খেজুরে আলাপ: মান্টু নান্টুদের তেলেসমাতি জীবন!
মোহাম্মদ শাহ আলম
প্রকাশিত: ১১:২৭ পিএম, ৫ জুন ২০২১ শনিবার আপডেট: ১১:৩৭ পিএম, ৫ জুন ২০২১ শনিবার
খেজুরে আলাপ
মান্টু আর নান্টুর গল্পটা যদি না বলি তবে আমার পাঠকদের ঢের ঠকানো হবে। একটা জীবন কতোটা বিকল্পধারায় চলতে পারে, তা তাদের জীবন না দেখলে বোঝার উপায় মানেই। অল্টারনেটিভ এডুকেশন বলতে একটা কথা আছে। যার সোজাসাপটা মানে হয় মূল শিক্ষা ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে কোন বিকল্প উপায়ে শিক্ষার আয়োজন করা। যেমন বাংলাদেশে শিশুদের প্রাকপ্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য সিসিমপুর নামে যে টেলিভিশন কার্যক্রমটা চলে তা একটি বিকল্প শিক্ষা ব্যাবস্থা। অথবা কর্মজীবী মানুষকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় একটি বিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থা। সারা দুনিয়াতেই বিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থার আয়োজন রয়েছে। এ নিয়ে বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বড় বড় ডিগ্রিও দেওয়া হয়। কিন্তু বিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থার মতো বিকল্প উপায়ে যে সংসার চালানো যায় তা একমাত্র মান্টু নান্টুকে দেখলে বোঝা যায়।
মান্টু নান্টুরা পাঁচ ভাইবোন। মান্টু সবার বড়, নান্টু দ্বিতীয়। ওদের কারোরই কোন রোজগারের পেশা নেই। শুধু এই দুই ভাইয়ের নয়। আরো এক বোন এবং দুই ভাই তাদেরও কোন পেশা নেই। কিন্তু বহাল তবিয়তে চলে ওদের সংসার। এই যে আপনি আমি দিনরাত খেটে মরছি। পরিবারের সদস্যদের মুখে একটু হাসির জন্য ব্যবসা বা চাকুরীতে গাধার মত খেটে যাচ্ছি। তা কে করত যদি মান্টু নান্টুদের মতো এই বিকল্প রোজগারের পথটা জানা থাকত!
মান্টুদের এক টুকরো পৈত্রিক জমি ছিল ঢাকায়। কালাচাঁদপুর না কোথায়। জমিতে ছিল বাপের করা আধাপাকা বাড়ি। এই বাড়ি কিছু অংশ ভাড়া দিয়ে চলত ওদের সংসার। মান্টু নান্টুরা তখন বড়। বিয়ে-থা হয়েছে। কিন্তু কোন কাজেকম্মে নেই। বাবা মারা যাওয়ার পর কেউ আর একসাথে থাকবে না। সবাই আলাদা রুমের দখল নিল। তাতে যা হল। বাড়িভাড়া বন্ধ হল। আয়ের পথ বন্ধও হল। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত হলো বাড়ি ডেভেলপারকে দেয়া হবে।
কিছুদিনের মধ্যেই ডেপেলপার কাজ শুরু করে দিল। মান্টু নান্টুদেরও একটা রোজগারের পথ হলো। ডেভেপলপার মাসে মাসে বাড়িভাড়া বাবদ কিছু টাকা দেয়। আয়ের পথটা মন্দ নয়। কিছুদিন পর আরো নতুন পথ খুলল। ডেভেলপার রড, সিমেন্ট, ইট, বালু এনে রাখে কাজের জন্য রাখে। রাতে এসব বিক্রি করে দেয় মান্টু নান্টু। মান্টু যদি রড বেচে তো নান্টু বেচে সিমেন্ট। মাঝখানে বেচারা সিকিউরিটি গার্ডের অবস্থা কাহিল। কিছুই বলতে পারে না। বললেই রুমে আটকে উত্তম মধ্যম। ফলে প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন সিকিউরিটি গার্ড। ফল যা হল, মোটামুটি বিল্ডিংয়ের স্ট্রাকচার দাঁড় করানোর পর পর ডেভেলপার লাপাত্তা। বিপদে পড়ল যারা ফ্ল্যাট কিনেছে তারা। শেষমেষ ফ্ল্যাট ক্রেতারা নিজেরা মিলে বিল্ডিংয়ের কাজ শেষ করে। এর মাঝে মান্টু নান্টুদের বিকল্প রোজগারের পথ কিন্তু বন্ধ থাকেনি।
বিল্ডিংয়ের কাজ শেষ হলে মান্টু নান্টুরা সবাই তাদের ফ্ল্যাট পেয়ে যায়। যারা ফ্ল্যাট কিনেছে তারা উঠে যায় ফ্ল্যাটে। সবার ধারণা ছিল, এবার মান্টু নান্টুদের বিকল্প আয় বন্ধ হবে। কিছুদিন পর ফ্ল্যাট বেচে দিয়ে এখান থেকে চলে যাবে। তাদের নানামূখী অত্যাচার থেকে বাঁচা যাবে। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। মান্টু নান্টুরা আরো বহু বিকল্প বের করে ফেলেছে। এখানে কেউ কোন কাজ করতে আসতে পারে না। ইলেকট্রিক, প্লাম্বিং, রংয়ের কাজ ইত্যাদি যে কাজই হোক চার্জ ডাবল। কারন অর্ধেক পয়সা মান্টুকে দিতে হবে। নতুবা এই ভবনে ঢোকা নিষেধ। মান্টুরা যেহেতু ঐ এলাকার স্থানীয় তাই কেউই কাজ করতে আসার সাহস পায় না।
এমন পরিস্থিতিতে শেয়ালের কাছেই মুরগি বাগি দিতে হলো। যারা ফ্ল্যাট কিনেছে তারা সবাই মিলে সিদ্ধান্তে নিল ভবনের সকল কাজের দায়িত্ব মান্টুকেই দিবে। এতে একটা লাভ হলো, মঞ্চে শুধু মান্টুই থাকল। নান্টুরা নেই। আরেকটি লাভও হলো, মিস্ত্রিদের খরচ কিছুটা বেশি লাগলেও আর ডবল লাগছে না।
এতক্ষণ কিন্তু শিরোনামের পটভূমি বলা হল মাত্র। তাদের বিকল্প রোজগারের মূল বিষয়টি বলা হবে এখন। তো, সবকিছুই এখন ভালো চলছে। ভবনে সব ফ্ল্যাটমালিকগণ বসবাস করছেন। মান্টু নান্টুরাও বসবাস করছেন। তাদের সত্যি ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে যেতে হয়নি। কেনই বা হবে বলুন, বিকল্প রোজগারের পাকাপাকি বন্দোবস্ত হয়ে গেছে। মান্টু নান্টুদের অফিসে যেতে হয় না। ব্যবসার কাজে বাইরে যেতে হয় না। ঘরে বসেই বিকল্প রোজগার। ধরা যাক আজ মান্টুর দশ হাজার টাকা লাগবে। বাজার করতে হবে বা কিছু একটা কিনতে হবে। কোন সমস্যা নেই। ওস্তাদ হাজির। আধাঘন্টার মধ্যে ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে লিখিত নোটিশ যাবে - পানির লাইনে সমস্যা। মিস্ত্রি দেখানো হয়েছে। দশ হাজার টাকা লাগবে। আজ ঠিক না করালে রাতে পানি থাকবে না। জনপ্রতি চারশ টাকা লাগবে। মূহুর্তেই উঠে যায় টাকা। চারশ কোন ব্যাপার! পানি ছাড়া তো আর চলে না। একটা বিষয় ভালো, মান্টু এই জরুরি চাঁদা তোলার বিষয়টা পাঁচশ টাকার নিচে রাখার চেষ্টা করে। যাতে কারো উপর জুলুম না হয়ে যায়। কী চৌকষ, তাই না!
নান্টুর বিকল্প রোজগারের পথটা আরো অভিনব। মান্টুর রোজগারের একটা স্থিতি আছে তবে নান্টুর রোজগারের একটা স্ফিতি আছে। কী করে নান্টু? হ্যা সেটাই তো শােনার অপেক্ষা। নান্টুর বিকল্প রোজগারের পথ হলো অনুষ্ঠান আয়োজন। নিজের জন্মদিন, বউয়ের জন্মদিন, ছেলের জন্মদিন, মেয়ের জন্মদিন, বিয়েবার্ষিকী ইত্যাদি অনুষ্ঠান। টার্গেট জনপ্রতি দুশটাকার আপ্যায়ন আর কমপক্ষে পাঁচশ টাকা সালামী। ভবনের প্রতিটি পরিবারকে দাওয়াত দেয়া হবে। বাইরের আত্মীয় স্বজনকেও। সবাইকে আসতে হবে। না আসলেও সালামী দিতে হবে। নইলে বিল্ডিংয়ের সবাইকে জনে জনে জানানো হবে। অমুককে দাওয়াত দিয়েছিলাম। আসে নাই। টাকার জন্য আসে নাই। ছোটলোক একটা। কে ছোটলোক হতে চায় বলুন? আর হ্যা, আরেকটা টেকনিক আপনাদের শেখার মত আছে। পরিবার প্রতি যাতে দুহাজার টাকা নিশ্চিত হয় সে জন্য, ওদের পুরো পরিবার মিলে একটা গল্প বলবে। গল্পটা এমন, সাদাত সাহেব আজকের অনুষ্ঠানে থাকতে পারবেন না। তিনি গ্রামের বাড়ি গেছেন। যাওয়ার সময় মান্টু ভাইয়ের চার হাজার টাকা দিয়ে গেছেন। মান্টুভাই রাখতে চায় নাই। কিন্তু উনি জোর করে দিয়ে গেছেন। এই গল্পটা বিল্ডিংয়ের সবাইকে শোনানো হবে। প্রতিটি অনুষ্ঠানে কমপক্ষে একশ পরিবার আসে। যার থেকে আয় কমপক্ষে দুলক্ষ টাকা। মন্দ নয়।
কী ভাবছেন? শুধু নান্টু আর মান্টুরই এই বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা? না, ভুল ভাবছেন। ওদের সব ভাইবোনদেরও আলাদা আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে। মাঝে মাঝে তাজ্জব হতে হয়। পাঁচ পাঁচটা ভাইবোন। কারোরই কোন কাজ নেই। তাদের পরিবার চলে বিকল্প ব্যবস্থায়।
মোহাম্মদ শাহ আলম: লেখক ও উন্নয়নবিদ।
আগের লেখা পড়ুন:
‘স্যার’ বলবেন না প্লিজ, ‘ভাই’ বলবেন
আমাদের অফিসে যেদিন প্রথম কম্পিউটার এল