ওয়ারহলের বাক্সগুলো
ভাষান্তর: আসাদ আলম সিয়াম
প্রকাশিত: ০৩:৫২ পিএম, ৮ জুন ২০২১ মঙ্গলবার আপডেট: ০৩:৫৪ পিএম, ৮ জুন ২০২১ মঙ্গলবার
মূল: গেরি গাটিং
ভাষান্তর: আসাদ আলম সিয়াম
১৯৬৪ সালে একটা আর্ট গ্যালারী, এন্ডি ওয়ারহলের তৈরী করা বাক্সের প্রদর্শনী করে। কারখানাগুলো যেমন তৈরী করে থাকে ওয়ারহলের বাক্সগুলো তার হুবুহু নকল নয় ( কারখানাগুলো কার্ডবোর্ডের বাক্স তৈরী করে থাকে, অথচ ওয়ারহল তৈরী করেছেন প্লাইউডে)। কিন্তু গ্যালারীতে যারা বাক্সগুলো দেখেছেন তারা বিশেষ কোনো পার্থক্য করতে পারবেন না। সময় সময়, আমিও মিউজিয়ামে বাক্সগুলো দেখেছি, তার চেয়েও বেশী দেখেছি ছবিতে– এবং স্বীকার করতেই হবে যে আমিও খুব একটা তফাত পাই নি।
এ বছর, এন্ডি ওয়ারহলের ২৫তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম একটা বড় প্রদর্শনীর আয়োজন করে। সেখানে ওয়ারহলসহ আরও ষাটজন শিল্পী– যারা তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, তাদের শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়। ওয়ারহলের কাজগুলো প্রভূত প্রশাংসা পায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় পিটার শেলডাল, ওয়ারহলকে বিশেষ “প্রতিভা” এবং এক “মহান শিল্পী” হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি এমন কি এও বলেন যে “ওয়ারহল শিল্পকলায় যে মানদন্ড প্রতিষ্ঠা করেছেন তা অতিমূল্যায়িত অন্যসব শিল্পকর্মের প্রকৃত মূল্যকে উন্মোচিত করেছে।“ আসলে, এ জাতীয় বক্তব্যই তার তৈরী বাক্সগুলোর প্রতি আমাকে পুনরায় মনোযোগী করেছে। যদি ওয়ারহল সত্যিই একজন বড় শিল্পী হন, আর ঐ বাক্সগুলো যদি তাঁর শিল্পকর্মের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে থাকে, তা হলে আমিই কেন তা বুঝতে পারছিনা? (লক্ষ্য করুন যে আমি কিন্তু ওয়ারহলের ব্রিলো বাক্সের কথাই শুধু আলোচনা করছি। তাঁর অন্য আরো কাজও হয়তো একই প্রশ্ন উত্থাপন করে, কিন্তু তার জন্য ভিন্ন আলোচনার প্রয়োজন )।
দুটো নিশ্চিত তথ্য দিয়ে আলোচনা শুরু করা যাক। প্রথমত, ওয়ারহলের ব্রিলো বাক্সগুলোকে মহান শিল্পকর্ম হিসেবে ধরা হয়ে থাকে, পক্ষান্তরে, কারখানায় তৈরী সাধারন ব্রিলো বাক্সগুলোকে শিল্পকর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয়না। একটা সাধারন ব্রিলো বাক্সের জন্য নিশ্চয়ই কেউ একশ হাজার ডলার দিতে রাজি হবেননা। দ্বিতীয়ত, বাক্সগুলোর দৃশ্যমান অবয়বের প্রশ্নে, আপাতদৃষ্টিতে তেমন উল্লেখযোগ্য কোন পার্থক্যই নেই। (আর্থার দান্তো এমনকি এও বলেছেন যে দু’ধরণের বাক্সগুলো আসলে হবুহু একইরকম দেখতে)। যদি কোন সুপারমার্কেটে কারখানায় তৈরী বাক্সগুলোর মধ্যে ওয়ারহলের শুধু একটা বাক্স প্রদর্শিত করা হয়, তবে আমরা সেই বাক্সটাকে অন্য বাক্সগুলো থেকে আলাদা করতে পারবোনা। এর অর্থ এই দাঁড়ালো যে, দেখতে কেমন দেখায় তার কারণেই যদি কোন শিল্পকর্ম মহান হয়ে ওঠে, তবে এন্ডি ওয়ারহলের শিল্পকর্মগুলো আদৌ কোন মহান শিল্পকর্ম নয়।
সুন্দর, চমকপ্রদ বা মহিমান্বিত, অর্থাৎ শুধুমাত্র দৃশ্যমান এইসব নান্দনিকতার কারণেই একটা কাজ মহান শিল্পকর্ম হয়ে ওঠে – এই ধারণার প্রতি যদি আমাদের দূর্বলতা থেকে থাকে, তবে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে ওয়ারহলের বাক্সগুলো কোনো শিল্পকর্মই নয়। কিন্তু, সম্ভবত আমাদের এই সিদ্ধান্ত ভুল। সাধারণত, ওয়ারহলের বাক্সগুলো দেখতে কেমন তার পরিবর্তে সেগুলো আমাদের উপর কি প্রতিকিয়ার সৃষ্টি করে তাই আমরা সমাদর করে থাকি। আমাদের এই মূল্যায়ন করবার দুটো ভিন্ন ভিন্ন ধারা রয়েছে।
কখনো কখনো ওয়ারহলের বাক্সগুলোর প্রশস্তি করা হয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহার্য আটপৌঢ়ে দ্রব্যাদি আর মিউজিয়ামে রাখা তথাকথিত ‘শিল্পকলা’র মধ্যে পার্থক্য ঘুচিয়ে দেবার জন্য। এর ফলে, যে সকল জিনিসপত্রকে ঘিরে আমাদের প্রাত্যহিক জীবন গড়ে ওঠে, সেগুলোকে আমরা মিউজিয়ামে রাখা শিল্পকর্মের মতই মূল্যায়ন ও উপভোগ করতে পারি (এবং বলা ভালো অনেকে কম কষ্টে)। যখন ঐতিহ্যবাহী শিল্পকর্মগুলোকে উপভোগ করবার জন্য শিল্প জগত সম্পর্কে ঐতিহসিক ধারণা আর সুক্ষ্ম রুচি থাকার দরকার হয় তখন, ওয়ারহলের ‘পপ আর্ট’ যে আনন্দের প্রকাশ করে তা আমরা তাৎক্ষনিকভাবেই বুঝতে পারি ও সমাদর করতে পারি। দান্তোর ভাষ্যমতে “একজন শিল্পীর সাধ্য নেই যে তাঁর শিল্পে এমন কিছু অন্বেষন করেন যা আমাদের চারপাশের বাস্তবতা ইতোমধ্যেই আমাদের দেয়নি”।
যদিও আমাদের নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যগুলোর কিছু না কিছু নান্দনিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, কিন্তু, ঐতিহ্যগত ভাবে স্বীকৃ্ত মহান সব শিল্পকর্মগুলো সেসব বৈশিষ্ট্য যে মাত্রায় ধারণ করে থাকে, কদাচিৎ নিত্যদিনের জিনিসে তা ঠিক সেই মাত্রায় থেকে থাকে। উপরন্ত, দৈনন্দিন জিনিসপত্রের নান্দনিকতা যে আনন্দের সাথে উপভোগ করা যেতে পারে, আমাদের মধ্যে সেই সচেতনতা জন্ম নেবার জন্য, ওয়ারহলের মতো মিউজিয়ামে এগুলোর প্রদর্শনী করবার প্রয়োজন নেই। বলা বাহুল্য যে নিত্যদিনের এমন সব ব্যবহার্যের মধ্যে যে নান্দনিকতা রয়েছে, ঐতিহ্যগত শিল্পরীতি তা ‘স্টিল লাইফ’ জাতীয় চিত্রকলার চর্চার মধ্য দিয়ে আমাদেরকে প্রথাগতভাবেই সচেতন করে থাকে। এরকম প্রদর্শনী দেখবার পর আমাদের চারপাশের পৃথিবীকে আমরা এমনিই ভিন্নভাবে দেখতে আরম্ভ করি।
ওয়ারহলের শিল্পকর্ম প্রশিংসিত হবার আরেকটা কারণ হলো, শিল্পকলা সম্পর্কে তা একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক প্রশ্ন উত্থাপন করে। দান্তো প্রশ্নটাকে এভাবে উত্থাপন করেছেনঃ দুটো বস্তু একদম একই রকম দেখতে লাগার পরও কিভাবে এটা সম্ভব যে তাদের মধ্যে একটা শিল্পকর্ম হিসেবে বিবেচিত হয় এবং অন্যটা শুধুমাত্র একটা সাধারণ বস্তু হিসেবেই পরিগনিত হয়? এ প্রশ্নের উত্তরে এটা উপলব্ধি করা দরকার যে শিল্পকলায় এমন কোন চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য নির্দিষ্ট করা নেই যা কোন একটা সাধারণ বস্তুকে শিল্পকর্ম হিসেবে উত্তীর্ণ করে। অন্য কথায় এর অর্থ হলো, যে কোন কিছু, তা সে দেখতে যেমনই হোকনা কেন, একটা শিল্পকর্ম রুপে বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে সবকিছুকেই শিল্পকর্ম হিসেবে গন্য করা হবে। দান্তোর মতে, কোন বস্তু একটা শিল্পকর্ম হিসেবে বিবেচিত হবে কিনা সেটা নির্ভর করে একটা “শিল্পকলার জগত” (আর্ট ওয়ার্ল্ড) এর সাথে তার সম্পর্কের উপর “একটা নির্দিষ্ট সময়ে শিল্পকলার ইতিহাস সম্পর্কে যে জ্ঞান এবং শিল্পকলার তাত্ত্বিক যে আবহ “ বিরাজমান করে, তার উপর।
লক্ষ্য করবেন যে, প্রথমত, ওয়ারহলের কাজের মহিমার এই নতুন ব্যাখ্যা, আগে দেয়া প্রথম ব্যাখার বিপরীতে শিল্পকলার সমঝদারিত্বকে আবারো একটা গূঢ় জ্ঞান ও রুচির বিষয় হিসেবে চিন্তা করছে এবং শিল্পকলার প্রকৃ্তি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে একটা সুক্ষ্ম দার্শনিক ধাঁধার উপরেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। উপরন্ত, ওয়ারহলের কাজ (শিল্পজগতের যে প্রেক্ষিতে তিনি তা উপস্থাপন করেছেন), একটা দার্শনিক প্রশ্নের অবতারণা করেছে। নিত্যকার যে কোন বস্তুই কিন্তু সে প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারতো। অন্যদিকে, ওয়ারহল নয়, বরং দান্তোই সেই প্রশ্নের একটা বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর দিয়ে এক বুদ্ধিবৃত্তিক বা নান্দনিক আলোচনার ঝড় তুলেছেন। সমসাময়িক শিল্পজগতে দার্শনিক প্রশ্নের শিল্পগত যে মুল্যায়ন রয়েছে, সেই প্রেক্ষিতে, দান্তোই যেনো ওয়ারহলে চেয়ে বড় শিল্পী।
আমাদের বিশ্লেষন করবার চেষ্টা থেকে কোন শিল্পকর্মের যে অর্থের উদ্ভব ঘটে, ঐ শিল্পকর্মকে সেই অর্থ ধারণ করবার কৃতিত্ব দেয়াটা কিন্তু ভুল হবে। যে কোন বস্তুর অর্থ আবিষ্কার করবার এবং তার উপর কোন অর্থ আরোপ করবার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। মহান এক শিল্পকর্মের মধ্যে নানা ধরণের বোধ ও মূল্য থাকে, যা আমরা কাজটি উপলব্ধি করবার মধ্য দিয়ে উন্মোচিত করি। প্রকারভেদ বোঝানোর জন্য কোনো বস্তুর উপর কোনো কাঠামো আরোপ করা, আর তাকে সেই অর্থবহ বস্তু হিসেবেই পরিগনিত করা, সম্পূর্ন ভিন্ন বিষয়। পার্থক্যটা, একটা সোনার খনি আবিষ্কার করা আর গাদ থেকে একটা চকচকে বস্তু তৈরী করার মতই।
আমি স্বীকার করি যে, পঞ্চাশের দশকের আরো অনেক শিল্পীর মতোই, ওয়ারহল শিল্পকর্ম চর্চার নতুন পন্থা বের করেছিলেন যা কিনা তথাকথিত ঐতিহ্যবাহী উচ্চমার্গের শিল্পকলা (হাই আর্ট) উপেক্ষা করেছিলো। কিন্তু শিল্পচর্চার নতুন ধারাগুলো যেমন, বানিজ্যিক ডিজাইন শৈলী, বা পারফর্মেন্স আর্ট, বা স্থাপনা শিল্প, ধারণাগত শিল্পকর্ম – ইত্যাদি কিন্তু নতুন ধরণের বা গুনে-মানে উচ্চতর কোনো নান্দনিক অভিজ্ঞতার নিশ্চয়তা দেয়না। এটা ঠিক যে ওয়ারহল, দুশ্যে বা সমসাময়িকদের পর থেকে যে কোন কিছুই এখন শিল্পকর্ম হিসেবে উপস্থাপিত হতে পারে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে কোন কিছু মাত্রই একটা সন্তোষজনক নান্দনিক অভিজ্ঞতার জন্ম দেবে। ঐতিহ্যগতভাবে মহান হিসেবে স্বীকৃত শিল্পকর্মগুলো, যদিও কোন কোন ধরণের বস্তু শিল্পকর্ম হিসেবে বিবেচিত হবে তার পরিধিকে খর্ব করেনা, তবুও শিল্পকর্মের কাছ থেকে আমাদের প্রত্যাশা কি হতে পারে তার আদর্শ উদাহরণ হিসেবে কাজ করে (এ হলো কান্টের সেই ধারণা, যেখানে তিনি বলেছেন যে মৌলিক সুন্দর কাজগুলো অনন্য, কিন্তু কোন নিয়মে কাজটা অনন্য হয়ে উঠলো, তা ব্যাখ্যা করেননি)।
প্রায়শই, ওয়ারহলের যে প্রশাংসা করা হয়ে থাকে, সেগুলো, শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে তাঁর শিল্পকর্ম যে নতুন সম্ভাবনা উন্মোচিত করেছে তারই উপর গুরুত্ব দিয়ে থাকে। শিল্পকলার ইতিহাসে সেই কারণেই তাঁর কাজ গুরুত্বপূর্ণ, এবং একই কারণে তাঁর সেইসব কাজ যথার্থ আগ্রহের বিষয়ও বটে। যেমনটা জেরল্ড লেভিনসন দেখিয়েছেন, যে কোন একটা শিল্পকর্ম নান্দনিক উৎকর্ষতা অর্জন করা ছাড়াও একটা গুরুত্বপূর্ণ শৈল্পিক অর্জন হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি এন্ডি ওয়ারহলের বাক্সগুলো আমাদের সেই দৃষ্টিতেই বিবেচনা করা উচিত।
[গেরি গাটিং যুক্তরাষ্ট্রের নটরডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিলোসফিকাল রিভিউ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তাঁর অন্যতম রচনা হলো ‘থিঙ্কিং দ্য ইম্পসিবলঃ ফ্রেঞ্চ ফিলোসফি সিন্স নাইন্টিন সিক্সটি”। অনুদিত প্রবন্ধটি দ্যা নিউইয়র্ক টাইমসে ২০১২ সালে প্রকাশিত হয়েছিলো।]