বেলারুশ: প্রতিহিংসার সাম্রাজ্য
বিপ্লব শাহরিয়ার, প্রবাসী সাংবাদিক
প্রকাশিত: ১২:৩৫ এএম, ২৭ মে ২০২১ বৃহস্পতিবার আপডেট: ০৬:৩৬ পিএম, ৯ জুন ২০২১ বুধবার
বেলারুশ
ভিন্নমতের এক সাংবাদিককে অপহরণ করে আক্ষরিক অর্থেই ইউরোপিয় ইউনিয়নের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছেন বেলারুশের শাসক আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো। বলা চলে ইইউ কে তিনি অবমূল্যায়ন করেছেন।
লিথুয়ানিয়ায় অবতরণের কিছু সময় আগে রায়ান এয়ারের ফ্লাইট-৪৯৭৮ কে যখন ঘুরিয়ে দেয়া হয়, তরুন সাংবাদিক রোমান প্রোতাশেভিচ তখনই সন্দেহ করেছিলেন- কি ঘটতে চলেছে? সহযাত্রীরা দেখেছিলেন, ভয়ে কিভাবে কাঁপছিলেন প্রোতাশেভিচ।মিনস্কে জোরপূর্বক অবতরণ করানোর পর বেলারুশের স্বৈরশাসক লুকাশেঙ্কোর নিরাপত্তা বাহিনী ২৬ বছর বয়সী তরুনকে টেনেহিঁচড়ে উড়োজাহাজ থেকে নামায়। পরে প্রকাশ করা হয় তার একটি ভিডিও। যেটিতে গণ-বিক্ষোভ সংগঠনের দায় স্বীকার করেছেন প্রোতাশেভিচ। খালি চোখে দেখেই বোঝা যায়, ভিডিও জোরপূর্বক ধারণ করা এবং আশপাশ থেকে কেউ তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এই তরুণ বেলারুশে একটি সংবাদভিত্তিক চ্যানেলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। একারণেই তিনি কারাদণ্ড, সম্ভবত মৃত্যুদণ্ডের হুমকিতে ছিলেন। প্রিয় পাঠক, প্রতিহিংসার রাজ্যে আপনাদের স্বাগত।
আকাশ-দস্যূতার পরদিনই বেলারুশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইউরোপিয় ইউনিয়ন।ইউরোপিয় মান কিংবা অতীত অভিজ্ঞতা বিবেচনায়, এই সিদ্ধান্তটি হাইপারসোনিক গতিতে নেয়া হয়। একারণেই ইইউভুক্ত দেশগুলো এই সিদ্ধান্তে বেশ সন্তুষ্ট।অস্বীকার করা যাবে না যে, সিদ্ধান্ত নেয়ার দ্রুতগতি, কখনো কখনো সাফল্য এনে দেয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, লুকাশেঙ্কোর মতো শাসকের সঙ্গে ইউরোপের কি ধরনের কৌশলগত আচরণ করা উচিৎ?
যুদ্ধবিমান দিয়ে আকাশ থেকে একটি যাত্রীবাহী উড়োজাহাজকে কার্যত ছিনতাই করে লুকাশেঙ্কো বেলারুশের অভ্যন্তরীণ সংঘাতকে গোটা বিশ্বের সামনে নিয়ে এলেন। ইইউ'র বৃহৎ পরাশক্তি জার্মানিতে এক ধরনের অবাস্তব রাজনৈতিক অবস্থান আছে। সেটি কি? যদি দূরের কোনো দেশের স্বৈরশাসক তার জনগণের উপর অত্যাচার চালায়, তবে তা থেকে দূরে থাকো। কারণ এ ধরনের ঘটনা 'ইউরোপকে প্রভাবিত করেনা'। কিন্তু বেলারুশের এই ঘটনা জার্মানিকে ওই রাজনৈতিক অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য করেছে।সে ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছেন লুকাশেঙ্কো নিজেই।
পররাষ্ট্রনীতিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে অভ্যন্তরীণ সংঘাতকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন এই স্বৈরশাসক।ন্যাটো কিংবা ইউরোপিয় ইউনয়নকে নয় বরং নিজ দেশের জনগণকেই বড় হুমকি মনে করেন তিনি। নিজ জনগণকে হুমকি মনে করার যথেষ্ট কারণ অবশ্য আছে। মুলত গেলো বছরের ভোট চুরির পর থেকেই বেলারুশের জনগণ লুকাশেঙ্কোর হাত থেকে রেহাই চাইছিলেন। এই গণ-বিক্ষোভ থেকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন হয়তো তাকে উদ্ধার করতে পারতেন। কিন্তু তার আগে, লুকাশেঙ্কো নিজেই তৈরি করে ফেললেন গভীর এক সঙ্কট। কিন্তু এমন চরম পদক্ষেপ কেন? কারণটা সম্ভবত এটাই যে, ক্ষমতায় টিকে থাকতে সব স্বৈরশাসকই অভ্যন্তরীণ এবং বৈশ্বিক সব ধরনের সীমা লঙ্ঘন করেন।
বেলারুশে নিপীড়নের সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছেন লুকাশেঙ্কো। বিক্ষোভকারীদের জেলে ঢুকিয়ে চালানো হচ্ছে নির্যাতন।এমনকি গুলি করে মেরেও ফেলা হচ্ছে। নির্যাতন-নিপীড়ন চালাতে চালাতে এতটাই উন্মত্ত হয়ে পড়েছেন যে, ভিন্ন মতাবলম্বীদের তিনি এখন তাড়া করছেন দেশের সীমানার বাইরে গিয়ে। তার এজেন্টরা এথেন্স ছাড়ার আগে থেকেই প্রোতাশেভিচের পেছনে ছায়ার মতো লেগেছিলেন।
রাশিয়ার দিকে তাকালেও শাসকদের এমন চরিত্র এবং নির্যাতনের নজির মিলবে।২০১২ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর ব্যাপক সহিংস বিক্ষোভের মুখে পড়েন প্রেসিডেন্ট পুতিন। এর ফল হয়তো সবারই জানা। শুরুতেই দেশের ভেতরে ব্যাপক দমন-পীড়ন শুরু করেন পুতিন। দুই বছর পরই দখল করে নেন ক্রিমিয়া। একীভূত করে নেন রাশিয়ান ফেডারেশনের সাথে। এর ফলে ইউরোপের পূর্বাঞ্চলে নিজের শক্তি দেখাতে শুরু করেন পুতিন। এরপর হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেন ইউরোপের পশ্চিমাঞ্চলে। ২০১৯ সালের ২৩ আগস্ট বার্লিনের একটি চিড়িয়াখানায় দিনের বেলাতেই গুলি করে হত্যা করা হয় সাবেক চেচনিয় বিদ্রোহী নেতা সেলিম খান খানগো মভিলিকে। মস্কোর নির্দেশে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয় বলে অভিযোগ করে আসছে বার্লিন।
নির্বাচনে কারচুপি করার মাধ্যমে লুকাশেঙ্কো নিজেই নিজেকে পুতিনের হাতে সঁপে দিয়েছেন।গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে তিনি ব্যবহার করছেন যথেচ্ছভাবে। বেলারুশের গোয়েন্দাদের কাছে গোটা ইউরোপই যেন এখন অপহরণ, স্নায়ু-গ্যাস ব্যবহার এবং হত্যার অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু ইউরোপ কতটা সঠিক প্রক্রিয়ায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে? তাড়াহুড়ো করে যে সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়েছে তা হলো, ইউরোপের আকাশ সীমায় বেলারুশের রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থার উপর উড্ডয়ন নিষেধাজ্ঞা। এটি কেবলমাত্র একটি স্বল্পমেয়াদী পদক্ষেপ।কারণ স্থলসীমান্ত নির্ভর রুটগুলোকে কঠিন করে দিয়েছেন লুকাশেঙ্কো।ইইউ'র এই নিষেধাজ্ঞা বেলারুশের নাগরিক সমাজের জন্যও একটি বড় বাধা। কারণ চাইলেই তারা এখন ইউরোপে যেতে পারবেন না।কাজেই মধ্যম মেয়াদী পদক্ষেপ নিলেই বরং সমস্যার সমাধান আসতে পারে।
সর্বোপরি, ইউরোপকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে।রুশ এবং বেলারুশ গোয়েন্দারা দীর্ঘদিন ধরেই ইউরোপের ভেতরে অবাধে যাতায়াত করতে পারছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, কাউন্টার-এসপিওনাজে বড় ধরনের বিনিয়োগ করবে ইউরোপিয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্য। পূর্ব ইউরোপ এবং ইইউ'র সহযোগী গোয়েন্দা সংস্থা গুলোয় অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সাইবার প্রতিরক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতেই হবে। কারণ রাশিয়া এবং বেলারুশের শত্রুপক্ষ হিসেবে বিবেচিত ইউরোপীয় দেশগুলো ইইউ'র কাছ থেকে সুরক্ষা পাওয়ার দাবি রাখে।
আকাশ-দস্যূতার মধ্য দিয়ে লুকাশেঙ্কো সম্ভবত মুক্ত সিভিল এভিয়েশন সংক্রান্ত শিকাগো কনভেনশন লঙ্ঘন করেছেন।১৭১ জনযাত্রীবাহী একটি উড়োজাহাজকে অপহরণ করে মিনস্কে নিয়ে যেতে তিনি যুদ্ধবিমান ব্যবহার করেছেন। একজন সাধারণ আকাশ-দস্যূর সঙ্গে তার পার্থক্য আছে কিনা, আদালতকেই তা পরিষ্কার করতে হবে।তিনি সম্ভবত শিগগিরই আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাওয়া একজন শাসক হতে চলেছেন।
ইউরোপিয় ইউনিয়ন হয়তো বেলারুশের বিরুদ্ধে আরেকটি পদক্ষেপ নিতে পারতো। সেটি অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা।কিন্তু এর সরাসরি প্রভাব পড়তো বেলারুশের জনগণের উপর। হুমকিতে পড়তো তাদের চাকরি এবং রোজগার।কিন্তু দেশটিতে রাষ্ট্রায়াত্ত্ব অনেক প্রতিষ্ঠান আছে। এখানকার পটাস সার, মেশিন এবং তেল পরিশোধনকারী কারখানাগুলো মূলত ইউরোপিয় ইউনিয়নে পণ্য রপ্তানি করেই টিকে আছে। কাজেই পণ্য কিংবা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলে হুমকিতে পড়বে লুকাশেঙ্কোর জাতীয় বাজেট।
সেই পদক্ষেপ ইতোমধ্যেই নিয়ে ফেলেছে ইউরোপিয় ইউনিয়ন। বাড়ানো হয়েছে বেলারুশের বিরুদ্ধে আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা।নতুন করে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে বেশকিছু ব্যক্তি এবং সংস্থাকে।প্রেসিডিন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোসহ বেলারুশের বেশ কিছু রাজনীতিবিদ এই তালিকার অন্তর্ভূক্ত।
পরিশেষে বলতে চাই, কৌশলগত ধৈর্যই ইউরোপিয় ইউনিয়নের প্রধান গুণ। রাশিয়ার আয়ের প্রধান উৎস তেল ও গ্যাস রপ্তানি।রাশিয়ার তেল প্রক্রিয়াজতকরণ এবং ইউরোজোনে তা রপ্তানি করে লাভের গুড় খাচ্ছে বেলারুশ।কাজেই জীবাশ্ম জ্বালানিকে ইইউ যত বেশি বিদায় জানাবে, ততই ডুবতে থাকবে রুশ এবং বেলারুশের স্বৈরশাসকদের অর্থনীতি।
বিপ্লব শাহরিয়ার: জার্মান প্রবাসী সাংবাদিক।