শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪ || ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

তথ্য ‘চুরি’ সাংবাদিকতার ইতিহাসের সমান বয়সী

মাহমুদ মেনন, সাংবাদিক ও শিক্ষক

১১:০১, ১৮ মে ২০২১

আপডেট: ১২:১২, ১৮ মে ২০২১

১৭১৭

তথ্য ‘চুরি’ সাংবাদিকতার ইতিহাসের সমান বয়সী

মাহমুদ মেনন
মাহমুদ মেনন

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের ওয়েবসাইটে ঢুকে অনেক কিছুই চোখে পড়বে। তবে পেইজটির নিচের দিকে রয়েছে 'কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন চিত্র' শিরোনামে একটি লিঙ্ক। সে লিঙ্ক দেখে যে কারোই মনে হতে পারে, বাহ এখান থেকেই মিলবে ভ্যাকসিন সংক্রান্ত তথ্য। কিন্তু ক্লিক করলে দেখতে পাবেন- এখানে ভ্যাকসিন সম্পর্কিত সবশেষ তথ্য দেওয়া হয়েছে ১৮ এপ্রিল তারিখের। 

করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশে স্বাস্থ্য বিষয়ক সাংবাদিকতা অনেকাংশেই সংবাদবিজ্ঞপ্তিভিত্তিক হয়ে উঠেছে। স্বাস্থ্যবিষয়ক সংবাদে এই নির্ভরতার সময় এক বছর ঘুরে আরও কয়েকমাসে পড়লো। সাংবাদিকরা, বিশেষ করে স্বাস্থ্য বিটের রিপোর্টাররা অপেক্ষায় থাকেন কখন কোভিড-১৯ সংক্রমন বিষয়ক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিটি আসবে। কখন আসবে ভ্যাকসিন সংক্রান্ত সংবাদবিজ্ঞপ্তিটি। কোনো কোনো সংবাদকর্মী হয়তো ওয়েবসাইট ঘেঁটেও কিছু তথ্য নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী কিছু একটা লেখার চেষ্টা করেন। গত এক বছরে কোভিড-১৯ নিয়ে স্বাস্থ্য বিষয়ক রিপোর্টিং এই প্রেসরিলিজ সর্বস্বই ছিলো বলা চলে। 

বিশ্বে আমরা এই কোভিড-১৯ এর কত কত সংবাদ দেখেছি, কিন্তু বাংলাদেশে তা সম্ভবই ছিলো না। একটি খবরের জন্য তথ্যের প্রাপ্তিটাই জরুরি। তথ্য থাকলে তার বিশ্লেষণে হয়তো বেরিয়ে আসতে পারে কোনো প্রতিবেদন। আমরা এই ভেবে খুশিও ছিলাম, কিংবা রয়েছি যে, স্বাস্থ্য বিভাগ প্রতিদিন একটি সংবাদবিজ্ঞপ্তি পাঠাচ্ছে। তা দিয়ে অন্তত দেশের জনগণকে কোভিড-১৯ এর একটি আপডেট দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। 

'পরিসংখ্যান'কে থার্ড লাই হিসেবে বলার প্রচলন আছে। আর সাংবাদিকতায় পরিসংখ্যানমাত্রই 'সন্দেহ' করার তাত্বিক শিক্ষাও রয়েছে। বলাই হয়েছে, ডাউট ফার্স্ট। চেক, ক্রস চেক অ্যান্ড দেন রাইট। মানে দেখামাত্রই সন্দেহ করো, চেক করো, মিলিয়ে নাও। তারপরে লিখো, প্রকাশ করো। গত বছরাধিককালে এই চেক ক্রস চেক করার সুযোগ সামান্যই ছিলো সাংবাদিকের হাতে। ফলে স্বাস্থ্য দফতরের দেওয়া তথ্য বিনাবাক্যব্যয়ে সংবাদমাধ্যমগুলো প্রকাশ ও প্রচার করে গেছে। 

আপনি তখনই কোনো কিছু ক্রস চেক করতে পারবেন, যখন আপনার কাছে বিকল্প তথ্য থাকবে। কোভিড-১৯ নিয়ে কোনো বিকল্প তথ্য বাংলাদেশের সংবাদকর্মীদের সামনে নেই। ফলে একমাত্র সহায় হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্যেই ভরসা। সেই তথ্যই সবশেষ আপডেট রয়েছে ১৮ এপ্রিল ২০২১ পর্যন্ত। দৈনিক প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার রোজিনা ইসলাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আটক ও হেনস্থার শিকার হয়েছেন ১৭ মে। বলা হয়েছে, করোনার ভ্যাকসিন সংক্রান্ত নথিপত্র সংগ্রহে গিয়েই তিনি এই হেনস্থার শিকার হন।

একমাসের তথ্য যখন সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগে আপডেটেড না থাকে, একজন সংবাদকর্মী বিকল্প হিসেবে তা সংগ্রহ করতে যাবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। সেখানে, তাকে কেনো আটকে রাখতে হবে। তাহলে প্রশ্ন ভ্যাকসিন নিয়ে সত্যিই কি 'খারাপ' কোনো তথ্য স্বাস্থ্যে রয়েছে যা মন্ত্রণালয় প্রকাশ করতে চায় না। চায় না বলেই তারা ওয়েবসাইটেও তার আপডেট দিচ্ছে না। এবং কোনো মিডিয়ায় তা আসুক তা তারা চাইছে না। যদি তেমনটাই হয়ে থাকে- তা কেনো?

আরও পড়ুন: তথ্য ‘চুরি’ সাংবাদিকতার ইতিহাসের সমান বয়সী

স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় দুর্নীতির আখড়া, তা কে না জানে! ওপেন সিক্রেট। চুরি, অর্থলোপাট, দুর্নীতি, ঘুষ, নিয়োগবাণিজ্য, অনিয়ম, অন্যায়, এমন সব শব্দ একবার গুগল সার্চ ইঞ্জিনে ফেলেই দেখুন না, দেখবেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নামটি অবধারিতভাবে সামনে আসবে। কারণ এ নিয়ে লেখালেখি কম হয়নি। এইসব লেখালেখি হলে যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু যেয়ে আসে না, সে কথাও কিন্তু এখন সাংবাদিকদের জানা। কিছুতেই কিছু হয় না। এই কোভিড কালে কত কেলেঙ্কারি ধরা পড়লো, রিপোর্ট হলো। রিজেন্টের সাহেদ, গাড়িচালক মালেক এদেরকে ঘিরে দুর্নীতি-ঘুষ-বাণিজ্যের খবর লিখতে গিয়ে সংবাদকর্মীরা দেখেছেন- তা কিচ্ছাকাহিনীকেও হার মানায়। সংবাদ লেখা হয়েছে, তারপরেও স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ে হয়েছে, হচ্ছে অশেষ দুর্নীতি। তারও কিছু কিছু তথ্য আমরা সংবাদ মাধ্যমে দেখেছি। রোজিনা ইসলামের রিপোর্টিংয়েও বেড়িয়ে এসেছে ঘুষ লেনদেনের কথপোকথন- 'এখন এক কোটি দেবো, পরে আরো পাবেন'!! 

বস্তুত কোভিড-১৯ নামের একটি ভাইরাসের ছোবলে যখন গোটা বিশ্ব লন্ডভন্ড। বাংলাদেশ এই ভাইরাসের মরণকামড় সামলাতে ব্যস্ত। একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাসের কাছে ভীতসন্ত্রস্ত সকলে। তখন একটি আশা অবশ্যই জেগেছিলো, অন্তত এই বিষয়টিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো এমন কোনো অন্যায় করবে না, যা ক্ষতিই ডেকে আনে। কিন্তু ‌'চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী' এই আপ্তবাক্যকে সঠিক প্রমাণ করেছে এই স্বাস্থ্যবিভাগ। ফলে খবর এসেছে- ‌'৩৫০ কোটি টাকার জরুরি কেনাকাটায় অনিয়ম', 'পড়ে রয়েছে জীবন রক্ষাকারী সামগ্রী' এমন সব শিরোনামে। 

শুরু থেকেই যে প্রশ্নটি করে আসছি, ভ্যাকসিন নিয়ে কি এমন তথ্য রয়েছে এই স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে, যা গোপণ করতে হবে। ভ্যাকসিন সংক্রান্ত তথ্য বলতে তো এটাই যে ভারত আমাদের চুক্তি করার পরেও ভ্যাকসিন দিচ্ছে না, রাশিয়া থেকে আমরা ভ্যাকসিন আনার চেষ্টা করছি, চীন আমাদের ভ্যাকসিন দিতে চাইছে। তাতে হয়েছে কি? ভ্যাকসিন নিয়ে গোটা বিশ্ব একটা ভালনারেবল অবস্থায় রয়েছে। এতে সরকারের ভালনারেবলিটির বিষয়টি এখন দেশের প্রতিটি সচেতন মানুষমাত্রই জানা। চাইলেই যে ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে, তাতো নয়। আর কোভিড-১৯ এমন একটি বিষয় যা দেশের প্রতিটি মানুষকে কোনো না কোনো ভাবে এফেক্টেড করেছে। হয় সরাসরি সংক্রমণ দিয়ে, নয়তো কাছের মানুষকে সংক্রমিত হওয়া দিয়ে কিংবা প্রিয়জনের মৃত্যু দিয়ে। সুতরাং প্রতিটি মানুষের কাছেই এই ভ্যাকসিন সংক্রান্ত তথ্য জরুরি। সামান্য কোনো তথ্য যদি আশার আলো জ্বালাতে পারে তাতে দোষ কি? আর কিছু তথ্য যদি হতাশাও এনে দেয়, ভ্যাকসিন অ্যাভেইল্যাবিটির অতি বাস্তবতায়, সে টুকুও মানুষের জেনে থাকাই ভালো। কারণ তাতে তার প্রস্তুতিই থাকবে। আর একটি কথা তো আমরা বলছিই, ভ্যাকসিন কখন আসবে তার উপর ভরসা না করে, আমাদের নিজ নিজ সচেতনতা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এসবই জরুরি। 

আর কোন তথ্যই আপনি গোপণ রাখবেন? এই ভার্চুয়াল জগতে কোনো তথ্য কখনোই গোপণ রাখা সম্ভব নয়। 

বলা হয়েছে রাষ্ট্রীয় গোপণীয়তার তথ্য। মন্ত্রণালয়ের দায়েরকৃত মামলার বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়েছে, রোজিনা ইসলাম এমন কিছু তথ্য পেয়ে গেছেন যে গুলো প্রকাশ করলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। দেশের কোন ক্ষতিটি কবে কোন সংবাদপত্র করেছে? বাংলাদেশের সাংবাদিকতা চর্চা তার গুনাবলীর বিচারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, এ কথা সত্য। কিন্তু তার পরেও আমি হলফ করে বলতে পারি- বাংলাদেশের কোনো একটি মিডিয়া এখন পর্যন্ত কোনো একটি খবরও প্রকাশ করেনি, যাতে রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। 

তর্কের খাতিরে যদি ধরেই নেই- রোজিনা ইসলাম এমন কিছু তথ্য পেয়ে গিয়েছিলেন যা প্রকাশ করা হলে কিছু দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক খারাপ হতে পারে। আপনারা কী ভেবেছিলেন, রোজিনা নিয়ে গেলেই তার সংবাদপত্র তা ছেপে দিতো? অদ্ভুত ভাবনা। কারণ রোজিনার উপরে অন্তত তিনটি টায়ার রয়েছে যারা ওই খবর প্রকাশের প্রোজ এন্য কনস ভেবে চিন্তে তবেই সিদ্ধান্ত নিতেন। তাদের লাখ লাখ টাকা বেতন দিয়ে রাখা হয়েছে এই বিবেচনাবোধের প্রয়োগটুকু করার জন্য।

রিপোর্টার যা পায়, তা সবই কি ছাপা হয়ে যায়। নিশ্চয়ই না। দীর্ঘ ২৫ বছরের সাংবাদিকতা ক্যারিয়ারে আমি নিজেও অনেক এমন প্রতিবেদন আটকে দিয়েছি এই বোধ থেকে যে, এতে সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াটি ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। রাষ্ট্রের ক্ষতিতো অনেক দূরের বিষয়। 

আর রোজিনা ইসলাম নিজেও একজন সেনসিবল জার্নালিস্ট। তারও রয়েছে দুই দশকের সাংবাদিকতা ক্যারিয়ার। তার কোনো কোনো প্রতিবেদন দেশে যুগান্তকারী ভূমিকাও রেখেছে। অনিয়মগুলো যারা করে, তারা কোনোভাবেই রাষ্ট্রের চিন্তা করেনা। সরকারের একটি টাকার তসরুফও কিন্তু রাষ্ট্রেরই ক্ষতি। এই ক্ষতিগুলো যারা নির্দ্ধিধায় করে চলে, বছরের পর বছর করে চলে, তার ছিঁটেফোটাই হয়তো সাংবাদিকরা জানতে পারে ও সামনে আনে। তাহলে রাষ্ট্রের ক্ষতিটি কে করছে, কে ভালো করছে তা বিবেচনাবোধসম্পন্ন মানুষমাত্রই উপলব্দি করতে পারবে। 

রোজিনার মামলা আদালত পর্যন্ত গড়াচ্ছে। আমি মনে করি, এই বিচার প্রক্রিয়া রোজিনা ইসলাম দৃঢ়তার সাথেই মোকাবেলা করতে পারবে। ন্যয্য বিচারে এটা নিশ্চিত করেই প্রমাণিত হবে- চাইলেই একজন সাংবাদিককে ঠুনকো কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রাখা যায় না, তার গলা চেপে রাখা যায় না। বিষয়টি বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যে যাওয়াতে ভালোই হয়েছে। আশা করি সে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই হবে সাংবাদিকতার জয়। 

আর রোজিনা ইসলামের আরও একটি বিষয়ে চূড়ান্ত সতর্ক থাকতে হবে সেটি হচ্ছে তার সোর্সকে প্রোটেক্ট করা। কোনোভাবেই যেনো কেউ জানতে না পারে, কে দিচ্ছিলেন তাকে ওই তথ্য। মেকানিজমের মধ্যেই কিছু কিছু মানুষ বসে থাকেন যারা চান- অন্যায়গুলো প্রকাশিত হোক। রাষ্ট্রের ধন চুরি করে রাষ্ট্রের ক্ষতি করতে চাননা এমন মানুষের সংখ্যা এখনো প্রশাসনে বেশি। তাদের গোপণে দেওয়া তথ্যেই সাংবাদিকতা চলে। কেউ যদি একে 'চুরি' বলতে চান, বলতে পারেন- কারণ সাংবাদিকতায় এমন 'চুরি' তার ইতিহাসের সমান বয়সি। এসব করেই বিশ্বের বাঘা বাঘা সাংবাদিকরা বড় বড় পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। রোজিনা ইসলামও হয়েছেন। সাংবাদিকতার জয় হোক।   

মাহমুদ মেনন: সম্পাদক, অপরাজেয় বাংলা।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank