাদের ফেরার অপেক্ষায় আছেন।”
এসব কথা চলতে চলতেই দেখা গেল ওমরের বাড়ি এসে গেছে, আর জেবা খাতুন নিচের রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছেলের ফেরার অপেক্ষা করছেন। তিনটি ঘোড়া ঘরের সামনে এসে থামতেই তিনি গলার স্বর উঁচু করে তাদেরকে ভিতরে আসতে বললেন।
“খোশ আমদেদ, সাফা আবুরদিদ! স্বাগতম, স্বাগতম, আপনারা সঙ্গে করে আনন্দ নিয়ে এসেছেন!” তিনি ওমরের সঙ্গীদের আরও বললেন যে তিনি তাঁদের পুনরায় আগমনের অপেক্ষায় থাকবেন।
চলবে...