অভিজিৎ, অভিজিৎ রায়
অভিজিৎ, অভিজিৎ রায়
দীর্ঘশ্বাস কারও কাছে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, কারও কাছে গুরুত্বপূর্ণ। যারা ভাবে খুব স্বাভাবিক তারা গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসানো। এদেরকে কেউ কখনও মনে রাখে না, কেউ কখনও গুরুত্ব দেয় না। অভিজিৎ রায় আমাদের কাছে এক দীর্ঘশ্বাসের নাম। বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ নিনির্মাণে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা আর প্রসার ঘটানো এক নাম। অজ্ঞতার আষ্ট্রেপৃষ্ঠে জড়ানো সমাজ-মানসে পরিবর্তনপ্রত্যাশী আলোকের এক বহ্নিশিখা। তিনি নেই আজ ছয়বছর। ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের চাপাতির কোপে প্রাণ দিতে হয়েছে তাকে। জ্ঞানের আধার বইয়ের লৌকিক সাহচর্য আর বইমেলা থেকে ফেরার পথে তার মাথায় আঘাত করেছে অন্ধকারের আততায়ীরা। সে আঘাতে তার দেহ থেকে রক্তের ধারা বয়েছে, সিক্ত করেছে জ্ঞানচর্চার বিদ্যাপিঠের সেই এলাকা। লুটিয়ে পড়েছিলেন তিনি মাটিতে, তার রক্ত ছুঁয়েছিল দেশের মাটি। জন্মমাটিতে লুটিয়ে পড়া অভিজিৎ শেষ পর্যন্ত প্রাণ হারান। সমাপ্ত হয় এক অক্ষয় যুগের, থেমে যায় তার কলম; চিরদিনের জন্যে।
অভিজিৎ হত্যার পর তার লেখালেখি নিয়ে আরও বেশি আলোচনা হয়েছে। পশ্চাৎপদ মানসিকতার যারা তারাও আলোচনা করেছে। এই আলোচনায় গ্রহণের ঔদার্য ছিল না স্বাভাবিকভাবেই। তারা তার হত্যাকাণ্ডকে জায়েজিকরণে মেতেছিল পুরোদস্তুর। তাতে কী! এই সংকীর্ণতা-দৈন্য প্রভাব পড়েনি সমাজে; এ যে অগ্রসর আর অনগ্রসরের চিরায়ত দ্বন্দ্ব, একই সঙ্গে সাফল্য-ব্যর্থতার নিক্তি-যোগ যেখানে সফলেরা ঠিকই বেরিয়ে আসে নিজস্ব ভঙ্গিমায়। কুসংস্কার, লৌকিক বিশ্বাস আর বিজ্ঞানের চিরায়ত দ্বন্দ্ব ছিল লেখার জায়গা। তিনি লিখেছেন, জীবদ্দশায় যতটা পেরেছেন লিখেছেন। তার সেই লেখালেখির উদ্দিষ্টজনেরা সমকালে হাজার-হাজার থাকবে এমন ত না, এর নিকেশ নিশ্চয়ই মহাকালের কাছে। মহাকাল নির্ধারণ করে সত্যাসত্য, আর বিষয় যেখানে বিজ্ঞান আর বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা তখন সে ত সমকালের সমকালীন চিন্তা থেকে কয়েক ধাপ ওপরে।
অভিজিৎ রায়ের লেখালেখির বিরুদ্ধবাদীদের নেতিবাচক প্রচারণায় লাভবান হয়েছে বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তার জগত। ওই জগতের সীমা আরও প্রসারিত হয়েছে। আলোচনা নানা জায়গায় ওঠেছে, আর এতে অগ্রসর সমাজচিন্তার মানুষেরা তাকে খুঁজে পেয়েছে সহজেই। যার প্রভাব পড়বে, পড়তে বাধ্য আসলে। এই প্রভাব কিংবা পরিবর্তন প্রাথমিক পর্যায়ে বিপ্লব-রূপ হবে না ঠিক তবে কিছু কিংবা অনেক মানুষের চিন্তাজগতে স্বতন্ত্রভাবে আলোড়ন তুলবে। এতে করে এক-এক করে হাজার থেকে লক্ষ কিংবা পর্যায়ক্রমে এমন চিন্তা এবং এরচেয়েও অগ্রসর চিন্তার প্রসার ঘটবে। এই প্রসার-সম্ভাবনা অবশ্যম্ভাবী স্থানিক পর্যায় ভেদ করে বৈশ্বিক পর্যায়েও। আমাদের এখানে সমকালে তরুণদের মাঝে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অভিজিৎ রায়, আগেও ছিলেন অনেক, ভবিষ্যতে আসবেন আরও অনেকই হয়ত। নাম ভিন্ন, প্রক্রিয়া ভিন্ন, ভিন্ন উপস্থাপনাজগত অথচ অভিন্ন চিন্তাজগত সকলের, সংস্কার-পরিবর্তন।
অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয় দাশ, ফয়সাল আবেদীন দীপনদের হত্যার পর যত লোকের মুখের ওপর থেকে মুখোশ সরে গেছে তারাও চাপাতিওয়ালাদের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ সমর্থক। সব হাতে চাপাতি ওঠে না, তবে চাপাতিওয়ালারা তাদের ব্যক্তিগত দুই হাতের সঙ্গে আরও অনেক হাত খুঁজে, আরও অনেক মন খুঁজে সমর্থনের। তারা পেয়েছে। সরকার, প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন স্তর এবং এর বাইরে নিজেদেরকে প্রগতিশীল দাবিদার অনেকের কাছ থেকেই। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অভিজিৎ রায়- অনন্ত বিজয় দাশদের খুনের পর অনেকের ওপর থেকে বিশ্বাস ওঠে গেছে। ধর্মকে টিকিয়ে রাখতে শক্তিপ্রয়োগ দরকার- এমন বিশ্বাস জোর করে চাপিয়ে দিতে চেয়েছে একদল লোক ব্যক্তিগতভাবে, সাংগঠনিকভাবে। চাপাতিশক্তি, ৫৭ধারা শক্তি, হুমকিশক্তি, উসকানিশক্তি, সীমালঙ্ঘনশক্তি, বিচ্ছিন্নঘটনাশক্তি- এমনতর অগুনতি শক্তির কাছে নত হয়ে গেছি প্রকাশ্যে। নিরবচ্ছিন্ন প্রকাশ্য জীবন আকাশের মত দৃশ্যমান থাকলেও অদৃশ্য আততায়ী আতঙ্কে বিচ্ছিন্নতাসঙ্গে আপনাকে আলিঙ্গন করে অন্য অনেকেরই একজন হয়ে খুঁজছি বেঁচে থাকার অবলম্বন।
অভিজিৎ রায় তাঁর দেহ দিয়ে গেছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের কাজে ব্যবহারের জন্যে। অভিজিতের বিশ্বাসপ্রেমির মত অভিজিতের বিশ্বাসবিদ্বেষীদেরও সুযোগ নেই তাকে অগ্রাহ্য করার। মরে গিয়ে অভিজিৎ থাকছেন, বেঁচে থাকতে যতটা ছিলেন না। হত্যাকাণ্ডের ছয়বছরের মাথায় অভিজিৎ রায়ের হত্যা মামলার রায় হয়েছে। রায় হয়েছে অভিজিতের বইপ্রকাশের কারণে একই কায়দায় হত্যার শিকার হওয়া জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সাল আবেদীন দীপন হত্যাকাণ্ডের। এক মামলায় ছয়জনের দণ্ড আর আরেক মামলায় হয়েছে আটজনের দণ্ডের রায়। এদের মধ্যে অভিজিৎ হত্যার প্রকাশ্য উসকানিদাতা ফারাবীর হয়েছে যাবজ্জীবন দণ্ড। শুরুতে মনে হয়েছিল খুনিরা পার পেয়ে যাবে, বিচার হবে না; কিন্তু সব শঙ্কাকে দূরে ঠেলে দিয়ে এ দুই মামলার বিচারিক আদালতের রায় হয়েছে। দণ্ডপ্রাপ্ত একাধিক অপরাধী পলাতক যদিও তবু এই রায়গুলো উল্লেখযোগ্য, এই রায়গুলো বিচারিক দীর্ঘসূত্রিতার পথে সামান্য হলেও অন্তত বাঁধ সেধেছে। এই রায়গুলোর পর আমরা একই কায়দায় হত্যার শিকার হওয়া অনন্ত বিজয় দাশের হত্য মামলার রায়ের অপেক্ষায় আছি। অপেক্ষায় আছি পলাতক খুনিদের গ্রেপ্তার পরবর্তী তাদেরসহ দণ্ডপ্রাপ্ত সকলের রায় কার্যকরের।
অভিজিৎ রায়, আপনি বিশ্বাসী আর বিশ্বাস এ দুয়ের মধ্যে বিশ্বাসকে লেখার উপজীব্য করে বিশ্বাসীদের কট্টরভ্রান্তি নিরূপণের জন্যে যৌক্তিক লেখনীতে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। বিশ্বাসী নয়, বিশ্বাসকে তাই আলোচ্য করেছিলেন যৌক্তিকতার নিক্তিতে। আপনার এ লেখনীধারা অনেকেই নিয়েছে গ্রহণভঙ্গিতে, অনেকেই নিয়েছে উল্টোভাবে। যারা উল্টোভাবে নিয়ে উলটোপথে হেঁটেছে তারা আপনাকে বিশ্লেষণ করতে পারেনি। এটা তাদের ব্যর্থতা।
অভিজিৎ রায়, আজ আপনাকে যখন স্মরণ করছি তখন আপনি দীপন, ওয়াশিকুর, অনন্তবিজয়দের মত একইভাবে অনন্তপুরের যাত্রী। আপনি দৈহিকভাবে সকল কিছু উর্ধে ওঠে গেছেন। তবে আপনার লেখাগুলো আছে এখনও, থাকবে অনাদিকাল আপনার চিন্তার মৃত্যু ঘটেনি, লেখাগুলো আছে আগের চেয়ে আরও বেশি শক্তিমান হয়ে।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
- ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১: জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ’
- সুনীল অর্থনীতি ও রূপকল্প-২০৪১
- শিক্ষার ধরন ও বেকারত্ব: দেশে অশিক্ষিতদের চেয়ে শিক্ষিত বেকার ৩ গুন
- ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়
- ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস-১৯৬১ ও দ্বিপক্ষিয় কূটনীতিক সম্পর্ক
- মিডিয়ার শক্তি বা আসক্তি: ম্যাজিক বুলেটের বাকের ভাই ও বদি
- গণমাধ্যমে গণরুচির বিকার
- হালকা বিনোদনের প্রাধান্যে সংস্কৃতির অবনতি
- বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণার দিন শেষ, চার উপায়ে মধ্য আয়ের দেশ