পদ্মাসেতু আমার পদ্মাসেতু ।।মাহমুদ মেনন।।
পদ্মাসেতু আমার পদ্মাসেতু ।।মাহমুদ মেনন।।
পদ্মাসেতু |
২০১৪ সালের নভেম্বরের কোনও একটি দিন। প্রথম সেদিন পদ্মার পাড়ে যাই এই সেতুর কাজ দেখতে। সেদিন ওপারে জাজিরা অংশে একটি কালো তাবু আর এপারে মাওয়া অংশে একটি সবুজ রঙা সাইনবোর্ড ছাড়া কিছুই চোখে পড়েনি। সাইনবোর্ডটি পুরোনো। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার গঠনের পর এই সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন সে মেয়াদের শেষ বর্ষে ২০০১ সালের ৪ জুলাই। প্রায় ১৪ বছর পর তারই সাক্ষ্য বহন করছিলো সে সাইনবোর্ড। ট্রলারে পাড়ি দিয়ে নদী ওপাড়ে জাজিরা পৌঁছে চোখে পড়ে কালো রঙের তাবুটি। সেই তাবুর আশেপাশে জনা কয়েক চিনা বিজ্ঞানী কাজ করছিলেন। লম্বা লম্বা কিছু পাইপ মাটির গভীরে পোতা হচ্ছে মেশিনের সাহায্যে। কাছে এগিয়ে চীনাদের কাছে জানতে চাইলে - নো ইংলিশ, নো ইংলিশ বলে এড়িয়ে গেলেন। বাঙালি জনা কয়েক শ্রমিক ছিলেন, তারা জানালেন মাটির পরীক্ষা চলছে এখানটাতে সেতুর পিলার বসবে।
কোথায় সেতু? কোথায় পিলার? অদুরে একটি পাইপ লাইনের মাথায় উঁচু ধারায় পড়ছিলো কাদামাটি। সেটি দিয়ে মাটি ভরাটের কাজ চলছিলো। সে পথে অনেক দূর এগিয়ে গেলে নাওডোবা নদী। বিস্তৃত চরাঞ্চলে সে নদীর অস্তিত্ব কিছু নেই। তবে গ্রামাঞ্চলে বাড়িগুলোতে একটি চাঞ্চল্য চোখে পড়লো। সেখানে গ্রামের মানুষেরা নিজেদের ঘর ভেঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কাঁদছেন ভিটেমাটি ছাড়ার কষ্টে, কেউ হাসতে হাসতেই ছাড়ছেন বাড়ি। মোটা অংকের ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। অন্যত্র বাড়ি বানাবেন। কেউ কেউ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন এই গর্বের ঘোষণা দিলেন তাদেরেই জমির উপর দিয়ে হবে পদ্মাসেতু। সবার চোখেই স্বপ্ন।
সেদিনের সে সবকিছুই ছিলো কল্পনা। সবটাই স্বপ্ন। স্বপ্নের সে সেতু দেখতে কেমন হবে সে নিয়ে্ও ছিলো অনেক জল্পনা। তবে হাতে ছিলো সুনির্দিষ্ট এক পরিকল্পনা্। প্রকল্প এলাকায় গিয়ে প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সোনালী রঙা এক স্বপ্নের সেতুর কথা। তবে সবকিছুই তখন নকশায় বিদ্যমান। তার থ্রি-ডি প্রজেকশনে বাস্তবের বারতা আছে তবে তখনও তা স্বপ্নের মতোই অদৃশ্যমান।
একদিন গেলাম অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর কাছে। তিনি ছিলেন সেতু প্রকোশল উপদেষ্টা কমিটির প্রধান। উদ্দেশ্য তার কাছ থেকেই জেনে নেওয়া- কিভাবে বাস্তবায়ন হবে এই সেতু প্রকল্প। স্যার দীর্ঘক্ষণ ধরে ছবি এঁকে অংক কষে বুঝাচ্ছিলেন পদ্মাসেতুর হিসাব নিকাশ। তবে তাতে গুরুত্ব পেলো পদ্মার পানির প্রবাহ, তলদেশের মাটির গতি প্রকৃতি। স্যার বললেন, পদ্মার তলদেশে মাটি এত বেশি তার রূপ ও স্থান বদলায় যে কখনো কখনো কয়েক শ’ ফুট গভীর পর্যন্ত মাটি সরে যায়। পলি জমে আবার সে পলি সরে যায়। সুতরাং খরস্রোতা- কীর্তিনাশা পদ্মাকে জয় করে কিভাবে সেতু হবে সেটা এক বিশাল চ্যালেঞ্জ।
আজ যখন পদ্মাসেতু তার পূর্ণ কাঠামো পেলো, বসে গেলো সেতুর উপরে সবশেষ স্প্যানটি্ও তখন আর বলার অপেক্ষাই রাখে না সকল চ্যালেঞ্জ জয় করে বাংলাদেশে গড়েছে সেই ইতিহাস, যা বিশ্বের খুব কম জাতিই গড়তে পেরেছে তাদের দেশে।
পদ্মাসেতু আমাদের নিজেদের অর্থায়নে তৈরি। যা সেদিনও ছিলো অকল্পনীয়। মনে পড়ে ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বরের কথা। গিয়েছিলাম পদ্মাতীরে। সেদিন পদ্মায় গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্দেশ্য সেতুর নির্মাণ কাজের উদ্বোধন। পদ্মার জাজিরা পাড়ে নদীশাসন ও মাওয়া পাড়ে পাইলিং কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে এর নির্মাণযজ্ঞ শুরু হয়। সেদিন এক সুধী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন-
”কারও কাছে হাত পেতে নয়। আমরা স্বাবলম্বী হয়ে চলবো। বাঙালি কারও কাছে মাথা নত করেনি, করবেও না। বাঙালি জাতিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। আজও তা-ই প্রমাণিত হয়েছে। শত বাধার মুখেও বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে, তারা পারে। অনেক ঝড়-ঝাপ্টা-চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আমরা পদ্মাসেতু নির্মাণ কাজ শুরু করেছি।”
সেদিনই শুরু হয়েছিলো কর্মযজ্ঞ। মুন্সীগঞ্জের মাওয়া পাড়ে ঠিক দুপুর ১২টা ৫৭ মিনিটে সুইচ পাইলিংয়ের অন করে মূল সেতুর নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।
সেই শুরু এরপর কেটে গেছে পাঁচটি বছর।
কেউ কেউ সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় পিছানো নিয়ে নানা কথা বলেন, আমি সেটা মোটেই বলতে চাইনা। একজন রিপোর্টার হিসেবে অন্তত ডজন তিনেক বার এই সেতু প্রকল্পে গেছি। এবং দেখেছি এর কর্মযজ্ঞ। প্রতিটি কাজের বিস্তারিত বিষয়গুলো যখন জানা তখন জানি এই কাজে সময় লাগবেই। এর মধ্য নদীর তলদেশে মাটির প্রকৃতির কারণে এর পাইলিং পদ্ধতিতে আনতে হয়েছে অনেক পরিবর্তন। পরিবর্তন এসেছে পাইলের নকশায়। এর সাথে সাথে পরিবর্তন হয়েছে বাস্তবায়ন পরিকল্পনাও। সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন হয় প্রকৌশলগত। প্রতিটি পিয়ারে ছ’টি করে পাইল বসানোর কথা হলেও পরে সাতটি করে পাইল বসাতে হয়েছে।
সময়তো লাগবেই। আজ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত শ্বাসরুদ্ধকর আড়াই ঘণ্টার কথাই ভাবুন। আগের রাতেই ক্রেন তিয়ান-ই ১২ ও ১৩ নম্বর পিয়ারের কাছে বয়ে নিয়ে আসে ৪১ নম্বর স্প্যানটি। বৃহস্পতিবার সকালটি ছিলো কুয়াশাচ্ছন্ন। তারই মধ্যে সকাল সাড়ে নয়টায় কাজ শুরু করেন প্রকৌশলীরা। প্রথমে তিয়ান-ইকে ১২ ও ১৩ নম্বর পিয়ারের মাঝ বরাবরা স্থাপন করে নেওয়া, এরপর স্প্যানটিকে উপরের দিকে সেতুর বরাবরে তুলে নিয়ে যাওয়া অতপর সেটিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সেতুর সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলো দুই পিয়ারে চারটি বিয়ারিং প্যাড। উপর থেকে ধীরে ধীরে সেই প্যাডের উপর বসিয়ে দেওয়া হয় ৩ হাজার ৫০০ টন ওজনের স্প্যানটি। সব কিছুই চলছিলো কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে। তাতেও লেগে যায় আড়াই ঘণ্টা সময়।
এভাবেই সময় লেগেছে কাজগুলো সম্পন্ন করতে। সমালোচকরা আরও অনেক কথা বলেন, কিংবা বলেছেন। রাজনৈতিক কারণে কিংবা অন্য যে কোনও স্বার্থবাদীতার কারনেই হোক সে সব বক্তব্য অতীতেও গুরুত্ব বহন করেনি এখনতো আরও নয়।
তবে কিছু কথা আজও শিহরণ জাগায়। প্রধানমন্ত্রী সেই নির্মাণকাজ উদ্বোধনের দিন বলেছিলেন, ভিক্ষা চেয়ে নয়, হাত পেতে নয়, বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু তৈরি করছে। বাংলাদেশ পারবে। আমি বিশ্বাস করি। লাখো শহীদ রক্ত দিয়ে এ দেশ স্বাধীন করেছে। এখন এ স্বাধীন দেশের মানুষই পদ্মাসেতু নির্মাণ করবে।
সত্যিই দেশের মানুষের অবদান, উদ্যম ও ভালোবাসায় আজ সে তৈরি হচ্ছে সেই পদ্মাসেতু। আমরা গর্বিত। এর মালিক দেশের প্রতিটি মানুষ। আমার, আপনার, আমাদের সকলের পদ্মাসেতু।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
- ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১: জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ’
- সুনীল অর্থনীতি ও রূপকল্প-২০৪১
- শিক্ষার ধরন ও বেকারত্ব: দেশে অশিক্ষিতদের চেয়ে শিক্ষিত বেকার ৩ গুন
- ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়
- ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস-১৯৬১ ও দ্বিপক্ষিয় কূটনীতিক সম্পর্ক
- মিডিয়ার শক্তি বা আসক্তি: ম্যাজিক বুলেটের বাকের ভাই ও বদি
- গণমাধ্যমে গণরুচির বিকার
- হালকা বিনোদনের প্রাধান্যে সংস্কৃতির অবনতি
- বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণার দিন শেষ, চার উপায়ে মধ্য আয়ের দেশ