শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪ || ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

লকডাউন, জীবন জীবিকা ও সরকারের দায়বদ্ধতা 

ওমর তাসিক, সাংবাদিক ও লেখক

১৬:০২, ৯ এপ্রিল ২০২১

আপডেট: ১৬:০৭, ৯ এপ্রিল ২০২১

১০৬০

লকডাউন, জীবন জীবিকা ও সরকারের দায়বদ্ধতা 

২০২০ সালে প্রথমবার করোনা হানা দিলে, মানুষ যেমন ভয় পেয়েছিলো তেমনি সরকারও অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে তা মোকাবেলার চেষ্টা করেছিলো। সরকার সেসময় সাধারণ ছূটি ঘোষণা করে লকডাউনের বিকল্প ব্যবস্থা নেয় ও পাশাপাশি মানুষের  অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য প্রনোদনা ঋণের ব্যবস্থাও নেয়। যদিও এসব ব্যবস্থায় নানান ভুল ত্রুটি ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ রয়েছে। 

সেসময় সরকার ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ঠিক করতে তেমন কিছু না করতে পারলেও মানুষকে ঘরে আটকে রাখার জন্য বেশ কিছু কার্যকর ব্যাবস্থা নিয়েছিলো। পাশাপাশি প্রতিদিন প্রধানমন্ত্রী নিজে প্রত্যেক জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে আলোচনা করে এলাকাভিত্তিক সমস্যা সমাধানের যথেষ্ট চেষ্টা করেন। 

এবার ২০২১ এর মার্চ মাসে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানলো। মার্চের মাঝামাঝি থেকে সংক্রমণ ও মৃতের সংখ্যা এমনভাবে বাড়তে শুরু করলো যে বুঝতে বাকি রইলো না, এবারের ধাক্কাটা আরো ভয়াবহ হবে। মার্চের শেষ সপ্তাহে সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঊর্ধ্বগতি এক ভয়াবহ রূপ নিলো, কিন্তু কেনো যেনো সরকারকে অপেক্ষাকৃত নির্লিপ্ত দেখা গেলো। 

করোনার ঊর্ধ্বগামী পরিস্থিতি নিয়ে গণমাধ্যমে প্রচণ্ড হৈচৈ শুরু হলে সরকার সম্বিৎ ফিরে পেলেও কেমন যেনো এলোমেলো আচরণ দেখা যাচ্ছে। যখন মানুষ জীবন বাঁচানোর জন্য হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটোছুটি শুরু করে তখন হঠাৎ করেই  সরকার সাতদিনের জন্য লকডাউনের ঘোষণা দেয় কিন্তু যেদিন থেকে লকডাউন শুরু হওয়ার ঘোষণা দেয়া হলো, বলা হলো তার তিনদিন পর সেই লকডাউনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দেবেন। দেশের এই জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলার অনুমোদন পেতে তিন দিন লাগাটা যে এই মুহুর্তে সবার জন্য কত ক্ষতিকর তা হয়তো সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা বুঝতেই পারেননি। এছাড়া তাড়াহুড়ো করে যে ঘোষণাগুলো দেয়া হলো সেগুলোও ছিলো অত্যন্ত খাপছাড়া ও অকার্যকর। যেমন একদিকে বই মেলা চালু, অন্যদিকে দোকানপাট বন্ধ, আবার অফিস আদালত খোলা তো পরিবহন বন্ধ, অটোরিক্সা, রিক্সা, বাস সব চালু তো রাইড শেয়ার বন্ধ, কলকারখানা খোলা তো হোটেল রেস্টুরেন্ট বন্ধ, সব মিলিয়ে সংক্রমণ রোধে যে মানুষকে ঘরে থাকতে বাধ্য করতে হবে এবং শহরে জনসমাগম রোধ করতে হবে সেই ব্যবস্থা নেয়ার লক্ষণ সামান্যই দেখা গেলো। বরং হঠাৎ করে কোনো বিকল্প ব্যবস্থা না করে দোকানপাট ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে মধ্য ও নিম্ন মধ্যবিত্তের জীবন জীবিকার পথ রুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যার প্রতিবাদে ব্যবসায়ী-কর্মচারীরা পথে নেমে আন্দোলন শুরু করলো। সরকারের পক্ষে এই পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়লো। এই অবস্থায় সংক্রমণ যখন হুহু করে বাড়ছে তখন বাধ্য হয়ে সরকার আবার দোকানপাট সব কিছু খুলে দিলো। 

যা পুরোটাই এখন প্রহসন বলেই প্রতীয়মান। এক শ্রেণির সুবিধাবাদী গোষ্ঠী, টাউট ব্যবসায়ী ও বিশেষ করে ব্যাংকগুলো এর পূর্ণ ফয়দা লুটেছে আর এই অর্থ প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের কোনো কাজেই আসেনি। এর মূল কারণ হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের অপরিণামদর্শী, অপরিপক্ক ও হটকারি সিদ্ধান্ত। হটকারি সিদ্ধান্ত বলছি এই কারণে যে, প্রনোদনা কখনো ঋণ হয়না এবং আপদকালীন ঋণ পরিশোধের শর্ত আপদ কাটার আগেই হতে পারে না। 

সকল ব্যবসাবাণিজ্য বন্ধ হওয়া দুর্দশাগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য বরাদ্দকৃত ঐ প্রণোদনার অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে সরকারের ভুল নীতির কারণে ব্যংকগুলো যেসব নোংরামি করেছে সেকথা উল্লেখ না করলেই নয়।

এক) ব্যাংক ক্লায়েন্ট সম্পর্কের ভিত্তিতে এই প্রনোদনা ঋণ দেয়ার সরকারি নির্দেশ থাকার কারনে ব্যাংকগুলো শুধুমাত্র তাদের ঘনিষ্ঠ ক্লায়েন্টদের এই সুবিধা দিয়েছে। নামান্তরে যাদের সঙ্গে তাদের ঘুষের লেনদেনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে তাদেরকেই এই ঋণ দিয়েছে। 

দুই) আরেক শ্রেণির লোকদের ব্যংক ঋণ দিয়েছে যা দিয়ে তারা নিজেদের পুরনো খেলাপি ঋণের খাতা পরিষ্কার করেছে। অর্থাৎ আগে যারা খেলাপী ছিলো তাদের এই প্রনোদনা ঋণ অনুমোদন করে সেই অর্থ দিয়ে তাদের আগের ঋণের টাকা সমন্বয় করে ব্যবসায়ীদের খালি হাতে বিদায় করেছে। 

তিন) ঋণ বিতরণের সময় সরকারের প্রনোদনার ৪% এর ঋণের অংকের সঙ্গে নিজেদের ৯% এর অংকের সমপরিমাণ অর্থ ঋণ নিতে বাধ্য করেছে বিপদগ্রস্ত লোকদের। এরফলে ঋণ গ্রহিতাকে সুদের হার গুনতে হয়েছে ৬.৫% এবং এর সঙ্গে সরকারের দেয়া ভর্তুকির ৪% নিয়ে ব্যংকগুলো চাতুর্য্যের সঙ্গে ঠিকই ১০.৫% লাভ করে নেয়। 

এই ঠকবাজির মধ্যে পড়ে এই প্রহসনের প্রনোদনার অর্থ ব্যবসায়ীদের সামান্যতম কাজেও আসেনি। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো দেশে সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি যারা অর্থাৎ অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী যারা, তারা ব্যংক পর্যন্ত পৌঁছাতেই পারেনি। 

এখন আলোচনায় আসা যাক বর্তমান লকডাউন বা সাধারণ ছুটি বিষয়ক সংকট সমাধানের উপায় নিয়ে। সরকারের এতো, বিশেষজ্ঞ, এতো উপদেষ্টা, এতো পরামর্শক আছেন অথচ তাদের কেউ প্রত্যেক নাগরিকের কথা চিন্তা করে এই সংকট সমাধানের উপায় বের করার বাস্তবভিত্তিক পরামর্শ সরকারকে দেননি। এবার দেখা যাচ্ছে সরকার যেনো করোনার কাছে একধরনের অসহায় আত্মসমর্পণই করেছে।

তবে আমাদের বাঁচতে হলে এই মুহুর্তে সবকিছু বন্ধ করে সবাইকে ঘরে ঢুকানো ছাড়া অন্য কোনোই বিকল্প নেই তা মানতেই হবে। 

যদি সরকার আন্তরিকতার সঙ্গে দেশের করোনা সংক্রমণ রোধে সবাইকে ঘরে আটকে জীবিকার নামে টাকা লুটের ব্যবস্থা না করে এবং উচ্চবিত্তের স্বার্থ না দেখে, সৎ নিয়তে সবাইকে ভালো রাখতে চায় তাহলে গতবছর যেই অর্থ বরাদ্দ দিয়েছিলো তার চেয়ে কম অর্থেই অত্যন্ত সফলভাবে তা করতে পারবে। 

দেশে ক্ষুদ্র, অতি ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীর মোট সংখ্যা প্রায় এক কোটি ও দেশের সব শহরে সকল ব্যবসায় নিয়োজিত কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় দুই কোটি মানুষ। দেশে অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী যাদের পূঁজি ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা তাদের সংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ। আর ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী যাদের পূঁজি এক লাখ টাকা থেকে ৬০ লাখ টাকা তাদের সংখ্যা ২০  লাখ। এবং ১ কোটি টাকার চেয়ে অধিক পুঁজির ব্যবসায়ীর সংখ্যা ২০ লাখ। সেই হিসেবে প্রাথমিক ভাবে একমাসের জন্য লকডাউন দিলে সরকার যদি ৬০ লাখ অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ৮ হাজার টাকা করে অনুদান দেয়া হয় তাহলে সরকারকে ৪৮০০ শো কোটি টাকা দিতে হবে, আর ২০ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের যদি তাদের কর্মচারীদের অর্ধেক বেতন, প্রতিষ্ঠানের ভাড়া পাশাপাশি নিজেদের জীবন ধারণের জন্য ১ লাখ টাকা করে প্রদান করা হয় তাহলে সরকারকে ২০ হাজার কোটি টাকা দিতে হবে। এর বাইরে অন্যান্য পেশার মানুষ ও হতদরিদ্র যারা বিভিন্ন শহরে জীবিকার সন্ধানে আসে তাদের সহায়তার জন্য আরো ৫ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে অর্থাৎ সব মিলিয়ে এক মাসে  মোট মাত্র ৩০ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন আর যদি তা কোনো কারণে দু'মাস টানতে হয় তাতে ৬০ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। এর বাইরে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য ঋণের কিস্তি প্রদান বিলম্বসহ অন্যন্য আর্থিক সুবিধার ব্যবস্থা নিয়ে সংকট নিরসনের পদক্ষেপ পারে। অনুদানের অংক এই ক্রান্তিকালীন সময়ে সবাইকে রক্ষার জন্য সরকারের কাছে কিছুই না। এই টাকা দেশ থেকে প্রতি বছর বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া টাকা অথবা খেলাপী ঋণের টাকার চেয়ে অনেক কম। পক্ষান্তরে সরকার এই টাকা দিয়ে সবার জীবিকার ব্যবস্থা না করলে শক্ত লকডাউন কার্যকর করা কখনোই সম্ভব হবে না। 

সরকার যদি লকডাউন পরিস্থিতি সুন্দরভাবে মোকাবেলা করতে চায় তাহলে তাকে প্রতিটি খুটিনাটি বিষয় নিয়ে সুষ্ঠু ও বাস্তবসম্মত নির্দেশ দিতে হবে।  যেমন যারা বাসা, দোকান বা অফিস ভাড়ায় জীবিকা নির্বাহ করেন তাদের বিষয়টিও দেখতে হবে। দেখা যায় করোনার উসিলায় অনেক অসাধু ভাড়াটিয়া মাসের পর মাস ভাড়া না দিয়ে বাড়াকৃত জায়গা ব্যবহার করছে। সরকার যদি প্রত্যেক দোকান ও সাধারণ ব্যবসায়ীদের লকডাউন বা বন্ধকালীন তাদের মার্কেট মালিক, দোকান মালিক বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বাড়িওয়ালাকে অর্ধেক বাড়ি ভাড়া দেয়ার সুনির্দিষ্ট নির্দেশ দেয় এবং শর্ত দেয় যে এই সময় কেউ ভাড়া করা জায়গার অংশ বা পুরোটা ছাড়তে পারবে না। তাহলে আয় কম হলেও ভাড়ার উপর যারা জীবন যাপন করছেন তারাও করোনাকালে বিপদগ্রস্ত হবেনা। এসব দেখভালের জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত অত্যন্ত কার্যকরভাবে কাজ করতে পারে।

সরকার সকল ব্যবসায়িক সমিতি, স্থানীয় প্রসাশন, পৌর কর্পোরেশন ইত্যাদির সমন্বয় অত্যন্ত কঠোর প্রক্রিয়ায় প্রকৃত ব্যবসায়ী চিহ্নিত করে তাদের তালিকা করে স্পষ্ট চেক করে সকল দলিলাদি পরীক্ষান্তে এই প্রনোদনা দিতে পারে। 

অতন্ত সুচারুরূপে আর্থিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে পারলেই সরকার এই আধা-খ্যাঁচড়া লকডাউনের দ্বিধাগ্রস্ততা থেকে বেড়িয়ে এসে কঠিন শাস্তির বিধান রেখে কার্যকর লকডাউন দিয়ে হাজার হাজার মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারবে৷

ওমর তাসিকের ্‌আরো লেখা: 

** করোনাভাইরাস বাংলাদেশের জন্য আশির্বাদ বয়ে আনতে পারতো
 

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank