অনলাইনের বেলতলা
মোহাম্মদ শাহ আলম
প্রকাশিত: ১২:৩৫ পিএম, ২৯ মে ২০২১ শনিবার আপডেট: ১২:৪১ পিএম, ২৯ মে ২০২১ শনিবার
অনলাইনে কেনাকাটায় একটা ভাব আছে। কেমন বড়লোক বড়লোক লাগে। জিনিসের ছবি দেখে কিনলাম, অর্ডার করলাম, দুদিন পর বাসায় দিয়ে গেলো, কোথাও যাওয়া লাগলো না, ভিড়বাট্টা নেই। মজার না! এই মজার বিষয়টি মাঝে মাঝে চরম বিরক্তিকর হয় কিন্তু দুদিন বাদেই আমরা ভুলে যাই। আবার কিছু একটা অর্ডার করি, আবার বিরক্ত হই, আবার ভুলে যাই, আবার অর্ডার করি। এটাকেই আমি বলছি অনলাইনের বেলতলা। এই বেলতলাতে ন্যাড়া একবার না, বারবার যায়। আর যাবেই না কেন! খানিকের জন্য ফেসবুকে ঢুকলেন, চোখের সামনে এসে হাজির হলো নানান রকম দোকান। এসব দোকানে ফ্রিজ-টিভি-গাড়ি থেকে শুরু করে পাওয়া যায় চ্যাংমাছ-চ্যাপাশুটকি পর্যন্ত।
একদিন বসে বসে ফেসবুকিং করছি। এমন সময় এক লুঙ্গির দোকান এসে হাজির। কখনো মনে হয় ‘লুঙ্গি’ শব্দটি উচ্চারণ করেছিলাম, তা কিভাবে যেন এই লুঙ্গি দোকানী শুনে ফেলেছে। ভালোই হলো। এই করোনারালীন সময়ে দোকানে যেতে হবে না। বসে বসে এই অনলাইন দোকানের লুঙ্গি দেখি। যেই না একবার এই দোকানে লুঙ্গি দেখতে গেছি, সাথে সাথে সব লুঙ্গির দোকানীরা ডাকাডাকি শুরু করেছে। মানে আমার ফেসবুকের স্ক্রিনে এসে হাজির শত শত লুঙ্গি। আমার ফেসবুক জুড়ে এখন লুঙ্গি আরা লুঙ্গি। কোনটা রেখে কোনটা কিনি! অনেক দেখে শুনে দু’খানা লুঙ্গি পছন্দ করেছি। অর্ডার করতে যাব। দাম জানতে চাইলাম। দাম বলল না। বলল, ইনবক্সে আসেন। মানে, আমার সাথে গোপনে কথা হবে। ভাবটা এমন আমাকে ওরা এত কম দামে লুঙ্গি দু’খানা দেবে তা কাউকে জানানো যাবে না। তাই ইনবক্স। হায়রে ইনবক্স! কতদিন কতজনের সাথে একটু গোপন কথা বলার জন্য ইনবক্স সামনে নিয়ে অপেক্ষা করেছি! কেউ আসেনি। আজ এসেছে লুঙ্গিওয়ালা।
তো গেলাম ইনবক্সে। ওই, যা ভেবেছি তাই। স্যার, আপনার জন্য একদমই কমদামে দিচ্ছি স্যার। শুধুই আপনার জন্য এই দাম স্যার। কথার আগে স্যার, পরে স্যার। কী একটা ভাব এসে গেল। ঘরে লুঙ্গি পরে স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে বসে বসে বাজারে যাইনি বলে বউয়ের বকা খাচ্ছি আর ওপাশ থেকে কেমন স্যার স্যার বলে যাচ্ছে। কীসের বাজার কীসের কী! যেভাবে স্যার স্যার বলছে লুঙ্গি না কিনলে স্যারের মানইজ্জত থাকে? কিনেই ফেললাম। দুদিন বাদে কলিং বেল। দরজা খুলতেই, স্যার, আপনার দুটো লুঙ্গির অর্ডার ছিল। আবারও স্যার! লুঙ্গি হাতে নিয়ে টাকা পয়সা দিয়ে ডেলিভারিম্যানকে বিদেয় করলাম। সাথেই সাথেই বালতির পানিতে ভিজিয়ে রাখলাম। পরদিন সকালে গেলাম লুঙ্গি কেচে শুকাতে দিতে। কিন্তু এ কী লুঙ্গি তো দেখি নরম হয় না। সাবান দিয়ে আবারো ভিজিয়ে রাখলাম। না একই অবস্থা। প্লাস্টিকের মত ত্যাড়া হয়ে থাকে। ভাবলাম দুয়েকদিন বাদে হয়তো কোমল হবে। কিন্তু সেই একই অবস্থা। বোঝা গেল সিনথেটিক সুতার লুঙ্গি। এই লুঙ্গির যে দাম হবার কথা তার চেয়ে পাঁচগুণ দামে কেনা লুঙ্গি দু’খানার ঠাঁই হয়েছে আলমারির চিপায়।
প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, বেলতলায় আর যাব না। কিন্তু মনে থাকে না। এটা অনলাইন বেলতলা। এখানে বার বার যেতে হয়। এই কোভিডকালীন সময়ে কত কী যে কিনেছি। প্রতিবারই নতুন নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে। তবে গেল ঈদের একটা অভিজ্ঞতা না বললেই নয়।
দামে বেশি মানে ভালো একজোড়া জুতা পছন্দ হয়েছে। জুতোর নামও বাহারি, ডক মার্টিন। ‘এক জীবনে এই জুতা না পারলে জীবনটাই মিছে’ টাইপের একটা অনুভূতি। আমি নিশ্চিত এই জুতা জোড়া পরলে পরে আমার গেরাইম্মা ভাবটা কিছুটা হলেও কাটবে। এত বছর এই শহরে থাকি কিন্তু সাহেব সাহেব ভাবটা এখনো কেন জানি এল না। কত ফ্যাশনেবল জামাকাপড় কিনেছি। চুলটা কায়দা করে কাটানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু ঐ ভাবটা একদমই আসে না। এই জুতা জোড়া পরলে যে সেই ভাবটা আসবে এটা একেবারে নিশ্চিত হতে গেলাম। আর জুতা যে ব্যাক্তিত্ব বিকাশে অনন্য ভূমিকা রাখে এ নিয়ে তো জগত বিখ্যাত সাময়িকী ‘রিডার্স ডাইজেস্ট’-এ একটি বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে ক’বছর আগে। What Your Shoes Say About Your Personality শিরোনামের নিবন্ধে খুব পরিস্কার করে লিখেছে বিভিন্ন ধরণের জুতার সাথে ব্যাক্তিত্বের সম্পর্ক। ‘ডক মার্টিন’ যারা পছন্দ করে তারা অন্য মানুষের চাইতে চিন্তায় এগিয়ে থাক। তারা সব কিছুই করে পরিকল্পনা মাফিক। তো আর অপেক্ষা চলে না। চলে গেলাম দোকানীর গোপন ঘরে, মানে ইনবক্সে। সেই একই কথা, আমার জন্য বিশেষ দাম। কিনে ফেললাম।
দু’দিন বাদে ডেলিভারি। আমি বাসায় নেই। গিন্নি টেলিফোনে রাগে গজগজ করল কিছুক্ষণ। এত টাকা দিয়ে এটা কী কিনেছ! বলে ফোন কেটে দিল। তবে নিরাশ করেনি। দাম চুকিয়ে দিয়ে জুতা জোড়া রেখে দিল। আমার ভিতরে শৈশবের পুলক। রাতে বাসায় ফিরে জুতা জোড়া পায়ে দিয়ে দেখতে গেলাম। কিন্তু এ কী? পা তো মোটেই ঢুকছে না। জুতার বক্সে এবং জুতার তলিতে নম্বর দেখলাম। নম্বর মিলছে। তবে লাগছে না কেন। আমার কি তাহলে ‘ডক মার্টিন’ পরা হবে না। পরদিন সকালে বিক্রেতাকে ফোন দিলাম।
‘এমন তো হওয়ার কথা নয় স্যার’ বলে অনেক সমাধান বাতলে দিলেন। স্যার একটু কষ্ট করে পরুন। ক’দিন পর জুতা ছাড়বে তখন কোন সমস্যা হবে না ইত্যাদি। সে যাই হোক, যা পায়ে ঢোকে না তা কি আর ঠিক হয়! তো সপ্তাহ খানেক পর আবার ফোন দিলাম। এবার ভালো একটা পরামর্শ পেলাম, স্যার আপনি আমাদের পেজ থেকে আরেক জোড়া জুতা পছন্দ করুন আমরা চেন্জ করে দেব। অনেক দেখেটেখে একজোড়া পছন্দ করলাম। এই জোড়ার উপর ২৫% ডিসকাউন্ট ঘোষনা করা আছে। আবার সেই ইনবক্সে গেলাম, পছন্দের কথা জানালাম। ওরা এবার কিন্তু মোক্ষম সুযোগটা নিল। ‘স্যার, একচেঞ্জে কিন্তু ডিসকাউন্ট হবে না। ওরিজিনাল দাম দিতে হবে।’ সুযোগ আর কাকে বলে! কী আর করা। তবু যদি জুতাজোড়া পায়ে দিয়ে একটু স্মার্ট হতে পারি আর কি! যদিও নতুন জোড়া ‘ডক মার্টিন’ নয়।
দু দিন বাদে কলিং বেল। নতুন জুতা দিয়ে গেল। আগের জোড়া নিয়ে গেল। বাড়তি কিছু টাকা দিতে হলো। সেই সাথে এটাও বলে গেল, আর কিন্তু একচেঞ্জ হবে না স্যার। হ্যা, জুতার নম্বর কিন্তু ঠিকঠাক আছে। এবার পায়ে দিয়ে দেখে নেয়া। জুতার পা গলাতেই আক্কেল গুড়ুম। ছোটবেলায় বাবার জুতা পায়ে দেয়ার মত অবস্থা।
বলুন, আর কি এই বেলতলায় যাওয়া যায়?
মোহাম্মদ শাহ আলম: লেখক ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ।
আগের লেখা পড়ুন: