বিআইএসআর ট্রাস্ট-এর বাৎসরিক পর্যালোচনা
সামাজিক সম্পর্কের গুরুত্ব উপলব্ধির বছর ২০২০
বিআইএসআর ট্রাস্ট-এর বাৎসরিক পর্যালোচনা
সামাজিক সম্পর্কের গুরুত্ব উপলব্ধির বছর ২০২০
বিগত ২০২০ সালে কোভিড-১৯ বা করোনা মহামারির ফলে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের ন্যায় বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মাঝেও বছরজুড়ে আতঙ্ক-উৎকন্ঠা বিরাজ করেছে। তবে সারাবছর ‘সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং’ উচ্চারিত হলেও বছরটি মূলত আমাদেরকে সামাজিক সম্পর্কের গুরুত্ব উপলব্ধি করিয়েছে। মানুষ যে সামাজিকভাবে পরষ্পর নির্ভরশীল এবং নিরন্তর মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে যুক্ত থাকে, করোনাকালীন আপাতঃ বিচ্ছিন্নতা মানুষকে বিষয়টি অনুভব করিয়েছে বারংবার।
প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরেও সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে তবে এবারের পরিবর্তনগুলো ছিলো অন্যরকম। কিছু কিছু ঘটনা বিভিন্ন স্তরের মানুষের মাঝে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করেছে। বছরটিতে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলি নি¤েœ উল্লেখ করা হল। বছরটিতে সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছে করোনার আঘাত। করোনার কারণে বছরের অর্ধেকের বেশি সময় ধরে সরকার ঘোষিত ‘সাধারণ ছুটি’ এবং ‘স্ব-আরোপিত নিষেধাজ্ঞা’-এর ফলে মানুষ এক ধরনের ‘গৃহবন্ধীত্ব’ বা লকডাউনে আবদ্ধ ছিলো যা মানুষের জীবনযাত্রাকে থমকে দিয়েছিলো। গত ৩০ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখ পর্যন্ত সারা বিশ্বে ৮ কোটি ২৩ লাখ ২৭ হাজার ৪৯৮ জন মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয় এবং ১৭ লাখ ৯৬ হাজার ৫৪৫ জন মানুষ ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। বিভিন্ন সংস্থার পূর্বাভাস অনুযায়ী বাংলাদেশ করোনার অন্যতম ঝুঁকিতে থাকলেও অন্যান্য বা পার্শ্ববর্তী দেশগুলির তুলনায় বাংলাদেশে প্রাণহানির সংখ্যা কমই ছিলো। গত ডিসেম্বর ৩০, ২০২০ তারিখ পর্যন্ত সারাদেশে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিলো ৫ লাখ ১১ হাজার ২৬১ জন এবং ৭ হাজার ৫০৯ জন রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
গত ২০২০ সাল ছিলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী যা ‘মুজিববর্ষ’ হিসেবে ঘোষিত হয়েছিলো। মুজিববর্ষকে ঘিরে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক সংগঠন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও কর্মসূচী ঘোষণা করলেও তার অধিকাংশই উদযাপন করা সম্ভব হয়নি মহামারির কারণে।
করোনার স্বাভাবিক মৃত্যুর মধ্যে মানুষ আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়লে প্রথম দিকে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিকে সামাজিকভাবে ‘একঘরে’ করে দেয়ার প্রবণতা দেখা যায়।এমনকি নিজ পরিবারের সদস্যকে করোনা আক্রান্ত সন্দেহ করে অন্যত্র ফেলে রাখার মত কয়েকটি অমানবিক ঘটনাও জানা গেছে। এছাড়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে করোনায় আক্রান্ত মৃত ব্যক্তির ‘মৃতদেহ’ এলাকায় ঢুকতে বাধা দেয়া ও দাফন বা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় বাধা দেয়ার ঘটনা জানা যায়। এই ধরনের সামাজিক পৃথকীকরণ বা বর্জন (সোশ্যাল আইসোলেশন) বাংলাদেশে আগে খুব একটা দেখা যায়নি।এ সব ক্ষেত্রে পুলিশসহ কিছু স্বেচ্ছাসেবককে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়। প্রথমদিকে করোনা আতঙ্কের কারণে অনেকেই চাল, লবণ, মাস্ক, স্যানিটাইজার, কিছু নির্দিষ্ট ধরনের ঔষধ ইত্যাদি অতিরিক্ত পরিমাণে ক্রয় করে মজুদ করে রাখলে বাজারে তাঁর কৃত্রিম সংকট ও উচ্চমূল্য তৈরি হয় যা সাধারণ ও নি¤œ আয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। এমন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য বিআইএসআর ট্রাস্টের প্রধান গবেষক ড. খুরশিদ আলম পরামর্শ প্রদান করেছেন যা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, যেমন: বাংলাদেশে করোনা বিস্তারের প্রথম দিকে দেশের যেসব অঞ্চলে কৃষকরা ধান ঘরে তুলেছিলো তাদের নিকট থেকে বিক্রয়যোগ্য ধান কিনে নিয়ে যাদের প্রয়োজন তাদেরকে দেওয়া; ব্যংকগুলো থেকে সরকারের ঋণ নেওয়া; বিদেশি সংস্থা থেকে ঋণ বা সহায়তা নেওয়া; নতুন নোট ছাপানো যদিও এক্ষেত্রে মুল্যস্ফীতি অনেক হবে বলে তিনি সতর্ক করেন, ইত্যাদি। এছাড়া, কিভাবে সহজেই বিভিন্ন উৎস থেকে দ্রুত সময়ের ভিতরে সরকার দরিদ্র লোকদের তালিকা করে সহায়তার সুষ্ঠু বন্টন করতে পারে সে বিষয়েও দিক নির্দেশনামূলক পরামর্শ দিয়েছেন।
করোনার কারণে এবছর প্রচুর মানুষ তাদের কর্ম হারিয়েছে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান কয়েকমাস তাদের কর্মীদের বেতন দিতে পারেনি আবার অনেক প্রতিষ্ঠান বেতন কর্তন করেছে বা আংশিক বেতন প্রদান করেছে। ফলশ্রুতিতে, কেউ কেউ ঢাকায় থাকার খরচ জোগাতে না পেরে স্থায়ীভাবে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে যায়। কিছু কিছু পরিবার ঢাকার আশে পাশে তুলনামুলক কম ভাড়ার ফ্ল্যাটে স্থানান্তরিত হয়েছে।করোনার কারণেঈদ এবং অন্যান্য সামাজিক উৎসবের আয়োজনকে সংক্ষিপ্ত করা হয়। এছাড়া ধর্মীয় উপাসনালয়গুলিতেও সমাগমের ক্ষেত্রে বিধি নিষেধ আরোপণ করা হয়। এ বিষয়গুলি নিয়ে মানুষের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়াও দেখা গেছে।
করোনার মধ্যে শহরের শিশুরা ও বয়স্করা সবথেকে বেশি ‘বিচ্ছিন্নতায়’ ভূগেছে। দীর্ঘসময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও সামাজিক আদান প্রদান বন্ধ থাকায় শিশুদের খেলাধুলা ও সামাজিক মিথস্ক্রিয়া ব্যাহত হয়েছে। তরুণরা ভার্চুয়াল মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ রক্ষা করতে পারলেও শিশু ও বৃদ্ধরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন থেকেছে। তবে, অনেক সংকটের মধ্যে থাকলেও করোনার সময় মানুষ পরিবারের সাথে সব থেকে বেশি সময় পার করার সুযোগ পেয়েছে। বাইরে ঘুরাঘুরি করতে না পারলেও পরিবারের সদস্যদের সাথে অভিজ্ঞতা বিনিময় বা গল্প করা, টিভি বা ইন্টারনেটে অনুষ্ঠান দেখা, বাচ্চাদের সাথে খেলাধুলা করা, প্রভৃতি মাধ্যমে মানুষ সময় কাটিয়েছে।
বছরজুড়ে সামাজিক “দুরত্ব বা সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং” উচ্চারিত হলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে একে অপরের খোঁজখবর নেয়া, আতœীয় স্বজনের পাশে দাঁড়ানো, সহায়তা করার যে দৃষ্টান্ত দেখা গেছে তা বরং প্রমাণ করে যে, মানুষ সামাজিকভাবে একে অপরকে অনেক বেশি উপলব্ধি করতে পেরেছে। সচ্চল পরিবারগুলোর মধ্যে করোনার সময়ে দরিদ্র্য ও কর্মহীন মানুষদেরকে অর্থ, খাদ্য ও পণ্য দিয়ে সহায়তা করার প্রবণতা ছিলো লক্ষণীয়। তবে, মানুষের মধ্যে একে অপরের সাথে শারীরিক দুরত্ব বজায় রেখে চলার অভ্যাস দেখা গেছে। এমনকি দীর্ঘদিনের কিছু চর্চায়ও পরিবর্তন এসেছে যেমন কারো সাথে দেখা হলে হ্যান্ডশেক বা মুসাফা না করা, ঈদে কোলাকুলি না করা, কোন রোগি দেখতে গেলে তার গায়ে হাত না দেয়া, ইত্যাদি।বাসা-বাড়ীর কাজে অন্য সময়ের তুলনায় করোনাকালীন সময়ে নারীদের কাজের হার বেশি ছিলো। তবে শিশু ও পুরুষেরও অংশগ্রহণ ছিলো উল্লেখযোগ্য।
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে বরাদ্দের সাথে সাথে বেড়েছে উপকারভোগীর সংখ্যাও। ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরের বাজেটে ছিলো ৭৪ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা বা মোট বাজেটের ১৪.২১ শতাংশ তবে চলতি ২০২০-২০২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এর পরিমাণ রাখা হয়েছে ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা যা জাতীয় বাজেটের মোট পরিমাণের ১৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ। মানব উন্নয়ন সূচকে ২ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। এই সূচকে ১৮৯ টি দেশের মধ্যে ২০১৯ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৩৫ তম যা ২ ধাপ এগিয়ে ২০২০ সালে ১৩৩-এ উন্নীত হয়েছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি গত বছরও যথারীতি বেশ আলোচিত ছিল। গত ২০২০ সালেও মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু না হলেও ভাসানচরে স্থানান্তর শুরু হয়েছে। গত ৪ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে ১ হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গাকে কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে স্থানান্তরের মধ্য দিয়ে বহুল আলোচিত এই স্থানান্তর শুরু হয়।
গত বছরে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ুও বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর ২০১৯ সালে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ বছর ৩ মাস ছিলো যা চলতি বছরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২.৬ বছর। পাশাপাশি মানুষের জীবনমানেও পরিবর্তন এসেছে। দেশের ৯৮.১ শতাংশ মানুষ এখন নলকূপ থেকে পানি পাচ্ছে ও ৯৩.৫ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে।
করোনার কারণে আরোপিত ‘লকডাউন’ কিছুটা শিথিল হওয়ার সাথে সাথে বহুসংখ্যক বিবাহের ঘটনা ঘটতে থাকে তবে এক্ষেত্রে বিবাহের সংস্কৃতিতে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে যেমন বড় পরিসরে অনুষ্ঠান না করে ঘরোয়াভাবে সম্পন্ন করা; কয়েকধাপে-কয়েকদিনে বিয়ের অনুষ্ঠানকে ভাগ না করে শুধুমাত্র বর-কনের অভিভাবকদের উপস্থিতিতে বিবাহ সম্পন্ন হতে দেখা গেছে। করোনার মধ্যে গোপনে বাল্যবিবাহ সংগঠিত হওয়ার খবর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি বছরের জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত তালাক হয়েছে ৫ হাজার ৯৭০টি অর্থাৎ এই সময়ে প্রতি মাসে গড়ে ১ হাজার ১৯৪টি তালাকের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৯ সালে প্রতি মাসে গড়ে তালাক হয়েছিল ৯২০টি। চলতি বছরের জুন-অক্টোবর এই পাঁচ মাসে তালাক বেড়েছে ২৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
গত বছর দেশের শিক্ষাঙ্গণও থমকে ছিল করোনার প্রভাবে। করোনার কারণে ঘোষিত ছুটি কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অনলাইনে ক্লাস ও পাঠদান কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। অনলাইনে পাঠদানকে অনেকে সময়োপযোগী ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করলেও অভিভাবকদের অনেকেই এটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষাথী ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষাথীদের জন্য ‘মানসিক চাপ’ হিসেবে সমালোচনা করেছেন।
এসএসসিসহ বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা না নিয়ে জেএসসি এবং এসএসসি-এর উপর ভিত্তি করে ফলাফল নির্ধারনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষের মাঝে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। অনেকে এই পদ্ধতির প্রশংসা করলেও কিছু কিছু মানুষ এর সমালোচনা করেন। কয়েকটি বিশ^বিদ্যালয়ে বছরের শেষের দিকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষা নেওয়া হয়। এছাড়া, বন্ধ থাকার ফলে এবছর পাবলিক পরীক্ষায় বরাবরের মত প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। বিগত ২০১৯ সালে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সন্ত্রাসীকর্মকান্ড ঘটলেও ২০২০ সালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এরকম ঘটনা শোনা যায়নি। তবে সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে সংগঠিত ধর্ষণের ঘটনা সারাদেশে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়।
দেশে স্বাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৭৪.৭ শতাংশ যা পূর্ববর্তী বছরে ছিল ৭৩.৯ শতাংশ; তবে শিক্ষার মান নিয়ে যথারীতি প্রশ্ন রয়ে গেছে।যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডসের (কিউএস) জরিপে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বাংলাদেশের ১১ বিশ^বিদ্যালয় স্থান করে নিয়েছে। এই তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৩৪ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ১৯৯ তম স্থান অধিকার করেছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় গবেষণা প্রতিষ্ঠানের র্যঙ্কিং-এ এগিয়ে আছে বাংলাদেশের কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আন্তর্জাতিক উন্নয়ন নীতি বিষয়ক থিংক ট্যাঙ্ক ক্যাটাগরিতে ২৬তম এবং দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মধ্যে ১৭তম স্থান অধিকার করেছে।
বিগত বছরটিতেও বাংলা একাডেমি যথারীতি অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন করে যেখানে মোট ৪ হাজার ৯১৯ টি নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে যা তার আগেরবারের তুলনায় ২৩৪টি বেশি। বিগত ২০১৯ সালের মেলাতে মোট ৮০কোটি টাকার বই বিক্রি হলেও ২০২০-এ মোট বই বিক্রি ৮২ কোটি টাকার মাইলফলক ছুঁয়েছে। তবে বই প্রকাশের সংখ্যা বাড়লেও কমেছে ‘মানসম্মত’ বই-এর সংখ্যা। গত ২০১৯ বইমেলায় ১১৫১ টি বইকে মান সম্পন্ন বই বলে মনে করেছে বাংলা একাডেমি অথচ ২০২০ সালে তার পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৭৫১ টি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন মেলার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকা এবং মানসম্মত বই প্রকাশিত হওয়ার কারণে এই রেকর্ড পরিমাণ বই বিক্রি হয়েছে। বইমেলা ছাড়াও বছরের বিভিন্ন সময়েও নানারকম সৃজনশীল বই প্রকাশ করোনার কারণে ব্যাহত হয়েছে।
ফ্যাশন এবং সৌন্দর্য চর্চায় এ বছর মানুষের আগ্রহ তেমন একটা দেখা যায়নি। বছরের অধিকাংশ সময়ই মানুষ ঘরে থাকায় নিত্য-নতুন পোশাক কেনার প্রবণতা কম ছিলো। এছাড়া, বড় বড় শপিং মল বন্ধ থাকায় ও করোনার ভয়ে ঈদ ও পুজাসহ সকল অনুষ্ঠানে কেনাকাটার হার ছিলো অন্যান্য বছরের তুলনায় খুবই কম। কিছু মানুষ করোনার মধ্যেও শপিং বা বিলাসী পণ্য ক্রয় করেছে তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদেরকে নিয়ে ঠাট্ট্রা হতে দেখা গেছে। তবে উৎসবগুলিতে কেউ কেউ ঘরে বসে নতুন পোশাক পরে ইন্টারনেটে আপনজনদের সাথে ভারচুয়াল আড্ডা দিয়েছে। এছাড়া, সৌন্দর্য চর্চায় ব্যবহৃত পণ্যের থেকেও স্বাস্থ্য-সুরক্ষা সংশ্লিষ্ট পণ্যে বা প্রসাধনি যেমন হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, পিপিই, জীবাণু নাশক সাবান, ফেস শিল্ড প্রভৃতির ব্যবহারে মানুষের আগ্রহ ছিলো অনেক বেশি। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ডিজাইনের পণ্যের প্রতি মানুষের আগ্রহ ছিলো। কিছু লোককে বিভিন্ন নকশার মাস্ক অন্যান্য কাপড়ের সঙ্গে ম্যাচিং করে ব্যবহার করতে দেখা গেছে।
গত বছর পহেলা বৈশাখের সকল অনুষ্ঠানকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। করোনার কারণে গতবছর ঢাকায় আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত উৎসব হয়নি পাশাপাশি সাহিত্যের আন্তর্জাতিক উৎসব ‘ঢাকা লিট ফেস্ট’-এর আয়োজনও বন্ধ থাকে।বছরের অধিকাংশ সময় মানুষ ঘরের বাইরে অবকাশ যাপন বা ঘোরাঘুরি করতে পারেনি। পর্যটন খাতের সাথে যুক্ত খাতসমূহ ব্যপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
বছরটিতেই সব থেকে বেশি হারে দেশের তরুন সমাজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কল্যাণকর কাজে ব্যবহার করেছে। প্রথমদিককার করোনা আতঙ্ক কাটিয়ে উঠে বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের জন্য অর্থ তহবিল গঠন, চাঁদা উঠানো, মানুষের দুর্ভোগের কথা জানানোসহ নানাবিধ জনহীতকর কাজে এই মাধ্যমকে ব্যবহার করেছে তরুনরা। এছাড়া, ধর্ষণসহ অন্যান্য অপরাধের বিরুদ্ধ সামাজিক মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য প্রতিবাদ লক্ষ্য করা গেছে। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলির মধ্যে অন্যতম ছিলো পদ্মা সেতুর সবগুলো স্প্যান বসে যাওয়ার খবরটি। এই দিনে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ ইন্টারনেটে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এবং প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের প্রশংসা ছিল লক্ষনীয়।
করোনা মহামারির মধ্যেও নিরবিচ্ছিন্ন ছিলো ইন্টারনেট সেবা। দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ কোটি ১১ লাখে। এর মধ্যে মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী প্রায় ১০ কোটি ২৫ লাখ। করোনাকালে সেবার জন্য সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে সাধারণ মানুষের প্রশংসায় ভেসেছে আইনশৃংখলা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বা পুলিশ। তবে কিছু কিছু এলাকায় পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তাদের দ্বারা লকডাউনের মধ্যে সাধারণ কিছু মানুষের অবমাননাকর পন্থায় শাস্তি প্রদান করার ছবি সামাজিক ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে তা সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়।
গত বছর বাংলাদেশের বিনোদন অঙ্গণেও পড়েছিলো করোনার প্রভাব। লকডাউনের কারণে বছরটিতে নাটক সিনেমাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নিমাণকাজ বন্ধ হয়ে যায় যদিও পরবতীতে ‘স্যোাশাল ডিসট্যান্সিং’ বজায় রেখে, স্বাস্থ্য বিধি মেনে শুটিং শুরু করে। তবে এবছর অধিকাংশ মানুষ যেহেতু লকডাউনে ঘরেই অবস্থান করেছে ফলে সেসময় টিভিতে খবর, নাটক ও সিনেমা অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি দেখেছে বলে জানা যায়। টিভির তুলনায় অনলাইন বিনোদনে মানুষের আগ্রহ যথারীতি ক্রমবর্ধমান ছিলো।
সিনেমা অঙ্গণে ছিলো হতাশার ছায়া। করোনার কারণে দীঘদিন বন্ধ ছিলো সিনেমাহলগুলি। বছর শেষে প্রযোজক সমিতির হিসেবে ছবি মুক্তির সংখ্যা ১৬ যা স্বাধীনতার পর সবচেয়ে কম। তবে প্রশংসনীয় কাজও করেছে চলচ্চিত্রের সমিতিগুলো। করোনাকালে সাধারণ শিল্পী ও কুশলীদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেছে প্রযোজক, পরিচালক ও শিল্পী সমিতি।
সারা বছর পল্লী অঞ্চলে বিভিন্ন জায়গায় যাত্রাগান, পালা গান বা কাওয়ালী গানের যেসব বড় আয়োজন হয় সেগুলি গতবছরের বেশিরভাগ সময় ধরে আয়োজিত হয়নি তবে বছরের শেষের দিকে কিছু কিছু অঞ্চলে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন দেখা গেছে। বিভিন্ন পীরের আসরে বা দরগাহে ওরস-এর আয়োজনও ব্যাহত হয়েছে।
ইউটিউব এবং অনলাইনভিত্তিক মিউজিক ভিডিও, নাটক এবং স্বল্প-দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উপভোগ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান প্রজন্মের মাঝে টেলিভিশনের তুলনায় ইন্টারনেটেই টিভি অনুষ্ঠানসহ অন্যান্য বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান উপভোগ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। টেলিভিশনে করোনার সংবাদই বেশি প্রকাশিত হয়েছে। ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবহার করা যায় এমন টিভি সেটের জনপ্রিয়তা ক্রমবর্ধমান ছিলো। ইন্টারনেটে মুলধারার সঙ্গীতের পাশাপাশি ইসলামিক ওয়াজ-মাহফিলের অনুষ্ঠান এবং সঙ্গীতের চর্চার প্রবণতাও লক্ষ করা গেছে।
বছরটিতে বিনোদন অঙ্গনের কয়েকজন বিশিষ্ট মানুষ মারা গেছেন তাদের মধ্যে খ্যাতিমান অভিনেতা আব্দুল কাদের, আলী যাকের, সাদেক বাচ্চু, কে এস ফিরোজ, সঙ্গীত শিল্পী এন্ড্রু কিশোর, অভিনেত্রী ফেরদৌসি আহমেদ লীনা, প্রমূখ। এদের মধ্যে সাদেক বাচ্চু এবং আলী যাকের কোভিড-১৯ পজিটিভ ছিলেন।
বিগত ২০২০ সাল ছিলো বাংলাদেশের ক্রিড়াঙ্গণে প্রথম বিশ^কাপ জয়ের বছর। টানটান উত্তেজনার ম্যাচে ভারতকে হারিয়ে যুবারা দেশকে এনে দেয় প্রথম অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ শিরোপা। পরিকল্পনা অনুযায়ী বছরটি ছিলো বাংলাদেশের ক্রিড়াঙ্গণের অন্যতম ব্যস্ত বছর অথচ করোণার কারণে পুরো ক্রিড়াঙ্গণই ছিলো স্থবির। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বিশ্ব একাদশ ও অবশিষ্ট এশিয়া একাদশের দুটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ হওয়ার কথা ছিল মার্চে মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে। বিশ্ব ক্রিকেটে অনেক বড় তারকার খেলা নিশ্চিত হয়েছিল। সেটি করোনার কারণে স্থগিত হয়ে যায় গত বছরেই। খুব বেশি টেস্ট ম্যাচ না খেলার দর্ঘিদিনের আক্ষেপ ছিলো বাংলাদেশের। সে আক্ষেপ ঘোচাতে গত বছর ১০ টি টেস্ট ম্যাচ খেলার পরিকল্পনা ছিলো।
এমন সুযোগ বাংলাদেশ কখনোই পায়নি। অথচ পুরো বছরে খেলতে পেরেছে মাত্র ২ টি টেস্ট। এছাড়া ওয়ানডে ম্যাচ খেলতে পেরেছে মাত্র ৩টি। এক বছরে এত কম ম্যাচ ১৯৯৫ সালের পর এবারই প্রথম। তবে আরো উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে, গত বছর কোন ওয়ানডে ম্যাচে হারেনি বাংলাদেশ। এছাড়া, এ বছরটিতেই বাংলাদেশের ক্রিড়াঙ্গণের অন্যতম জনপ্রিয় অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা ওয়ানডে অধিনায়কত্ব থেকে বিদায় নেন। এক বছরের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে নভেম্বরে বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপ দিয়ে আবার ক্রিকেটে ফেরেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা সাকিব আল হাসান। নারী ক্রিকেটে তেমন কোন অর্জণ ছিলোনা বলা যায়। নারী বিশ^কাপও ভালো যায়নি বাংলাদেশের জন্য। টানা দ্বিতীয়বার ভারতের উইমেন্স টি-টোয়েন্টি চ্যালেঞ্জে খেলেন জাহানারা আলম। প্রথমবারের মতো এতে অংশ নেন সালমা।
গত বছরে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে আলোচনার শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) নির্বাচন। নির্বাচনে টানা চতুর্থবারের মতো সভাপতি পদে বিজয়ী হয়েছেন কাজী মো. সালাউদ্দিন। মাঠের ফুটবল মার্চ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস বন্ধ ছিল। করোনার প্রথম ঢেউ একটু কমলে ফুটবল সীমিত আকারে শুরু হয়। মার্চ ও জুনে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের বাকি চার ম্যাচ খেলার কথা ছিল বাংলাদেশের তবে তা ৯ মার্চ স্থগিত হয়। এএফসি কাপ, মুজিববর্ষে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপসহ বেশ কিছু প্রীতি ম্যাচও হওয়ার কথা ছিল। জয়া চাকমার পর ফিফা রেফারি হওয়ার স্বীকৃতি পেলেন সালমা। তবে বয়স ২৫ এর নিচে হওয়ায় তিনি থাকছেন সহকারী রেফারি হিসেবে।
তবে খেলোয়াড়েরা খেলাধুলায় ব্যস্ত সময় না কাটাতে পারলেও বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ড করেছেন, মুশফিকুর রহিম তাঁর দুই শতক রান করা বিখ্যাত ব্যাট বিক্রি করে সেই অর্থ দিয়ে প্রায় ৩০০ শত দরিদ্র পরিবারকে সহায়তা করেছিলেন। তহবিল গঠনের জন্য সাকিব আল হাসানও ব্যাট বিক্রি করেছিলেন এবং সাকিব আল হাসান ফাউন্ডেশন থেকে সুবিধা বঞ্চিতদের সহায়তা প্রদান করেছেন। এছাড়াও, খেলোয়াড়দের বিভিন্ন সংগঠন থেকে দরিদ্র খেলোয়াড়দের ও সুবিধা বঞ্চিতদেরকে সহায়তা করার খবর জানা গেছে।
করোনার মধ্যে গ্রাম এবং শহরে বিভিন্ন ধরনের স্থানীয় খেলা যেমন লুডু, দাবা, কেরাম খেলার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। কিছু কিছু অঞ্চলের গ্রামগুলিতে মানুষ বিভিন্ন দোকানে ক্যারম খেলেছে। আবার শহরের মানুষ পরিবারের সদস্যদের সাথে লুডু ও দাবা খেলেছে বলে জানা যায়। তবে, অনেকে ডিজিটাল মাধ্যম অর্থাৎ মোবাইল ও ল্যাপটপের অ্যাপস ব্যবহার করে লুডু ও দাবা খেলেছে। কিছু কিছু মানুষ আবার ইন্টারনেট ব্যবহার করে দূরে অবস্থানরত বন্ধু-বান্ধবের সাথে লুডু, দাবাসহ বিভিন্ন ‘গেইম’ খেলে সময় কাটিয়েছে।
আমিনুর রহমান, গবেষক, সোশ্যাল এন্ড জেন্ডার ডিভিশন, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ (বিআইএসআর) ট্রাস্ট। তিনি সামাজিক অসমতা, উন্নয়ন, জেন্ডার, শিশু অধিকার, প্রজনন স্বাস্থ্য প্রভৃতি বিষয়ে গবেষণা করেন। কয়েকটি আন্তর্জাতিক ও জাতীয় জার্নালে তার গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ইমেইল: [email protected]।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
- ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১: জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ’
- সুনীল অর্থনীতি ও রূপকল্প-২০৪১
- শিক্ষার ধরন ও বেকারত্ব: দেশে অশিক্ষিতদের চেয়ে শিক্ষিত বেকার ৩ গুন
- ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়
- ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস-১৯৬১ ও দ্বিপক্ষিয় কূটনীতিক সম্পর্ক
- মিডিয়ার শক্তি বা আসক্তি: ম্যাজিক বুলেটের বাকের ভাই ও বদি
- গণমাধ্যমে গণরুচির বিকার
- হালকা বিনোদনের প্রাধান্যে সংস্কৃতির অবনতি
- কেন পড়া উচিত ‘সাতকাহন’