বই আলোচনা
পথ চলাতেই আনন্দ: সরল ভাষায় জীবন কাব্য
কাজী আলিম-উজ-জামান
প্রকাশিত: ০৪:৪৮ পিএম, ২ জুন ২০২১ বুধবার
পথ চলাতেই আনন্দ
এই বইয়ের লেখক পেশায় একজন ব্যাংকার। তবে ১৪৩ পৃষ্ঠার এই বইটির আদ্যোপান্ত পড়ে তাঁকে আমার একজন গদ্য কবি মনে হয়েছে। যদিও মানুষ মাত্রই কবি। মোহাম্মদ মামদুদুর রশীদের এই কবিরূপ ধরা পড়েছে বইয়ের প্রতিটি বাক্যে-শব্দে-রূপকল্পে।
কোনো লেখকের লেখা পড়ে পাঠকের মনে যদি ছবিটি ভেসে ওঠে, লেখক যা ভাবছেন, পাঠকও যদি তাই ভাবেন, লেখক যা দেখছেন, পাঠকও যদি তাই দেখেন, তবে তিনিই প্রকৃত সার্থক লেখক।
‘পথ চলাতেই আনন্দ’ বইটিতে পাঠক হিসেবে আমি যেন লেখকের সঙ্গেই পথ চলেছি। সহযাত্রী হয়ে হেঁটেছি সড়কের শেষ মাথা অবধি। বলতে দ্বিধা নেই, বইয়ের সব কথা লেখকের একান্ত আনন্দ-বেদনার কাব্য। কিন্তু একান্ত ভাবনার সঙ্গে যদি যুক্ত হয় জীবনের নানা পর্যায় থেকে সঞ্চিত অভিজ্ঞতার জবানবন্দি, যদি যুক্ত হয় গভীর জীবনবোধ, তখন তা আর ব্যক্তির একার থাকে না। তাতে অধিকার জন্মে সব মানুষের। ‘পথ চলাতেই আনন্দ’ বইটি যেন সবারই জীবনের খণ্ডচিত্র।
বইয়ে লেখার বিষয়বস্তুকে ভাগ করা হয়েছে পাঁচটি পর্বে। প্রথম পর্বে আছে বিশ্বের বিভিন্ন শহরে লেখকের ভ্রমণস্মৃতি। লেখক এই করোনা অতিমারিকালে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েছিলেন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হতে। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর পর লেখককে বিধি মোতাবেক দুই সপ্তাহের জন্য হোটেলে নিভৃতবাস (কোয়ারেন্টিন) করতে হয়। এই নির্জনকক্ষে বাসকালে লেখক বলে যান তাঁর জীবনের কথকতা। লেখক কল্পনার ফানুশ উড়িয়ে চলে যান আফগানিস্তানের পানশিরে, যে শহরে একদা ছিলেন রস ও পাণ্ডিত্যের রাজা সৈয়দ মুজতবা আলী। মুজতবা আলী তাঁর আফগান ভৃত্য আবদুর রহমানকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, সাত দিন ধরে কি শীতল শহর পানশিরে কক্ষের জানালার পাশে বসে থাকা যায়? আবদুর রহমান জবাব দিয়েছিল, ‘একবার আসুন, জানালার পাশে বসুন, দেখুন। পছন্দ না হলে আবদুর রহমানের গর্দান তো রয়েছেই। সেখানে কত রকমের বরফ পড়ে। ছেঁড়া ছেঁড়া পেঁজা তুলার মতো। তারই ফাঁকে ফাঁকে আসমান জমিন কিছু দেখা যায়।’ এই বইয়ের লেখকও যেন সিডনির শেরাটন গ্র্যান্ড হোটেলের জানালার পাশে বসে ঘুরে আসেন পানশির শহর থেকে।
কখনো এই লেখক যেন স্বয়ং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৯০৩ সালে কাউকে কিছু না বলে বোম্বে (এখনকার মুম্বাই) থেকে রেঙ্গুনের (এখন ইয়াঙ্গুন) জাহাজে চেপে বসেছিলেন শরৎ চন্দ্র। বার্মায় (মিয়ানমার) তখন প্লেগ রোগের বাড়বাড়ন্ত। সেখানকার শাসক ইংরেজ সাহেবরা ধরে নিয়েছিলেন, প্লেগ রোগ ছড়িয়েছে বোম্বে থেকে আসা কুলিরা। তাই সেখানে পৌঁছেই কোয়ারেন্টিন করতে হয় শরৎ চন্দ্রকে। সে সব বর্ণনা আছে শ্রীকান্ত উপন্যাসে। শরৎ চন্দ্র অবশ্য শব্দটি লিখেছেন ‘কেরেন্টিন’। মামদুদুর রশীদের ভাষায়, ‘আমার বর্তমান অবস্থানের সঙ্গে সেদিনের সেই বর্মা মুলুকের কেরেন্টিনের কোনো মৌলিক পার্থক্য দেখছি না। সেদিনের প্লেগের বদলে আজকের ভীতি করোনায়, বর্মা মুলুকের বদলে এই কেরেন্টিন অস্ট্রেলিয়ায়, দশ দিনের বদলে ১৪ দিন, আর শরৎ চন্দ্রের জায়গায় বেচারা আমি।’
এই অধ্যায়েই আছে একটা জীবনবোধের গল্প, যা লেখক শুনেছেন অধ্যাপক প্রসাদ কাইপার কাছ থেকে, যিনি ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক প্রসাদ গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং একজন লেখক ও ব্যবসায় পরামর্শদাতা হিসেবে পরিচিত। গল্পটা এ রকম-গল্পের নায়ক যুদ্ধবন্দী। ছোট্ট একটি কক্ষে তাঁকে আটকে রাখা হয়েছিল। সে বুঝে গিয়েছিল এভাবে থাকলে সে মারা যাবে, নতুবা পাগল হয়ে যাবে। তাই সে বের করেছিল মুক্তির এক ভিন্ন রকম পথ। তবে বাস্তবে নয়, কল্পনায়। যুদ্ধে যাওয়ার আগে সে গলফ খেলতো। ছিল সাদামাটা এক খেলোয়াড়। এই গলফকেই বেছে নিয়েছিল সে কল্পনার পাখা মেলতে। তার পরিচিত গলফ কোর্সটিতে সে প্রতিদিন আঠারো হোল গলফ খেলতো। লেখকের বর্ণনায়, ‘পুরো খেলাটি প্রথমে কল্পনা করত। কোন পোশাকে খেলবে সেটাও দেখত কল্পনায়। শরীরে বাতাসের স্পর্শ নিত। সদ্য কাটা ঘাসের ঘ্রাণ নিত শুকে।...খেলার প্রতিটি বিষয়, প্রতিটি শট সে পরিকল্পনা করত, বাস্তবায়ন করত কল্পনায়। এভাবে চলতো প্রতিদিন, আঠারো হোল শেষ না হওয়া পর্যন্ত।’
একদিন এই ছেলেটা মুক্তি পায়। এরপর সে ফিরে আসে বাস্তবের গলফ কোর্টে। অবাক হয়ে সে অনুধাবন করে তাঁর খেলার উন্নতি হয়েছে। এই গল্পটির প্রভাব পাঠকমনে দীর্ঘ ছায়া ফেলবে বলার অপেক্ষা রাখে না।
ভ্রমণপর্বেই আছে কেনিয়ার মাসাইমারা ন্যাশনাল রিজার্ভে সাফারির চমৎকার সব বর্ণনা। বুনো প্রান্তরে জিরাফ, বুনো মহিষ, জেব্রা, হরিণ, জলহস্তী, কালো গন্ডার এমনকি সিংহ আর চিতাবাঘ দেখার রোমহর্ষক গল্প।লিখেছেন ১৯৮৯ সালে ছাত্রজীবনে ভুস্বর্গ কাশ্মীরসহ ভারতের বিভিন্ন শহর ভ্রমণের কথা। এই সুযোগে ভ্রমণের অর্থ জোগাড়ে যে আত্মীয়া পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে ভোলেননি। আছে ২০১৭ সালে এক কর্মশালায় জার্মানির বার্লিন শহরে গিয়ে সেখানে পরিপাটি জাদুঘর দেখার গল্পও।
দ্বিতীয় পর্বের শিরোনাম ‘পরিবার ও বন্ধু’। এখানে লেখক যেন নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলেছেন। নিজের শরীরে বাসা বাধা মধুমেহ রোগ নিয়ে জানিয়েছেন তাঁর উদ্বেগের কথা। এসেছে তাঁর ছোট খালার জীবনসংগ্রাম, চাওয়া-পাওয়ার হিসাবের কথা।
গাইবান্ধা শহর থেকে দূরে হোসেনপুর গ্রামে ‘অরকা হোমে’র অনাথ শিশুদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশনা লেখকের মনে দাগ কাগে। তখন দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে লেখক ও তার বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নেন, এই শিশুদের পাশে দাঁড়াতে হবে আরও নিবিড়ভাবে, এদের ভালোবাসতে হবে মনের গহিন থেকে। এই বিষয়টিও পাঠকের চিত্তে নির্মল আনন্দ দেবে।
লেখক দেশের নামী একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে আছেন। হিসাব-কিতাব, উন্নয়ণ, প্রক্ষেপণের বাতাবরণে থেকেও মনটা তাঁর একেবারেই যেন স্বচ্ছ কাচের আয়না। ‘স্মৃতিকথা পর্বের লেখাগুলো তাই বলে। একটা লেখার শিরোনাম-‘স্মৃতিতে আম-দুধ, আহ্’। এর আর কোনো ব্যাখ্যা লাগে না। এ পর্বেই আছে ছুটির দিনে একটু বেশি সাইকেল চালিয়ে চনমনে হওয়ার অনুভূতির কথা।
শেষে তিন তিন করে মোট ছয়টি ছোট লেখায় শেষ হয়েছে ব্যক্তিগত অনুভূতি ও সমাজভাবনা পর্ব।
শুরুতে বলেছিলাম, এই লেখককে আমার আপাদমস্তক একজন গদ্যকবি মনে হয়েছে। বইটিতে একটি কবিতা আছে সে জন্য নয়, পুরো লেখায় লেখকের সরলতার জন্য, ভাষায় কাব্যময়তার জন্য।
বইটি প্রকাশ করেছে ‘রুটস’। চলতি বছরের (২০২১) ২৬ মার্চ বেরিয়েছে বইটি। বইটির মূল্য ধরা হয়েছে ৪৫০ টাকা।
লেখক বইটি উৎসর্গ করেছেন তাঁর মাকে। উৎসর্গপত্রে লিখেছেন, এ জীবনে যতটুকু প্রাপ্তি, যা কিছু সাফল্য, সবই মায়ের অনুপ্রেরণা, সাহস আর শক্তিতে। সেই মায়ের স্নেহ যেন চলমান থাকে দীর্ঘ সময়, সৃষ্টিকর্তার কাছে এই-ই প্রার্থনা।
বইটিতে ছবির ব্যবহার নিয়ে আরেকটু চিন্তা করার সুযোগ আছে বলে এই মূল্যায়নকারীর মনে হয়েছে। ‘পথ চলাতেই আনন্দ’ সারা বছর পাঠকের চিন্তায় থাকুক, এই প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি।
কাজী আলিম-উজ-জামান, কবি ও গবেষক