শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪ || ৯ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ভুলভাবে উদ্ধৃত ছাত্রলীগের ইতিহাস

কবির য়াহমদ, সাংবাদিক ও লেখক

১৬:০৭, ৬ জানুয়ারি ২০২১

১৪৮৫

ভুলভাবে উদ্ধৃত ছাত্রলীগের ইতিহাস

বাংলাদেশ ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন হলেও আওয়ামী লীগের চাইতে ছাত্রলীগের বয়স বেশি। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগের জন্ম হলেও ছাত্রলীগের জন্ম তারও প্রায় বছর দেড়েক আগে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের অ্যাসেম্বলি হলে ছাত্রলীগের যাত্রা শুরু। প্রতিষ্ঠার সময়ে এর নাম ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’। আর গণসংগঠন আওয়ামী লীগের জন্মকালে নাম ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। পরবর্তীতে এই দুই সংগঠন থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটা বাদ গিয়ে অসাম্প্রদায়িক সংগঠনরূপে রূপান্তর ঘটে। এখানেও অগ্রণী ভূমিকা ছাত্রলীগের। সংগঠনটি ১৯৫৩ সালে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়, আওয়ামী লীগ বাদ দেয় ১৯৫৫ সালে।

ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের মধ্যকার ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের যে বিকাশ সেটাও প্রথমে এসেছে ছাত্রলীগ থেকেই। আওয়ামী লীগও পরে ওই পথে হেঁটেছে। স্বভাবত আওয়ামী মুসলিম লীগ, মুসলিম ছাত্রলীগ নামগুলো ইতিহাসের অংশ হলেও গৌরবের অংশীদার নয়। ধর্মরাষ্ট্র পাকিস্তানে ধর্মের নাম বাদ দিয়ে সংগঠনগুলোর পরিচালনা ছিল সর্বজনীন রূপে রূপান্তরের প্রচেষ্টা। সে সময়ে সফল হয়েছিল সংগঠনগুলো, যার প্রমাণ আমাদের মুক্তির সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস থেকে প্রমাণিত। ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নাম থেকে পূর্ব পাকিস্তান বাদ যায় বাংলাদেশে এসে। এখন তাই আওয়ামী লীগ মানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এটা কোনোভাবেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নয়। একইভাবে ছাত্রলীগ মানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, এটা কোনোভাবেই পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নয়; এমনকি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ নয়। পূর্ব পাকিস্তানও বাদ দিচ্ছি কারণ পূর্ব পাকিস্তান নামের অংশকে বাংলাদেশ নামের দেশে রূপান্তরের সংগ্রাম ছিল ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের।

গণসংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রাম থেকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। নেতা হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সংগ্রামের পথ পরিক্রমায় নাম বদলের আগে কেবল ভাষা আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অংশগ্রহণ ছিল। এখানে সাফল্যের পথ ধরে অসাম্প্রদায়িকতা চর্চার পথ উন্মুক্ত করতে মুসলিম শব্দটি সংগঠনের নাম থেকে বাদ দেওয়া হয়। এরপর শিক্ষা আন্দোলন, বাঙালির স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা, গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতা, স্বাধিকার আন্দোলনসহ মুক্তিযুদ্ধের সবখানে ছিল মুসলিম শব্দ বাদ দেওয়া ছাত্রলীগের ভূমিকা।
 
বদলে যাওয়া এই নাম, রূপান্তরিত এবং প্রকাশ্য অসাম্প্রদায়িক চর্চা ছাত্রলীগকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি সংগঠনটির শক্তি বৃদ্ধি করেছে। স্বাধিকার-স্বাধীনতার সংগ্রামের ছাত্রলীগ মুসলিম ছাত্রলীগ ছিল না। পূর্ব পাকিস্তান নাম থেকে নতুন দেশের জন্মযুদ্ধের দীর্ঘ সময়ে ছাত্রলীগ দেশের জন্যে লড়েছে। লক্ষ্য যখন নতুন দেশ তখন পূর্ব পাকিস্তান নামটাই ছিল উহ্য।

ঐতিহ্যবাহী এক সংগঠনটি গত ৪ জানুয়ারি ৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করেছে। সাংগঠনিক নানা কর্মসূচির পাশাপাশি সরকারের ডাক অধিদপ্তর স্মারক ডাকটিকিট ও উদ্বোধনী খাম প্রকাশ করেছে। এই খাম ও স্মারক ডাকটিকেট অবমুক্ত করেছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। মুক্তির সংগ্রাম থেকে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্রলীগের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কারণে দিবসের আয়োজন হিসেবে ডাক অধিদপ্তরের এই আয়োজন প্রশংসার দাবিদার হলেও বিপত্তি ঘটেছে উদ্বোধনী খাম ও স্মারক ডাকটিকেটে। ওখানে বাংলা ও ইংরেজিতে লিখা রয়েছে ‘৪ জানুয়ারি ২০২১, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের ৭৩তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী’! উদ্বোধনী খামে লিখিত এই বাক্য সুলিখিত নয়, এই বাক্য ইতিহাসকে ধারণ করে না, এই বাক্য গৌরবের প্রতিফলন ঘটায় না। কারণ এখানে যে ছাত্রলীগের কথা বলা হয়েছে সে ছাত্রলীগ প্রথমত পূর্ব পাকিস্তানকে গ্রহণ করে না, পূর্ব পাকিস্তানের নাম ধারণ করে না, সে ছাত্রলীগ পূর্ব পাকিস্তানকে অস্বীকারকে নতুন দেশের জন্যে লড়েছিল, সে ছাত্রলীগ ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র চিত্রণে সংগঠনের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়েছিল। এছাড়াও যে তারিখে এই উদ্বোধনী খাম ও স্মারক ডাকটিকেট অবমুক্ত হয়েছে সে তারিখে এই ভূখণ্ডসহ বিশ্বমানচিত্রে পূর্ব পাকিস্তানের অস্তিত্ব নাই, মুসলিম ছাত্রলীগেরও অস্তিত্ব নাই; যা আছে সেটা বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। অথচ যেভাবে ডাক অধিদপ্তর এই ৪ জানুয়ারি তারিখকে উপস্থাপন করেছে তাতে মনে হয় ছাত্রলীগের সঙ্গে এখনও আছে পূর্ব পাকিস্তানের যোগ, এখনও আছে মুসলিম শব্দের যোগ! অনাকাঙ্ক্ষিত!

ডাক অধিদপ্তর কেন করল এমন কাজ? দায়িত্বশীলরা কি ইতিহাস-বিস্মৃত? যে মন্ত্রী বিশেষ সিলমোহর ব্যবহার করে ভুল উপস্থাপনের এই উদ্বোধনী খাম ও স্মারক ডাকটিকেট অবমুক্ত করলেন তিনিও কি ইতিহাস ভুলে গেলেন? ধারণা করি তেমন না! তাহলে কেন হলো এমন? উত্তর দেবে কে?

ছাত্রলীগকে ভুলভাবে উপস্থাপন করার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা ও নানা প্রশ্ন ওঠলেও এনিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ভাবিত নন বলেই মনে হচ্ছে, অন্তত ফেসবুকে তার কিছু মন্তব্য তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের ৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী লিখার কারণে যে সমালোচনা মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের ফেসবুক পোস্টেই ওঠে এসেছে তার উত্তর মন্ত্রী সুন্দরভাবে দেননি। সরকারি তরফে ছাত্রলীগকে ভুলভাবে উপস্থাপনের কারণে এতে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ প্রকাশ পাচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে প্রশ্নকারীকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে মন্ত্রী বলছেন, ‘সাম্প্রদায়িকতা প্রশ্নকারীর মনে’। ভাবা যায়! এতে কী প্রমাণ হয়? প্রমাণ হয় এই ভুলকে ভুল ভাবছেন না তারা!

এটা সবাই জানে যে এই খাম ও ডাকটিকেট প্রকাশের সঙ্গে মন্ত্রী একা জড়িত নন। এর দায় প্রতিষ্ঠানেরও। কিন্তু সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি বলে যে কথা রয়েছে সেখানে দায় গিয়ে পড়ে মন্ত্রীর ওপর। এছাড়া তিনি নিজে এগুলো অবমুক্ত করেছেন। একটা স্বাক্ষরও দেখলাম ওখানে। ‘স্বাক্ষর দেখে স্বাক্ষর করিলাম’ এমন বলে কিংবা লিখেও অন্যের ওপর এখানে দোষ চাপানোর সুযোগ নাই যেহেতু শীর্ষ ব্যক্তি হিসেবে তিনিই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত। তার মাধ্যমেই এর অবমুক্তি ঘটেছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের টানা দুই মেয়াদের মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের পরিচিতি যতটা না রাজনীতিবিদ, তারচেয়ে বেশি তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ হিসেবে। তবে জানা যাচ্ছে তিনিও রাজনীতি করেছেন। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের ওয়েবসাইট বলছে, ‘‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার অন্যতম নেতা ছিলেন। ১৯৭৩ সালে তিনি ছাত্রলীগের পক্ষে নির্বাচন করে সূর্যসেন হলের নাট্য ও প্রমোদ সম্পাদক নির্বাচিত হন।’’ সুতরাং তার রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড আওয়ামী লীগের অন্য অনেকের মত গৌরবের না হলেও অনুল্লেখের মত নয়। তার আছে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও পরিচিতি।

ছাত্রলীগের ইতিহাসকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা আয়োজনে মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, ‘ছাত্রলীগের জন্মের ইতিহাস তুলে ধরতে স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করা জাতীয় দায়িত্ব’। না, জনাব মন্ত্রী; ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ ৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করেনি। ছাত্রলীগের ইতিহাস ৭৩ বছরের পুরোনা অথচ গৌরবের ইতিহাস হলেও মুসলিম ছাত্রলীগের ইতিহাস মাত্র পাঁচ বছরের; আর বাকি থাকা পূর্ব পাকিস্তানের কবর রচিত হয়েছে একাত্তরে, আপনাদের মত মুক্তিযোদ্ধাদের হাত ধরেই। আপনারা ছাত্রলীগের প্রতি ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে উলটো ছাত্রলীগের সামগ্রিক ইতিহাসকেই বিকৃত করেছেন। এটা উচিত হয়নি আপনাদের! 

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank