ধারাবাহিক উপন্যাস
বলতে এলাম ভালোবাসি : পলাশ মাহবুব : পর্ব-৭
পলাশ মাহবুব
প্রকাশিত: ০৬:০৬ পিএম, ১ জুন ২০২১ মঙ্গলবার আপডেট: ০৬:১২ পিএম, ১ জুন ২০২১ মঙ্গলবার
পর্ব-৭
১১.
মোতালেব সাহেব রুমে ঢুকেই বললেন, অংক মিলতেছে। অংক মিলতেছে।
সোলায়মান সাহেব জরুরি একটা অফিসিয়াল ফাইল দেখছিলেন। সেখানেও অংক মেলানোর ব্যাপার আছে।
অনিচ্ছা নিয়ে ফাইল থেকে চোখ উঠিয়ে দেখলেন মোতালেব সাহেব সামনে দাঁড়িয়ে। ফাইলটা বন্ধ করে টেবিলে রাখলেন তিনি। বসতে বললেন তাকে।
কিসের অংকের কথা বলছেন মোতালেব সাহেব? শেয়ার বাজারের খবর নাকি?
আরে ভাই আমি তো আর অফিসের ক্যাশিয়ার না। বাসের কন্টাকটর বা শেয়ার মার্কেটের ইনভেস্টরও না। যে টাকা পয়সার অংক করবো। আমার অংক তো একটাই। বিয়া-শাদীর অংক। দুটি হৃদয়কে একটা বানানোর কারবার। এ বাঁধন যাবে না ছিঁড়ে। সেটাই মিলতেছে। মনে হয় এবার হবে।
তাই নাকি! পাত্র হাতে এসেছে তাহলে। সোলায়মান সাহেব আগ্রহি হন।
ছেলে একটা পাইছি। মনে করেন মাখন। সবাই তো বউ লইয়া বিদেশের জাহাজ ধরে। এই ছেলে বিয়ে করে দেশে থেকে যাবে। আর বিদেশে যাবে না। এমন ছেলে বিরল। দেশপ্রেম আছে। যার মধ্যে দেশপ্রেম আছে বউয়ের প্রতিও তার প্রেম থাকা স্বাভাবিক। অংক তাই বলে।
আচ্ছা। তা ছেলে কি করে? কি নাম? দেশের বাড়ি কোথায়?
আপাতত বিয়া করবে। দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলো। দেশে আসছে। প্রথমে বিয়া করবে তারপর সংসার।
আরে ভাই বিস্তারিত বলেন। কথা জমিয়ে রাখা আপনার একটা বদভ্যাস। আগ্রহ তৈরি করে তারপর একটু একটু করে তথ্য ছাড়েন।
ঠ্যা ঠ্যা ঠ্যা . . .
সোলায়মান সাহেবের কথা শুনে মোতালেব সাহেবের হাসির তোড়ে ভুরি নাচে।
আরে ভাই, এইটা হইলো গিয়া আর্ট। বিস্তারিত সব যদি একসাথে বলে দেই তাহলে তো কথার নকশা বলে কিছু থাকে না। বিয়া-শাদীর আলাপ আলোচনা হইলো গিয়া এক ধরণের শিল্প। কথার খেলা। একপক্ষ গিট্টু দেবে তো আরেক পক্ষ গিট্টু ছুটিয়ে নতুন গিট্টু লাগাবে। এইসব আলোচনায় একটা ওঠা-নামা আছে।
ওঠা নামা! সেটা আবার কেমন? আপনি শেয়ার বাজারের ইনভেস্টর না কিন্তু কথা তো সেরকম বলছেন। ওঠানামা তো শেয়ার বাজারের ভাষা।
সোলায়মান ভাই, একদিনে এই ওঠা-নামা বোঝা যাবে না। ওঠা-নামা বুঝতে আমার সাকসেসফুল্লি বাইশটা ঘটকালি ডান করতে হইছে। বিয়া-শাদীর আলাপ হইলো গিয়া মনে করেন ঘুড্ডি উড়ানোর মতো। একবার সুতা ছাড়লেন তো আরেকবার সুতা বটলেন। একবার বটলেন তো আরেকবার ছাড়লেন। একবার ঘুড়ি উঠলো তো আরেকবার নিচে নামলো। তবেই না আরেকজনের ঘুড়ি কাটতে পারবেন।
মোতালেব সাহেব এমনভাবে ঘুড়ি ওড়ানোর মতো করে বিষয়টা দেখিয়ে দেন যে সোলায়মান সাহেবের না বুঝে উপায় থাকে না।
তিনি মাথা নেড়ে বলেন, তা অবশ্য ঠিক বলছেন। বিয়ে-শাদী বড় জটিল জিনিস। বিয়ে-শাদীর আলাপ মানে কথার প্যাঁচ।
আসলে কিছুই না। যখন মিলতে শুরু করে সবই মিলে যায়। শুরু করাটা হইলো গিয়া আসল। চালের বস্তার গিঁট ছোটানোর মত। প্রথম প্যাঁচ খুললে বাকিটা একটানে খুইলা যায়।
মোতালেব সাহেব আবার ভূরি নাচান। শব্দ ছাড়া তার শরীর আর চেয়ার কেঁপে কেঁপে ওঠে।
ওইটাও মনে করেন এক ধরণের খেলা। বিষয়টা হইলো গিয়া টিইপ্পা দেখনের। টিপ্পা দেইখা বুঝতে হইবো কচি নাকি ঝুনা। হাত যশের একটা ব্যাপার আছে। এক দিনে হাত পাকে না। ঘটনা ঘটাইতে ঘটাইতে হাত পাকে।
তা নতুন পাত্র কেমন বুঝলেন। কচি নাকি ঝুনা? আগ্রহ নিয়ে জানতে চান সোলায়মান সাহেব।
ভালোই মনে হচ্ছে। আপাতত সুতা ছাড়তেছি। সুতা বটনের সময় ফাইনালি বোঝা যাবে কতটা কচি।
তা সুতা বটবেন কখন? আমি তো মনে করলাম সুতা বইটা তারপর নাটাই নিয়া আমার কাছে আসছেন।
আরে সোলায়মান ভাই, বিয়া-শাদী হইলো গিয়া ঠান্ডা মাথার বাহাস। বিয়া-শাদী নিয়া উত্তেজনা থাকবে পোলাপানের শরীরে। যাগো বিয়া তাগো মইধ্যে। বউ নিয়া বাসর ঘরে ঢোকার আগ পর্যন্ত সেই উত্তেজনা নামবো না। কিন্তু বাপ-মায়ের শরীরে অস্থিরতা থাকা ঠিক না। বিশেষ কইরা পাত্রীর বাপের তো নাই-ই। এই লাইনে অস্থির হইলে ধরা খাবেন।
সোলায়মান সাহেব একটু দমে যান। তিনি পিয়ন ইদ্রিসকে ডেকে ফজলের দোকানের দুধ চা আনার অর্ডার দেন। সঙ্গে তেলে ভাজা পিঁয়াজু।
চা আসার খবরে মোতালেব সাহেব চেয়ারে শরীরটাকে একটু ছেড়ে দেন। তারপর পেছন থেকে ইদ্রিসকে ডাকেন।
এই ব্যাটা ওভারডোজ ইদ্রিস, বয়সের আগে বুড়া হইছোস ঠিকই কিন্তু মাথা ঠিকঠাক পাকে নাই। ঠান্ডা চা আনবি না খবরদার।
মোতালেব সাহেবের ধমক খেয়ে শুকনা হাসে ইদ্রিস।
ফ্লাস্কের প্যাঁচ খুইল্লা গেছে স্যার। দোকান থেইকা আনতে আনতে চা ঠান্ডা হইয়া যায়।
প্যাঁচ খুইল্লা গেছে? প্যাঁচ খুইল্লা গেছে তো কি হইছে? তোর মাথা থিকা একটা প্যাঁচ ফ্ল্যাস্কে লাগাই দিলেই তো হয়। তোর মাথায় তো প্যাঁচের অভাব নাই।
ইদ্রিস কোনও জবাব দেয় না। এই লোকের সাথে কথা বলা মানে দাওয়াত দিয়ে বিপদ ডেকে আনা। সে নিঃশব্দে বেরিয়ে যায়।
ইদ্রিস বেরিয়ে গেলে মোতালেব সাহেব আবার কথায় ফেরেন।
শোনেন সোলায়মান ভাই। যে কথা বলছিলাম। যতদূর খবর পাইছি তাতে মনে হইতেছে ছেলে ভালো। তবে ছেলের ছোট দুলাভাই একটু বেশি কথা বলে। ইদ্রিস মার্কা লোক। বয়সের আগে পাকছে। তারওপরে পুলিশ। খালি জেরা করার অভ্যাস। তবে আমার সাথে কুলাইতে হইলে তারে আরেকবার বিএসএস দিতে হবে। ঠ্যা ঠ্যা ঠ্যা।
ওই ব্যাটা দুলাভাই বলে কি জানেন?
আপনাকে আবার কি বলে?
আরে আমাকে বলে, মেয়ের প্রেম-ট্রেম নাই তো আবার? এখনকার স্মার্ট মেয়েরা নাকি প্রেম করে নিজের ইচ্ছায় আর বিয়ে করে বাবা-মায়ের ইচ্ছায়।
আমিও শুনাই দিছি। বলছি, মাশাল্লাহ আমগো মেয়ের যে রূপ তাতে আপনাগো দোয়ায় তার পেছনে পোলাপাইনের লম্বা লাইন। কয়জনের লগে প্রেম করবো। তাই কারো লগেই করে না। এক্কেবারে বিয়া কইরা জামাইয়ের লাগে প্রেম করবো। ঠ্যা ঠ্যা ঠ্যা।
বলক ওঠা পানির মতো মোতালেব সাহেবের ভুরি কাঁপতে থাকে।
মেয়ের প্রেমের আলাপে সোলায়মান সাহেব যুক্ত হন না। প্রসঙ্গ বদলাতে তিনি পাত্রের ছবির সন্ধান করেন।
ছেলের ছবি-টবি আছে নাকি কোনও? থাকলে দেন একটু দেখি।
সোলায়মান সাহেবের আগ্রহে নিজের বুক পকেটে হাত দেন মোতালেব সাহেব। খাকি খাম থেকে একটা ছবি বের করেন তিনি।
তা একটা ম্যানেজ করছি একটা ছবি। তবে ছবি দেইখা ছেলেকে বিবেচনা করা ভুল হবে। সন্ধ্যার টাইমে তোলা ছবি। চেহারা একটু আন্ধার আসছে। ছেলে কিন্তু দেখতে কালো না। স্কিনে উজ্জ্বলতা আছে। ছেলে লং টাইম বিদেশে ছিল। বোঝেনই তো। বিদেশের বান্দরও হয় ফর্সা টুকটুকা।
সোলায়মান সাহেবের দিকে ছবিটা বাড়িয়ে দেন মোতালেব সাহেব।
সোলায়মান সাহেব ছেলের ছবি দেখেন।
একটু না। ছেলে ভালোমাপের কালো মানিক। তবে এটা ঠিক কালো হলেও দেখতে মন্দ না। কালোর মধ্যে ভালো।
সোলায়মান সাহেব ছবিটা সাইড টেবিলের ওপর রেখে বললেন, আপনার ভাবিরেও একবার দেখাই।
শুনে মোতালেব সাহেব জিভে কামড় দেন।
না না না। এই ছবি না। প্রথম দেখাই হচ্ছে আসল দেখা। চোখে লেগে থাকে। বাসায় নেয়ার জন্য অন্য ছবির ব্যবস্থা করতেছি। পাত্রীর মা দেখবে। পাত্রী নিজে দেখবে। আত্মী-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবকেও দেখাবে। এই ছবি দেয়া ঠিক হবে না।
মোতালেব সাহেব ছবিটা নিয়ে খামে ভরে টেবিলের ওপর রাখেন।
শোনেন সোলায়মান ভাই, আমার বাইশ বিয়ার হিস্ট্রিতে কিন্তু কোনও ফল্ট নাই। প্রত্যেকেই খুশিতে বাকবাকুম করতেছে। মাঝে মাঝে তারা আইসা আমারে সেই ডাক শুনাই যায়। মনে করেন, তেইশ নম্বরটাও এর উল্টা হবে না। তাছাড়া আপনি আমার কাছের মানুষ।
এতটুকু বলে মোতালেব সাহেব চারপাশে একবার তাকায়। তারপর গলাটা একটু নামিয়ে আনে।
ছেলে নিয়া টেনশনের কিছু নাই। আমি বিস্তাারিত খোঁজ-খবর নিয়েছি। ছেলের নাইন্টি ফাইভ পার্সেন্ট ওকে। পড়াশোনা করছে বিদেশে। ভালো চাকরি করত। হাতে টাকা-পয়সাও আছে। এখন ডলার ভাঙ্গাইয়া দেশে কিছু করবে। দেশপ্রেমিক ছেলে। প্রেম জিনিসটা আগে থেকে মনের মধ্যে আছে। ঠ্যা ঠ্যা ঠ্যা।
আপনার ওপর আমার আস্থা আছে মোতালেব সাহেব।
সোলায়মান সাহেবের মুখে হাসির রেখা দেখা যায়।
তবে হালকা একটু সমস্যা আছে।
সমস্যা!
না। ঠিক ছেলের না। সমস্যা যা আছে তা ছেলের বাবার।
ছেলের বাবার!
হ্যাঁ। ছেলের বাবার।
কি সমস্যা?
না, মানে। ছেলের মা নেই।
ওহ, স্যাড। কিন্তু তাতে বাবার সমস্যা কি?
মানে, ছেলের মা মারা যাবার পর বাবা আরেকটা বিয়ে করেছে। সংসারে সৎ মা আছে আরকি।
বলেন কি! সংসারে সৎ মা! মাই গড। আমার একটা মাত্র মেয়ে।
সোলায়মান সাহেব যতটা আগ্রহ নিয়ে শুনছিলেন ঠিক ততটা দমে যান।
আমাদের এই এক সমস্যা। পাত্র খুঁজি সৎ। কিন্তু সৎ মা আছে শুনলে চোখ কপালে তুলি। আরে ভাই সৎ মা থাকা তো একদিক দিয়ে ভালো। ঝামেলা নাই। বিয়ের পর সব মেয়ে নিজের একটা সংসার চায়। নিজের মতো করে। কিন্তু শ্বশুর-শ্বাশুরির সাথে থাকতে হয় বলে বেশির ভাগ মেয়ে সেই সংসারটা পায় না।
তাই বলে সৎ মা!
শোনেন সোলায়মান ভাই, সৎ মা থাকায় সুবিধা হলো আপনার মেয়েকে সৎ মায়ের সংসারে থাকতে হবে না। প্রথম দিন থেকে সে নিজের সংসার পাবে। নিজের মতো করে নিজের সংসার সাজাবে।
মোতালেব সাহেবের আশ্বাসে সোলায়মান সাহেবের মাথার ভাঁজ সরু হয়ে আসে। কিন্তু পুরোপুরি যায় না।
আরে ভাই আমি যা বলি অংক করে বলি। আপনি কোনও টেনশন কইরেন না। যা করার আমি করবো। আপনি শুধু পছন্দ হইলে ইয়েস আর না হইলে নো বলবেন। আপনার কাজ ওইটুকু। বাকিটা আমার ওপর ছাইরা দেন।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় মোতালেব সাহেব।
কই যান। চা আনতে দিয়েছি তো।
চা আসতে দেরি হবে। ইদ্রিসকে চা আনতে পাঠিয়েছেন। ও মনে হয় ফ্লাস্ক কিনতে গেছে। আধপাকা উজবুক একটা। ঠ্যা ঠ্যা ঠ্যা।
চলবে...
আগের পর্ব পড়ুন
বলতে এলাম ভালোবাসি : পলাশ মাহবুব : পর্ব-৬
বলতে এলাম ভালোবাসি : পলাশ মাহবুব : পর্ব-৫
বলতে এলাম ভালোবাসি : পলাশ মাহবুব : পর্ব-৪
বলতে এলাম ভালোবাসি : পলাশ মাহবুব : পর্ব-৩