শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪ || ৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

আর কত অবহেলিত থাকবে নারী 

জান্নাতুল যূথী

১১:০৫, ১৫ জুন ২০২২

১৭২৮

আর কত অবহেলিত থাকবে নারী 

একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত নারীর মূল্য কোথাও দেওয়া হয়নি। বরং তাকে তার সতীত্ব প্রমাণে বারবার পরীক্ষা দিতে হয়েছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, নারীর জীবন কোনোদিন সম্মানের মর্যাদার ছিল না।

রমায়ণ, মহাভারত, প্রাচীন সাহিত্য পাঠে এটায় বোঝা যায়, নারী আজীবন সমাজের জঞ্জালরূপে প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু এই নারী না থাকলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেতো। এ সম্পর্কে ‘নারীর মূল্য’ প্রবন্ধে অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮) বলেছেন, ‘নারীত্বের মূল্য কী? অর্থাৎ কী পরিমাণে তিনি সেবাপরায়ণা, স্নেহশীলা, সতী ও দুঃখে-কষ্টে মৌনা। অর্থাৎ তাঁহাকে লইয়া কী পরিমাণে মানুষের সুখ ও সুবিধা ঘটিবে এবং কী পরিমাণে তিনি রূপসী। অর্থাৎ পুরুষের লালন ও প্রবৃত্তিকে কতটা পরিমাণে তিনি নিবদ্ধ ও তৃপ্ত রাখিতে পারিবেন। দাম কষিবার এ ছাড়া যে আর কোনো পথ নাই, সে কথা আমি পৃথিবীর ইতিহাস খুলিয়া প্রমাণ করিয়া দিতে পারি।’

শরৎচন্দ্রের এই পর্যবেক্ষণ প্রাচীনকাল থেকে আজ অবধি যে বিদ্যমান, তা সমাজের প্রতিটি পরতে পরতে বিদ্যমান। রামায়ণ যারা পাঠ করেছেন, তারা নিশ্চিতভাবেই জানেন সীতাকে বারবার সতীত্ব পরীক্ষা দিতে কত কষ্টই না পোহাতে হয়েছে! আবার যারা মহাভারত পড়েছেন, তারাও একটু লক্ষ করলে দেখবেন কুন্তি, মাদ্রি, গান্ধারী, হিড়িম্বা, দ্রৌপদী, সুভদ্রা, উত্তরা, সব নারীই অবহেলিত! পুরুষের রোষ নারীদের ওপর দিয়ে গেছে।

কুন্তিকে রেখে মাদ্রিকে বিয়ে করে পাণ্ডু। এরপর ঋষির শাপে মিলনকালে পাণ্ডুর মৃত্যু ঘটে। সেখানে ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার নারী। আবার দিনের পর দিন সন্তানকে লালন করতে কুন্তিকে সহ্য করতে হয়েছে অপরিসীম গঞ্জনা! গান্ধারী তো আজীবন পুরুষতন্ত্রের শিকার হয়ে অন্ধত্ব বরণ করলো চোখে কাপড় বেঁধে! ঠিক তেমনি দ্রৌপদীও লাঞ্ছনার শিকার! এমনকী তার যে অপমান-অসম্মানের যাত্রা শুরু, তা মহাভারতের সর্বত্র ছড়ানো। এক নারীকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে পঞ্চপাণ্ডবকে বিয়ে করতে হলো। কিন্তু কেন?

মহাদেব শিবের বরও দ্রৌপদীর ভাগ্যরেখার সঙ্গে প্রহসনের মেতে উঠেছিল। দ্রৌপদী না বুঝেই ‘পতি’ বর চেয়েছিলেন পাঁচবার। শিবও তাই দ্রৌপদীকে ‘পাঁচ পতির’ বর দিয়ে রেখেছিলেন। যার পরিণতিতে পরবর্তী সময়ে স্বয়ম্বর সভায় তাকে অর্জুন জয় করলেও, কুন্তির নির্দেশে পঞ্চপাণ্ডবই তার পঞ্চস্বামীতে পরিণত হলো। অথচ হস্তিনাপুরের দ্যুত সভায় সেই পঞ্চপাণ্ডবের জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠির পাশাখেলায় দ্রৌপদীকেই বাজি রাখে! সেই বাজিতে হেরে যাওয়ার ফলই হলো, দুঃশাসনের হাতে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের কারণ।

নারীর সহনশীলতা-ধৈর্য সম্পর্কে শরৎচন্দ্রের উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য ‘আশ্চর্য এত অত্যাচার, অবিচার, পৈশাচিক নিষ্ঠুরতা সহ্য করা সত্ত্বেও নারী চিরদিন পুরুষকে স্নেহ করিয়াছে, শ্রদ্ধা করিয়াছে, ভক্তি করিয়াছে এবং বিশ্বাস করিয়াছে। যাহাকে সে পিতা বলে, ভ্রাতা বলে, সে যে এত নীচ, এমন প্রবঞ্চক, এ কথা বোধ করি সে স্বপ্নেও ভাবিতে পারে না। বোধকরি এখানেই তাহার মূল্য।’ নারী বরাবর কোমলপ্রাণের অধিকারিণী। তাই এত শ্রদ্ধাহীন, মর্যাদাহীনতাকে সে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে আসছে। কিন্তু নারীর আত্মশক্তিতে বলীয়ান হতে হবে। নিজেদের সম্মান যোগ্যতা বুঝতে হবে। রাময়ণের যুগ থেকে নারীকে নিজের সতীত্ব পরীক্ষা দিতে হয়। সমাজে কোনোদিন কেউ শুনেছেন যে, পুরুষের সতীত্ব পরীক্ষা বলে কিছু আছে? বা তারা কখনো এ ধরনের সমস্যায় পড়েছে কি না!

এমনকী মানবজাতির যে বংশ বিস্তার, সেখানে ইভকে দায়ী করা হয়! তাহলে নারীই কি সব কিছুর মূল! নারী সৃষ্টির মূলে কিন্তু সেটা অস্বীকার করে নারীকে অসম্মান-অশ্রদ্ধা করা হয় প্রতিনিয়ত। সমাজে যত শব্দ আছে, তার কটা পুরুষের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে! যত স্ল্যাং, যত বাজে ধরনের মন্তব্য, সবই নারীকে নিয়ে করা হয়। ইংরেজি সাহিত্য থেকে ভারতীয় সাহিত্য, সংস্কৃতি; সব ঘাটলেও পুরুষের জন্য অসম্মানকর কোনো কিছুর প্রচলন সমাজ নেই। কিন্তু নারীর জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে বাধার ফাঁদ। প্রাচীন যুগের দিকে তাকলে দেখতে পায়, একসময় পতির মৃত্যু হলে নারীকে সহমরণে যেতে হতো। সে সময় ঢাক, ঢোল, ধোঁয়া সৃষ্টি করে তোলা হতো। যেন নারীর আর্তচিৎকার অন্যরা না শোনে! এভাবেই পতির সঙ্গে স্বর্গ যাত্রা করতে হতো সতিকে! কিন্তু কোনো পুরুষ কখনো আত্মহুতি দিয়েছি নারীর জন্য? না দেয়নি।

আবার যখন এই নারীদের সহমরণ রোধ করা হলো, তখন তাদের দেবী করে তোলা হলো! সেই দেবী নিরামিষভোজী, থান পরবে। কিন্তু এই দেবী আবার কারও মঙ্গল কামনায় অংশ নিতে পারবে না। কারণ বিধবা তো! অন্যের অমঙ্গল হবে। কিন্তু যে দেবী, তার তো সবারই কল্যাণ করার কথা। তাহলে অমঙ্গল কেন হবে! সে সময়কার পুরুতরা নারীদের ঘরবন্দি রাখতে পায়ের তলায় পিষে শোষণ করতে সামজিক বিভিন্ন রীতিনীতির জন্ম দিয়েছিল। সময় হয়তো গড়িয়েছে কিন্তু নারীর মূল্য কি বেড়েছে? নারী কী আজ পূর্ণ স্বাধীন! নারীর নিরাপত্তা কি নিশ্চিত হয়েছে? প্রশ্নগুলোর উত্তর বেশিরভাগই ‘না’। তাহলে নারীর এই হীনদশা কবে ঘুচবে?

আবহমানকাল ধরে চলে আসা রীতি-নীতি অনুযায়ী নারীকে কখনো যোগ্য সম্মান-মর্যাদা দেওয়া হয়নি। যুগের পরিবর্তন ঘটেছে তবুও নারী ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার! নারীর এই হীনদশা কাটাতে নারীকে সব অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। পড়াশোনা করে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করার ব্রত গ্রহণ করতে হবে। নারীর যে অপরিমেয় শক্তি, যোগ্যতা আছে; সেটা নিজে প্রাণে বিশ্বাস করতে হবে। আর সে অনুযায়ী সামনে অগ্রসর হতে হবে। নারীর মূল্য নারীকেই তৈরি করতে হবে। নাহলে এ সমাজে কোনোদিনই পুরুষতন্ত্র নারীকে মর্যাদা-সম্মানের সঙ্গে বেড়ে উঠতে দেবে না। তাই নারীর নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হবে। আওয়াজ তুলতে হবে সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে।

লেখক: গবেষক-শিক্ষক, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank