ভণ্ডদের ভণ্ডামি ও বেহেশত-দোজখের সার্টিফিকেট
ভণ্ডদের ভণ্ডামি ও বেহেশত-দোজখের সার্টিফিকেট
দেওয়ানবাগী পির নামে পরিচিত ঢাকার দেওয়ানবাগ দরবার শরিফের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ মাহবুব-এ-খোদা মারা গেছেন। সোমবার ঢাকার একটি হাসপাতালে তিনি মারা যান। তার মৃত্যু নিয়ে বরাবরের মত কথিত ধার্মিকেরা বিভক্ত। তিনি বেহেশতে যাবেন, নাকি দোজখে স্থান হবে তার এ সম্পর্কে একটা বিতর্ক লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই তাকে দোজখে স্থান দিয়েছেন। অংশগ্রহণকারীদের খুব কম সংখ্যক ধার্মিকই তার বেহেশত-দোজখের ফায়সালা ধর্মমতে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর ওপর ছেড়েছেন। অধিকাংশের যা মতামত তাতে দেখা যায় তার দোজখ গমন একেবারে সিদ্ধান্ত তাদের। মজার বিষয় হচ্ছে এই সিদ্ধান্তদাতাদের বেশিরভাগই অতি-ধার্মিক শ্রেণির, এবং অতি-অবশ্যই বাস্তবিকভাবে তারা নিজেরা জানে না কোথায় স্থান হবে তাদের। তারা নিজেদের গন্তব্য না জানলেও অন্যের গন্তব্য নিয়ে ঠিক-ঠিক নিশ্চিত হয়েই নিশ্চয়তা দিচ্ছেন।
দেওয়ানবাগী পিরের মৃত্যু পরবর্তী ঠিকানা কোথায় হবে এই সিদ্ধান্ত যারা দিচ্ছেন তারা নিশ্চিতভাবেই সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক কোন বার্তা পাননি। তাদের সে ক্ষমতাও নাই, তবু তারা সেটাই দিচ্ছেন। এ যেন ইহকালে বসে অন্যের পরকাল দেখা। অথচ এদের নিজেদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়েই ধারণা নাই। তারাও জানে না কোথায় যাবে তারা। তবে অন্যের সম্পর্কে যেভাবে নিশ্চিত হয়ে সিদ্ধান্ত দিয়ে দেয় তাতে করে বিভ্রান্ত হয়ে যেতেই হয়।
দেওয়ানবাগী পির ভণ্ড। দেওয়ানবাগী পিরের ইমান-আকিদা ঠিক নাই, দেওয়ানবাগী পির ধর্ম ব্যবসায়ী- এইধরনের প্রচারণা শুনে আসছি। ধর্মব্যবসায়ীরা মুখোমুখি হলে ওখানে কোনো পক্ষে অবস্থান নেওয়ার মত মানসিকতা ধারণ করি না বলে তাদের কে সত্য আর কে অসত্য বলছে এনিয়েও আগ্রহ ছিল না। সকল ধর্মব্যবসায়ী নিজ নিজ অবস্থানে একেকজন ভণ্ড আর ভণ্ডদের নিয়ে আগ্রহ নাই বলে মাথা ঘামাইনি। সবাইকে সব বিষয় নিয়ে ভাবতেই হবে এমন ত না। তবে যখন কারও বেহেশত-দোজখ নিয়ে কেউ নিশ্চিত হয়ে কিছু বলে তখন এনিয়ে আলোচনার সুযোগ তৈরি হয় বৈকি! এখানে আলোচকদের অবস্থান, চরিত্র, উদ্দেশ্য নিয়ে স্বভাবত প্রশ্ন থাকে। মনে হয় এক ভণ্ড আরেক ভণ্ডের পিছু লেগেছে। নিজেদের ভণ্ডামি ঢাকতে অন্যকে বেহেশত-দোজখে পাঠিয়ে দিচ্ছে।
ওয়াজ মাহফিলের বক্তা, ইউটিউবের ধর্মীয় বক্তা, ফেসবুকের ধর্মীয় বক্তাসহ হরেক বক্তার সমাবেশ আমাদের সমাজে। তাদের একেক দল একেক মতাবলম্বী। তারা এক আল্লাহকে বিশ্বাস করে ঠিক, কিন্তু তারা একেকজন অন্যজনের প্রতি তীর দাগিয়ে বসে আছে। একেকজন অন্যজনকে কাফের বলে ফতোয়া দেয় প্রকাশ্য মাহফিলে। নিজ ধর্মের অন্য বক্তাকে মাহফিলে কাফের বলে ঘোষণা দিয়ে তারা ওইসব মাহফিলের উপস্থিতজনের কাছে তাদের বক্তব্যের পক্ষে মৌখিক ভোটও চায়- ঠিক কি না আওয়াজে। উপস্থিতজনেরা শতভাগ উচ্চারণে ঠিক বলে ভোটও তাদের। এই ভোটদাতারা প্রত্যেক মাহফিলে শতভাগ থাকে। এখানে যার পক্ষে বক্তা বলে শ্রোতা তার পক্ষে ভোট দেয়, যার বিপক্ষে বক্তা অগ্নিমূর্তি হয় তার বিপক্ষে শ্রোতারা শতভাগ সমর্থন জ্ঞাপন করে। ফলে এটা পুরোটা বক্তানির্ভর ভোটাভুটি। এখানে যে যাকে কাফের অথবা দোজখী উচ্চারণ করে তার নিজের অবস্থান কোথায় হবে এনিয়েও সে নিশ্চিত নয়। বাস্তবে যে বক্তা নিজে অন্যকে বেহেশতে যাওয়ার দিকনির্দেশনা দেয় তার নিজেরও বেহেশতে যাওয়া নিশ্চিত নয়। তবু সে বা তারা অন্যদের বেহেশতে পাঠায়, একইভাবে অন্যদের দোজখেও পাঠায়।
দেওয়ানবাগী পিরের মৃত্যুর পর একই ঘটনা ঘটল। নিজেদের বেহেশত গমনের নিশ্চয়তা না থাকলেও প্রচলিত ধারার অনেক আলেম কথিত এই পিরকে ইতোমধ্যেই দোজখে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ভাবখানা এমন এখানে ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী শেষ বিচারের সুযোগ নাই। অর্থাৎ কেয়ামতের বিধান অনুযায়ী শেষ বিচার যা সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ করবেন সে সুযোগটাই আল্লাহকে তারা দিতে রাজি নন। এরা দুনিয়াতে বসে আখেরাতের বিচার করে ফেলেছেন, এবং এই বিচারে দেওয়ানবাগীর স্থান অবধারিতভাবে জাহান্নাম!
দুনিয়াতে বসে আখেরাতে বিচার যারা করছিলেন তারা আল্লাহর জায়গায় নিজেকে উপস্থাপন করে ফেলেছেন। এটা নিজের অলক্ষ্যেই হয়ত। এখানে কাজ করেছে পরস্পরের প্রতি হিংসা। এই হিংসা মূলত ধর্মব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাড়াকাড়ি থেকে সৃষ্ট। জীবদ্দশায় কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি ছিল না তারা, একজনের মৃত্যুর পর তাই অন্যজন বা শত্রুভাবাপন্ন অন্যরা তাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে বসেছে। এখানে তারা নিজেদের অলক্ষ্যে যে শেষ বিচারের বিচারকের ভূমিকায় নেমে গেছে এটা বুঝাবে কে তাদের? এটা ধার্মিকের কাজ নয় নিশ্চয়ই। ইসলাম যেখানে চূড়ান্ত বিচারকের মালিক একমাত্র সৃষ্টিকর্তাকে নির্ধারণ করে রেখেছে সেখানে অন্যদের সেখানে বিচারক সেজে সিদ্ধান্ত দেওয়াটা ধর্ম সমর্থন করে না।
এক আল্লাহ, শেষ নবী মুহাম্মদের (সা.) ওপর যেখানে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, আরও বিশ্বাস যেখানে আখেরাতের ময়দানে আল্লাহই করবেন ব্যক্তির কৃতকর্মের বিচার সেখানে দুনিয়াতে বসে আখেরাতের ফল নির্ধারণ করে দেওয়া অনুচিত। দেওয়ানবাগী কোথায় যাবেন সেটা নির্ধারণ করে দেওয়ার মালিক দেশের ধর্মীয় কোনো বক্তা নন। দেওয়ানবাগী ধর্মীয় বিধান পালন করে মৃত্যুবরণ করেছেন কি না এর নিশ্চয়তাও কেউ দিতে পারবে না, কারণ জীবনের অন্তিম মুহূর্তের খবর কেউ রাখতে পারে না। এখানে তাই আগবাড়িয়ে অদেখা জগত, অদেখা বিচার, অদেখা মুহূর্তকে আমলে না নিয়ে গন্তব্যের হদিস দেওয়া ভণ্ডামি। এই ভণ্ডামি মূলত ধর্মব্যবসা থেকে উদ্ভূত।
জীবদ্দশায় দেওয়ানবাগী পির মাহবুব-এ-খোদা ধর্মব্যবসা করেছেন, তার বিরোধীপক্ষও ধর্মব্যবসা করছে। দেওয়ানবাগীর বিরোধীরা তাকে ভণ্ড পির বলে থাকে। এই বিরোধীরাও আবার ধর্মের নামে ব্যবসায় সিদ্ধহস্ত বলে নিজেরাও ভণ্ড। ভণ্ড-ভণ্ড মুখোমুখি অবস্থানে। কে এখানে বেশি ভণ্ড আর কে কম ভণ্ড- এসব নিয়েও এখানে আলোচনার প্রয়োজন নেই। ভণ্ডামিতে কম-বেশি যাই হোক ভণ্ডদের পরিচয় কেবল ভণ্ডই! সেজন্যে কারও পক্ষে অথবা বিপক্ষে যাওয়ার কিছু নেই। কে কাকে বেহেশতে পাঠাল আর কে কাকে দোজখে পাঠাল এনিয়েও তাই মাথাব্যথার কিছু নাই। এই সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা যখন মানুষের নাই তাই এসবে বিশ্বাস স্থাপন করাটাও অনুচিত।
আমরা একান্তই কিছু দেখতে হলে দেখব জীবদ্দশায় তিনি কী করেছেন? তিনি সমাজের জন্যে ক্ষতিকারক কিছু কি ছিলেন? এসব নিয়েই আমাদের আলোচনার দরকার, অন্য কিছু নয়। মৃত্যুর আগে থেকেও তার নাম জানলেও তাকে নিয়ে ভাবার প্রয়োজন মনে করিনি, এখনও না। নেটিজেনদের প্রতিক্রিয়া ও অতি-ধার্মিকদের বেহেশত-দোজখের ফায়সালা দেখে বলি এই সিদ্ধান্ত দেওয়ার দরকার নেই আমাদের; এই সিদ্ধান্ত যারা দিচ্ছে তারা নিজেরাই জানে না তারা কোথায় যাবে।
দিন-দিন আমাদের সমাজ ধর্মব্যবসার উর্বর ক্ষেত্র হয়ে ওঠছে। এখানে ধর্মের নামে সবকিছুই সম্ভব। কাউকে বেহেশতে পাঠাচ্ছে একদল লোক, কাউকে দোজখে পাঠাচ্ছে আরেকদল লোক। এরা আবার নিজেদের লোকজন ছাড়া অন্যদের মুসলমান ভাবতেও রাজি নন। তাদের এসব প্রচারণার ব্যাপ্তি বাড়তে থাকার প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষেরাও বিভ্রান্ত হচ্ছে। বিভ্রান্তিটা এমন চরমে পৌঁছেছে যে তাদের বিশ্বাসের পরকালের বিচারটা ইহকালে কেউ করে ফেললে সেটাও বিশ্বাস করছে বিশাল একটা শ্রেণি। কথিত এই বিচারকেরা নিজেদের বেহেশতবাসী ভাবলেও মৃত্যুতে তাদেরও সবিশেষ ভয়। মৃত্যুর পর তারা বেহেশতে যাবে এমন ভাবলেও সেই মৃত্যুটা বরণ করতে রাজি না। অদ্ভুত!
দেওয়ানবাগী পিরের মৃত্যুর পর বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে তার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়। তিনি মুক্তিযোদ্ধা থাকলে একাত্তরে তার ভূমিকার প্রতি অবশ্যই শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা থাকবে। স্বাধিকার, স্বাধীনতা আর ধর্মনিরপেক্ষ জাতি-রাষ্ট্র গঠনে যে যুদ্ধ ছিল সেখানে তিনি অংশগ্রহণ করলেও একাত্তর পরবর্তী তার ভূমিকা নিশ্চিতভাবেই গৌরবের নয়। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র যেখানে স্বপ্ন ছিল মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী বাঙালির সেখানে বিজয়ের পর ধর্মব্যবসার কেন্দ্র স্থাপন করে তিনি অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। এটা প্রগতির গলা চেপে ধরার নামান্তর। প্রগতির পথ রুদ্ধ করে প্রতিক্রিয়াশীলতার চর্চাকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে অন্য অনেকের মত তিনিও দেশের ক্ষতি করেছেন। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে হুমায়ুন আজাদের প্রবচনগুচ্ছ। বিহুমাত্রিক এই জ্যোর্তিময় বলেছিলেন, একবার রাজাকার মানে চিরকাল রাজাকার; কিন্তু একবার মুক্তিযোদ্ধা মানে চিরকাল মুক্তিযোদ্ধা নয়। অন্য অনেক প্রবচনের মত অন্য অনেকের চরিত্রের সঙ্গে দেওয়ানবাগী পিরের চরিত্রও হুমায়ুন আজাদের প্রবচনের সঙ্গে মিলে যায়।
দেওয়ানবাগী পির বেহেশতে নাকি দোজখে যাবেন এনিয়ে আমার আগ্রহ নাই। আমি হতাশ ইহকালে বসে পরকালের বিচার করে ফেলা অতি-ধার্মিকদের টলটলায়মান বিশ্বাস দেখে। আমি হতাশ ধর্মনিরপেক্ষ চেতনায় যুদ্ধে যাওয়া আরও এক বিভ্রান্তজনের ধর্মব্যবসার কাহিনী শুনে।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
- ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১: জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ’
- সুনীল অর্থনীতি ও রূপকল্প-২০৪১
- শিক্ষার ধরন ও বেকারত্ব: দেশে অশিক্ষিতদের চেয়ে শিক্ষিত বেকার ৩ গুন
- ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়
- ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস-১৯৬১ ও দ্বিপক্ষিয় কূটনীতিক সম্পর্ক
- মিডিয়ার শক্তি বা আসক্তি: ম্যাজিক বুলেটের বাকের ভাই ও বদি
- গণমাধ্যমে গণরুচির বিকার
- হালকা বিনোদনের প্রাধান্যে সংস্কৃতির অবনতি
- বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণার দিন শেষ, চার উপায়ে মধ্য আয়ের দেশ