শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪ || ৯ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

পড়ে আছে চন্দনের চিতা: সৌমিত্র ও সত্যজিৎ

আনোয়ার হোসেন পিন্টু

০০:৫৭, ১৬ নভেম্বর ২০২০

৪৭১৫

পড়ে আছে চন্দনের চিতা: সৌমিত্র ও সত্যজিৎ

কোনটা বেশি প্রিয়? ফুল না ফুলের মত মুখ? একই সুরে যদি বলি, কে বেশি প্রিয়, অপু, না সৌমিত্র? একটু ভাবতে হয় বৈকি? কেননা ফুলের নির্জলা রূপ, সে তো এক অর্থে নির্মল সরোবর। অবসন্ন কি ক্ষয়ে পড়া মন তার এক আঁজলা জলের পরশে হয়ে ওঠে সতেজ ও সজীব। সেখানেই সে দুর্জয় ও অদ্বিতীয়। আর উপমার রেশ ধরে কারো চোখে বা মুখে ফুলের প্রতিচ্ছবি খোঁজে পাওয়ার আনন্দ, সে তো রূপ-কথা। খাঁটি হয়তো নয়, কিন্তু জীয়নকাঠির ছোঁয়ায় অনুভবের রূপকুশলী যদি পলকের তরে ফিরে তাকায় ক্ষতি কি? 

জীবন-সীমানার তেমন একটি ফুল কি অপুকে বিভূতিভূষণের রূপ দিয়েছিলেন কথাশিল্পের ঘরে। সেখান থেকে সত্যজিৎ তাঁর ক্যামেরায় মানিকের মত করে সেই অপুকে করে তুলেছিলেন জীবন চৈতন্যের প্রতীক। বলা বাহুল্য, প্রতীকের রূপ-মাধুর্য চোখে দেখা বাস্তবতার সীমানা ছাড়িয়ে আরো অনেক বেশি প্রসারিত। সুতরাং ‘পাখির নিড়ের মত চোখ তুলে’ সত্য থেকে আরো বেশি সত্যের আবেশে সৌমিত্রও হয়ে উঠেছে আমাদের ভাব ও ভাবনায় অনন্য এক নাম। যেখানে ফুল, ফুলের মত মুখ, অপু কি সৌমিত্র পরস্পর মিলেমিশে একাকার। 

ছবিতে (পথের পাঁচালী) অপুর জন্ম এক ঘনঘোর রাতে। আঁতুরঘরে প্রসবযন্ত্রণায় কাতর সর্বজয়ার মুখ থেকে ভেসে ওঠে পর্দায় ভোরের আলো। বাড়ির পথ ধরে তখন এগিয়ে আসছে ইন্দির ও দুর্গা। কলসিকাঁখে এক জনৈকা ইন্দিরের উদ্দেশ্যে বলে উঠে, ‘যান, গিয়ে দেখুন কেমন টুকটুকে ভাইপো হয়েছে আপনার’। ইন্দির উঠোনে ঢুকে ‘কই গো। খোকা কৈ....’ বলতে বলতে প্রায় পড়িমড়ি করে ছুটে যায় আঁতুরঘরে। নবজাতকের মুখ দেখে আনন্দমাখা কান্নায় ইন্দির বলে উঠে এবার: ‘দিব্যি হয়েছে দিব্যি হয়েছে’। 
আসলেই সে ‘দিব্যি’ ও ‘টুকটুকে’। শুধু রূপে নয়-গুণেও। না হয় কেনইবা ছুটে যাবে অপু আসন ছেড়ে ‘যাত্রা’ মঞ্চের দিকে? বিশ্বচলচ্চিত্রে পরিমিত গুণের অধিকারী সত্যজিতের হাতে পথের পাঁচালীর ‘যাত্রা’ দৃশ্যটি ছিল বড় বেশি দীর্ঘ। বহুবার দেখা উক্ত ছবির সেই দৃশ্যটির কাছে চোখ হয়ে উঠে ধৈর্য্যহীন। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝে ফেলি আবার, এই দেখা তো আমার নয়, অপুর চোখ দিয়ে দেখা ঘনঘোর আবেশে দৃশ্যটির মুর্চ্ছনা সত্যজিৎ তুলে ধরেছিলেন আমাদের মনের মুকুরে। এতই তার অন্তহীন গভীরতা, পরের শটে আমরা দেখি অপুর মুখ আয়নায় প্রতিফলিত। তার কচিকোমল হাত দু’টি কাগজের তৈরি গোঁফ লাগতে ব্যস্ত নাকের নিচে, কপালে বাঁধা রাংতার মুকুট।

কিসের ঐ আয়না? কিসের ঐ প্রতিফলন? মনের মুকুরে গেঁথে যাওয়ার নামই কি জীবন-দর্পণ? সবিশেষ আগ্রহ কি কৌতুহল সব ব্যাপারেই ছিল অপু টইটুম্বুর। ভুলবার নয় কোনদিন, রাতে দাওয়ায় বাবার পাশে বসে অপুর স্লেটে লেখার মুহূর্তটির কথা! হঠাৎ নিঝুম রাতের নীরবতা ভেঙে ভেসে আসে অপুর কানে কু - ঝিক ঝিক ঝিক শব্দ। মন্ত্রমুগ্ধের বিস্ময় নিয়ে অদূরে বসা দিদি দুর্গাকে প্রশ্ন করে অপু- তুই রেলগাড়ি দেখেছিস? কোথায় রে? একদিন যাবি? সহজ সরল প্রশ্ন কি সংলাপ। কিন্তু বোধে বেড়ে ওঠা এসব অনুষঙ্গ দিয়েই তো অপু বুঝেছিল একদিন, মালাচুরির দায় থেকে চিরতরে হারিয়ে যাওয়া দিদিকে কারো চোখেই ছোট করা যাবে না। তাই দিদির লুকিয়ে রাখা নারকেল খোলে পাওয়া মালাটি অপু নিমিষেই ছুঁড়ে দিতে পারে পানাঢাকা পুকুরে। 

তেমন করে অপু কিছু ছুঁড়ে দিয়েছিল কি আপনার মনে? আরো খানিকটা আগ বাড়িয়ে যদি বলি, রাজসাজে অপুর সেই দেখা আয়নায় খুঁজে কি ফেরেননি নিজেকে নিজে? সিনেমা, নাটকে, কবিতায় এমনকি আপনার আবৃত্তিচর্চার মাঝেও জড়িয়ে আছে অলক্ষে ‘অপরাজিত’র অপুর কবিতা পাঠের অনুভূতি। ‘আচ্ছা বল ত কিশলয় মানে কি? স্কুল পরিদর্শক ইন্সপেক্টর প্রশ্ন করেন ক্লাশের এক ছাত্রকে। ছাত্রটি নিরুত্তর। এবার উঠে দাঁড়ায় অপু। বলে, ‘কিশলয় মানে কচিপাতা’। এরপর পরিদর্শক এগিয়ে দেন ‘কিশলয়’ নামের বইটি অপুর হাতে। একটি লেখার দিকে নির্দেশ করে বলেন তিনি: রিডিং পড়ত। 
মনে আছে আমাদের, অপুর সেই ‘রিডিং’ ছিল কেবল পড়ার জন্যই পড়া নয়। ছন্দের বোলে বোলে, সুরে সুরে অপু পড়তে শুরু করে- 
কোন দেশেতে তরুলতা
সকল দেশের চাইতে শ্যামল
কোন দেশেতে চলতে গেলে
দোলতে হয়রে দুর্বা কোমল?
কোথায় ফলে সোনার ফসল 
সোনার কমল ফোটে রে। 
সে আমাদের বাংলাদেশ
আমাদেরই বাংলা রে।
কোথায় ডাকে দোয়েল শ্যামা
ফিঙ্গে নাচে গাছে গাছে
কোথায় জলে মরাল চলে
মরালী তার পাশে পাশে
বাবুই কোথা বাসা বুনে
চাতক বারি যাচে রে
সে আমাদের বাংলাদেশ
আমাদেরই বাংলা রে।

কেমন ছিল অপুর সেই কাব্যপাঠ। উত্তর আঁকা আছে ইন্সপেক্টরের হাসি মুখরিত মুখের কোলে। কবিতা পাঠের এক ফাঁকে অপু থেকে সত্যজিতের ক্যামেরা সরে আসে শ্রবণরত ইন্সপেক্টরের মন্ত্রমুগ্ধ মুখে। মুখ ত নয়, যেন অথৈ জলের টলমল রূপ!

বছর কয়েক আগে হাতে পেলাম কলকাতা থেকে প্রকাশিত গ্রন্থ ‘সৌমিত্র’। প্রায় পাঁচ’শ পৃষ্ঠার এ্যালবাম আকারের গ্রন্থের ৩৬০ পৃষ্ঠায় এসে থমকে দাঁড়ালাম। মনে পড়ে গেল ‘অপরাজিত’ ছবির উপরোক্ত দৃশ্য ও ব্যাকুলতা! কি করে মিলে যায় শিল্পের অনুক্ষণ জীবনের প্রতিভাসে! মানুষ ভিন্ন, কিন্তু দৃশ্যের ব্যঞ্জনা অবিকল এক। মাইক্রোফোন হাতে অপুর জায়গায় সৌমিত্র কাব্যপাঠে মগ্ন, পাশে বসা ইন্সপেক্টরের প্রতিভ‚ হয়ে বিশ্ববরেণ্য সেতারী রবিশঙ্কর চোখ বুঝে শুনছেন আপনার কবিতাপাঠ কি আবৃত্তি! চলে আসি ‘অপুর সংসার’ এ, আপনার অভিনীত প্রথম ছবির কাছে। প্রথম ছবি, কিন্তু অদ্বিতীয় সে অভিনয়! অবশ্য তার সংজ্ঞা যদি হয় আপন চরিত্র ও সত্তার বিলুপ ঘটিয়ে অন্য কোন মানুষ বা চরিত্রের যথার্থ দোলাচলে মেতে ওঠা, তবে অন্যান্য ছবিতে আপনার অভিনয় আরো অনেক বেশি পারঙ্গম। কিন্তু ‘অপূর্বকুমার রায়’ সে তো আপনার, আমার আত্মার সহোদর! বিশেষত হাজার পোড়খাওয়া বাঙালি যুবকের প্রতিনিধি হয়ে মিশে আছে সেজন অপুর সংসারে আদি-অন্ত বাঁধনে। অভিনয় সেখানে অচল। ঘষে মেঝে চালাতে গেলে মুখ থুবড়ে পড়ার ভয় প্রতিমুহূর্তেই। 

প্রসঙ্গসূত্রে মনে পড়ছে, যে যা নয় তাকে তা করানোর চেষ্টা থেকে বিরত ছিলেন বলেই বিভূতিভূষণের অবিস্মরণীয় গল্প ‘দ্রবময়ীর কাশিবাস’ চিত্ররূপ থেকে বিরত ছিলেন সত্যজিৎ। ইচ্ছে ছিল তাঁর ‘পথের পাঁচালী’র পর ‘দ্রবময়ীর কাশিবাস’ নিয়ে মেতে ওঠা। কিন্তু পারেননি। কারণ ‘পথের পাঁচালী মুক্তি পাবার অল্প কয়েকদিন আগেই চুনিবালা কোমর ভেঙ্গে শয্যা নেন। আর সেই যে শরীর ভাঙল তারপর থেকে তার পরলোকগমন পর্যন্ত আর কর্মক্ষমতা ফিরে আসেনি। দ্রবময়ীর কাহিনী বইয়ের পাতাতেই রয়ে গেল। চুনিবালার অভাব পূরণ করার মত অভিনেত্রী এদেশে আর আছে কি? মনে হয় না’।

কিন্তু সেই সত্যজিতের চৌদ্দটি ছবিতে (প্রামাণ্যচিত্র ‘রবীন্দ্রনাথ’ ও সুকুমার রায়’ সহ মোট ষোলটি) সফল অভিনয়ের পরও আপনি যখন মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন ‘গুপী’ (গুপী গাইন বাঘা বাইন) চরিত্রের জন্য, অটল সত্যজিৎ কিছুতেই টলেননি সেদিন আপনার শত অনুনয়ে। বলেছিলেন ওটা’র জন্যে তুমি নও। আসলে সবকিছু সবার জন্য নয়। তারপরও আমরা জানি কতটা নির্ভরশীল ছিলেন আপনার উপর তিনি। তখন কি বলা যায়? উত্তরও লেখা আছে তার সত্যজিতের কলমে অপর্ণার মা’র মুখে: ‘যখনই আমি ওকে পুলুর সঙ্গে দেখেছি তখনই আমার মনে হয়েছে ও আমার কত আপনার! আরো কত ছেলে তো পুলুর সঙ্গে এসেছে গেছে, কিন্তু এত মায়া তো কারুর ওপর পড়েনি।’ কথাটা বলেছিলেন তিনি আঁচলে নিরব কান্নার অশ্রুপাতে। ইন্দিরও বলেছিল সেইভাবে নবজাতক অপুর মুখ দেখে, দিব্য হয়েছে, দিব্যি হয়েছে...। কেন এমন হয় বলুন তো? দুটো দৃশ্যই ছিল এক অর্থে আনন্দের, অপুর জন্ম ও বিয়ে। তবু কেন কাঁদে ওরা বারবার অপুকে পেয়ে কিংবা দেখে? কে জানে এ কান্নার শেষ কোথায়? শেষ নেই যার সেই তো অশেষ। 

আপনার ‘মানিকদার সঙ্গে’ (প্রকাশকাল: ১৯৯২) বইতে পড়েছি প্রথম দিনের শুটিং ছিল আপনার ক্লোজআপ-এ ধরা একটা ঢোক-গেলার মুহূর্ত। ক্ষণে ক্ষণে ছড়ানো অপুর সংসারে আরো বিচিত্র সব মনকাড়া মুহূর্ত ছেড়ে সত্যজিৎ শুরুতেই কেন যে আপনার বা অপুর ঐ মুহূর্তটি বেছে নিয়েছিলেন কে জানে? নাকি প্রায়শ যা ঘটে, ক্যামেরার সামনে নবাগত অভিনেতা, অভিনেত্রীর ভয় ও উৎকণ্ঠাকে সত্যজিৎ কাজে লাগিয়েছিলেন ঝোপ বুঝে কোপ মারার মত কিছু করে। আর আমরা জানি, প্রথম টেকেই আপনার রূপকারের মন জয় করে নিয়েছিলেন আপনি। যদিও বলছি নবাগত, কিন্তু নাটকের সুবাদে কি অপুর সংসারে অপুরূপে অংশগ্রহণের তারও বছরকয়েক আগে সত্যজিতের ইউনিটে যোগ দেওয়া সৌমিত্র’র মত কোন মানুষের পক্ষে ক্যামেরা-ভীতি ব্যাপারটা কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। সুতরাং প্রশ্ন হতে পারে, মুহূর্তটি নিয়ে আমার কেন এত আনচান ভাব? আসলে তুচ্ছ ও সাধারণ ঐ ঢোক-গেলার মুহূর্তটি আমরাও যে প্রতিদিন অলক্ষে কত ভাবে গিলে চলেছি অনেকটা অপু কিংবা আপনার মত করে সেটাও বা ভুলবো কেন? আর আমাদের সঙ্গে সেই ছোট্ট মুহূর্তটি এতটা অভিন্ন, কখনো বলা যাবে না অপুই কেবল সৌমিত্র, আমরাও যে তার কিছুটা অংশীদার। 

‘খরচে কুলিয়ে উঠতে’ পারেনি বলে অপু ‘গ্র্যাজুয়েট’ও হতে পারেনি। ছাদের ছোট্ট এক চিলেকোঠায় থেকে দু’একটি টিউশনি করে যা পায় তাই নিয়ে অপুর সংসার। তিন মাসের বাড়ী ভাড়া বাকী, বাড়ীওয়ালা অঘোরবাবুর সিধে কথা: ‘টাকাটা সংগ্রহ করে রাখবেন, নইলে আমাকে অন্য ভাড়াটে দেখতে হবে’ অপু চললো তাই, চাকরীর খোঁজে। প্রথমে হরিমতি প্রাইমারি স্কুলে, কিন্তু ভাগ্য তার এমনি ইন্টারমিডিয়েট পাশ সত্ত্বেও চাকরী হয় না অপুর, কারণ স্কুলে প্রয়োজন মেট্রিক পাশ শিক্ষকের! তারপর সেখান থেকে উপস্থিত এক ঔষধ কারখানার ম্যানেজারের ঘরে।
তার প্রশ্ন: কি চাই আপনার?
অপু: আপনার ঔষধের কারখানায় লোক নিচ্ছেন শুনলাম, আমি মেট্রিক পাশ। সত্যঢাকা কথায় ঔষধের লেবেলিং এর কাজটা অপুর প্রায় জুটেছিল বটে কিন্তু কণ্ঠনালীর গোড়ায় কোথায় জানি মুহূর্তের জন্য নড়ে উঠেছিল সম্মানবোধের পীড়ন। ‘সকলে কবি নয়, কেউ কেউ কবি’র মত অপু ছা-পোষা মানুষ বা যুবকের প্রতিনিধি হয়েও তার প্রাণ-মন সদা চঞ্চল জীবন-চেতনার অন্য এক আবহে। ফলে মাসে সাতটাকা বাড়ী ভাড়া দিতে যার প্রাণ ওষ্ঠাগত তার বাড়ীতেই টাঙানো থাকে মহাপুরুষদের ছবি। শখের বই বাঁধা দিয়ে, আধপেটা খেয়ে অপু লিখতে পারে তাই ‘মাটির মানুষ’ গল্প, বাজাতে পারে বাঁশিতে মনকাড়া সুর, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি...। আচ্ছা, আপনি কি কখনো মনে করে দেখেছেন, শোক-তাপ আর কষ্টের পাহাড় ডিঙিয়ে অপুর যে নিরন্তর পথ চলা তার শাখা-প্রশাখায় কতটা মিশে আছেন আপনি নিজে বা আমাদের সৌমিত্র?

জানি না, প্রতি উত্তরের পাল্লা কোন্দিকে ভারি হবে আপনার? তবে ‘সৌমিত্রর শত ছবি’ শিরোনামে আনন্দবাজার পত্রিকার সিনে ম্যাগাজিন ‘আনন্দলোক’ এ (১৫ জানুয়ারি ১৯৮৩) স্বপনকুমার ঘোষের প্রতিবেদন সূত্রে জেনেছিলাম, সৌমিত্রর প্রিয় অভিনীত চরিত্রের দশটি ছবির নাম। প্রতিবেদনের মাঝখানে চারপাশে নকশা আঁকা ফ্রেমেবন্দী ‘অপুর সংসার’ শুন্য উক্ত তালিকা দেখে কষ্ট আর, অভিমানে মনে মনে সেদিন বলে উঠেছিলাম দূর ছাই সৌমিত্র। নিকুছি করি তোমার। কিন্তু যত দূরেই ঠেলতে যাই না কেন, ফিরে আসে বারবার দরাজগলায় অপু কি আপনার সেই আবৃত্তি-

আমারে ফিরায়ে লহো অয়ি বসুন্ধরে
কোলের সন্তানে তব কোলের ভিতরে
বিপুল অঞ্চলতলে।
ওগো মা মন্ময়ী
তোমার মৃত্তিকা-মাঝে ব্যাপ্ত হয়ে রই...

কিংবা আবেগ, স্বপ্ন আর জীবনের উচ্ছলতা মাখানো বন্ধু পুলুকে বলা সেই সংলাপ প্রক্ষেপণ: ছেলেটি শহরে এলো, সে পুরুতগিরি করবে না, পড়বে-শিক্ষার ভেতর দিয়ে, Struggle-এর ভেতর দিয়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি, তার কুসংস্কার, গোঁড়ামি সমস্ত কেটে যাচ্ছে। বুদ্ধি দিয়ে ছাড়া সে কোনো কিছু মানতে চাইছে না। কিন্তু তার কল্পনাশক্তি আছে, তার অনুভূতি আছে- ছোটোখাটো জিনিস তাকে সজাগ করছে-তাকে আনন্দ দিচ্ছে। হয়ত তার ভিতরে মহৎ একটা কিছু করার ক্ষমতা আছে, সম্ভাবনা আছে, কিন্তু করছে না। কিন্তু সেইটেই শেষ কথা নয়- সেটা ট্রাজেডিও নয়-সে মহৎ কিছু করছে না-তার দারিদ্র যাচ্ছে না- তার অভাব মিটছে না- তা সত্ত্বেও সে জীবনবিমুখ হচ্ছে না, সে পালাচ্ছে না, escape করছে না- সে বাঁচতে চাইছে, সে বলছে, বাঁচার মধ্যেই সার্থকতা, তার মধ্যেই আনন্দ he wants to live|

মানুষের বাঁচতে চাওয়ার এই আত্ম-দহন, আপনার কবিমনের কলমেও ভর করেছিল ‘শিকড়ের কাছে’ কবিতায় একদিন এইভাবে-

ফেরবার কথা বলি আমি বারেবারে
শিকড়ের কাছে পাতা কি ফিরতে পারে
তবু ফিরে এস-শোকেরই নাছোড় জিদ
আকাশ ছুঁলেও কি মাটি খোঁজে উদ্ভিদ। 
সে জেদের বশবর্তী হয়ে আমরাও বলতে চাই সোচ্চারে এক্ষণ

নতুন করে বোনো তোমার
প্রিয় চরিত্রের বয়ন,
বলো বারবার অনুক্ষণ :
অপুই আমার জীবন-মরণ
অপুই আমার বপন

বলুন আর নাই বলুন, সত্যি বলতে কি, যাঁর হাত ধরে আমাদের মনে আপনার বপন, মানুষটিও ছিল অপুর মত ‘টুকটুকে’ ও ‘দিব্যি’। ফলে আপনার প্রসঙ্গে আপনি যতনা প্রাসঙ্গিক, তার চেয়ে যেন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক সকল কাজের কাজী আপনার সেই ‘মানিকদা’ তথা সত্যজিৎ। তার অর্থ এই নয় আপনাকে ছোট করে দেখা। বিস্তীর্ণ সুনীল আকাশে ‘মেঘের ভেলা’র যে ভূমিকা  সত্যজিতের পাশেও ঠিক তেমন ভাবে আপনার অবস্থান। 

কথাটা শুধু বলার জন্যেই বলা নয় আক্ষরিক অর্থেও সত্য। সেটা আমরা দেখেছি দুই আলোকচিত্রীর (তারাপদ ব্যানার্জি ও শুভজিৎ পাল) ক্যামেরায় বেঁধে রাখা দুটি মুহূর্তে। প্রায় একই দৃষ্টিকোণে তোলা শোকে মুহ্যমান পথের পাঁচালীর অপুরূপী সুবীর এবং ‘মানিকদার সঙ্গী’ সৌমিত্র দাঁড়িয়ে আছেন, চিরনিদ্রায় শায়িত তাদের স্রষ্টা সত্যজিতের শিয়রের ঠিক কাছে। মনে আছে ‘দেশ’ পত্রিকায় ছাপা (১৬ মে ১৯৯২) তাঁর মরদেহের পাশে স্বজলচোখে ভেঙেপড়া আপনার ছবির ক্যাপশনটি ছিল: ‘সত্যজিতের প্রয়াণ সৌমিত্রর কাছে দ্বিতীয়বার পিতৃবিয়োগ।’

ফেলুদার মত মনের সন্ধিক্ষণে বেজে ওঠা পূর্বাভাসের রেশ ধরে এমন একটি বিয়োগ-বিধুর মুহূর্তের জন্যই কি লিখে রেখেছিলেন,‘পড়ে আছে চন্দনের চিতা’?

শব ছুঁয়ে বসে আছে কেউ
চলে গেছে শ্মশানের মিতা
আগুনের ভালবাসা চেয়ে
পড়ে আছে চন্দনের চিতা।
কতদিন এইভাবে যাবে
শবের উপরে রেখে জানু
অহল্যা পাথর কবে পাবে
বারুদের ক্রুদ্ধ পরমাণু। 

সে ক্রুদ্ধ পরমাণুর মত একদিন আমিও মেতে উঠেছিলাম আপনার ‘পড়ে আছে চন্দনের চিতা’র কাব্যগ্রন্থের অনুভবে। অবশ্য শহর চট্টগ্রামের এক ফুটপাথে বিছানো পুরনো বইয়ের পশরা থেকে কেনা (১৯৮৫) বইটির মলাটই ছিল কেবল আমার কাছে মূল আকর্ষণ। কারণ এঁকেছিলেন সেটি সত্যজিৎ। ইতিমধ্যে ছেয়ে ফেলেছে মন তাঁর তাবৎ শিল্পকর্মের দুর্বার সম্ভার। যেখানেই মেলে তাঁর হাতের ছোঁয়া, অশেষ বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখি, আর ভাবি, ইশ! এমন করে কে আর পেরেছে, বাবুই পাখির ঘরে জোনাকির আলো ফোটাতে? সত্যি বলতে কি, প্রথম দেখায় জোনাকির আলো ফোটার মত করে চোখে পড়েছিল ‘পড়ে আছে চন্দনের চিতা’র মলাট। নিমিষেই আলোকিত আবার ফলকেই অন্ধকার। পেতে পতে হাত ফসকে ছুটে যাওয়া, আবার পিছল হাতে একটু একটু করে বন্ধনের দ্বার খুলে দেখেছিলাম উক্ত গ্রন্থের মলাট আভরণ! চন্দন রঙের পটভূমির জ্বলন্ত ধূপকাঠির ক্ষয়েপড়া নানা আকারের ফর্মে সাজানো অক্ষর বিন্যাসে লেখা গ্রন্থের নাম তড়িৎবেগে বুঝে নিয়েছিলাম সত্যি, কিন্তু মন বলছিল, কি যেন আছে লুকিয়ে ঐ মালাগাঁথা অক্ষরে। উল্টে-পাল্টে, কাছে-দূরে দাঁড়িয়ে বহুদিন দেখার পর হঠাৎ পেয়ে গেলাম একদিন (নাকি সবুরে মেওয়া ফলে’র ফল) আড়ালে লুকিয়ে আছে তার মানুষের এক প্রোফাইল। এলোমলো প্রায় মাত্রাশূন্য (‘আ’ ছাড়া) চারটি শব্দের আধ্যক্ষরে অর্থাৎ প, আ, চ এবং চি’র গায়ে সত্যজিৎ ম্যাজিকের মত করে তুলি চালিয়ে এঁকেছিলেন জনৈক মানুষের, কপাল, নাক আর থুতনীর প্রতিভাস। 

এমন নাটকীয় কি ইন্দ্রজালিক তুলির ছোঁয়া সত্যজিৎ আর কোন গ্রন্থের মলাটে রেখেছিলেন কিনা জানি না, জানলেও এর অভিঘাত বড় বেশী নির্মম। কেননা বইটির নাম, পড়ে আছে চন্দনের চিতা: আরেক অর্থে যেন আপনার শোক-তাপের বিগলিত পাহাড়। 

আনোয়ার হোসেন পিন্টু: নির্মাতা ও সত্যজিৎ গবেষক।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank