শাবিপ্রবিতে ‘ইগো’ সঙ্কটে বিপন্ন শিক্ষার্থী
শাবিপ্রবিতে ‘ইগো’ সঙ্কটে বিপন্ন শিক্ষার্থী
ছয়দিনের বেশি সময় ধরে অনশনে অসুস্থ শিক্ষার্থীরা। কেউ উপাচার্যের বাসভবনের সামনে, কেউ হাসপাতালের বেডে শুয়ে; সবাই অভুক্ত। উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে অনড়। এক দফা এক দাবি তাদের—উপাচার্যের পদত্যাগ। কেউ ভাবেনি এত দীর্ঘ সময় ধরে তারা অনশন চালিয়ে যাবে। কঠিন, অমানবিক বাস্তবতা এটাই। যারা হাসপাতালে তাদের শরীরে সূচ, স্যালাইনের; যারা ক্যাম্পাসে তাদের অনেকেরও একই অবস্থা। তবু তারা খাবার গ্রহণ করছে না। তারুণ্যের ইস্পাত-দৃঢ় সংকল্প—হয় উপাচার্যের পদত্যাগ, নয়ত মৃত্যু। আকাঙ্ক্ষা ও পরিণতির বিপরীতধর্মী দুই ভবিতব্য! দূর থেকে আমরা অনিশ্চয়তায়; আমরা যেখানে দিন আর ঘণ্টার হিসাবে, তারা সেখানে অসহনীয় অবস্থায় তিলে তিলে এগিয়ে চলেছে মৃত্যুর মুখে। মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত যদিও, তবু উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ও সরকারের অবস্থান আমাদেরকে শঙ্কার মুখে ফেলে দিয়েছে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনশনরত শিক্ষার্থীদের জীবনের চাইতে বেশি মূল্য উপাচার্যের; সভ্য সমাজে অপ্রত্যাশিত ঘটনা হলেও বাস্তবতা অদ্য এটাই।
ছোট্ট একটা দাবি থেকে এমন প্রাণসংহারী পরিস্থিতি তৈরি হবে কে জানত! দায় নিশ্চিতভাবেই উপাচার্যের। প্রশাসক হিসেবে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি নজিরবিহীন পুলিশি হামলার ঘটনা ঘটিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের জীবন-ভবিষ্যতকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছেন। এ নিয়ে তার বিকার নেই। তার মত নির্বিকার শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। সরকারের দায়িত্বশীল অবস্থানে থেকেও তার যে ভূমিকা এটা প্রত্যাশিত নয়। তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার একটা অংশ মঞ্চস্থ করে চুপ হয়ে আছেন। শিক্ষার্থীরা তার কাছে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি জানিয়েছে। তিনি তাদের দাবির প্রতি সম্মান দেখাননি, মন্তব্য করেননি পদত্যাগ কিংবা অপসারণ বিষয়ে। তবে তিনি উপাচার্যের পক্ষ নিয়ে শিক্ষার্থীদের অনশন ভঙ্গের অনুরোধ করেছেন। অনশনে থাকা শিক্ষার্থীদের জীবনের মূল্য তাকে সামান্য স্পর্শ করতে পারেনি। মানুষ হিসেবে মানবিক আচরণ করেননি তাদের প্রতি। ‘ইগো’ কি বর্তমান এখানে—প্রশ্ন জাগছে? তিনি কি ভেবেছিলেন ঢাকার বাইরের প্রান্তিক এক বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীর আন্দোলনে কেন তিনি উতলা হবেন, কেন মানবেন তাদের দাবি? কেন দেখতে যাবেন তাদের, যদিও বলেছেন পারিবারিক সমস্যার কথা!
গত শনিবারের গভীর রাতের ভিডিয়ো কনফারেন্সের পর রোববার ফের আলোচনার কথা ছিল। হয়নি। সোমবার এবং মঙ্গলবারও শিক্ষার্থীরা অপেক্ষা করেছিল। মন্ত্রীর পক্ষ থেকে সাড়া আসেনি। কেন আসেনি? এই সময়ে বিভিন্ন টেলিভিশনে, সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এবং শিক্ষা উপমন্ত্রী আন্দোলনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেছেন। ‘তৃতীয়পক্ষের ইন্ধন’ দেখেছেন। এটা যেকোনো আন্দোলনের বিরুদ্ধে শাসকদের চিরায়ত মুখস্থ বুলি। অথচ টানা আন্দোলনের তেরোদিন এবং আমরণ অনশনের টানা ছয়দিনেও আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে সরকারবিরোধী কোন স্লোগান আসেনি। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সচেতনভাবে তাদের দাবির কথা জানিয়েছে। এই আন্দোলন যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সেজন্যে তারা প্রকাশ্যে সকল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফেসবুক লাইভেও সে সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়াকে প্রচার করেছে।
উপাচার্য আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের শত্রু ভাবছেন। দীর্ঘ অনশনের এই সময়ে উপাচার্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে চাননি। অথচ অনশন চলছে তার বাসভবনের ঠিক সামনেই। আন্দোলনরতরা অহিংস, তার ওপর শারীরিক আক্রমণের কোন শঙ্কা নেই জেনেও তিনি নির্বিকার। সরকারের ওপর ভরসা করে অনশনরত শিক্ষার্থীদের প্রাণ সংশয়ের শঙ্কা সত্ত্বেও তিনি কথা বলার ইচ্ছাপোষণ করেননি। এই বুঝি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ‘অভিভাবকত্ব’!
অথচ সময়ে-সময়ে আমরা বলতে শুনি শিক্ষার্থীরা ‘সন্তানসম’ আমাদের। এটা মুখস্থ বুলি। শিক্ষার্থী মানেই কি সন্তানতুল্য কেউ? বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের আপনি যখন সন্তান আওড়ে তাদের দাবিদাওয়াকে পাশ কাটিয়ে উপদেশ দিতে বসেন তখন নিশ্চিত আপনার-আপনাদের বদমতলব আছে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যারা লেখাপড়া করে তাদের শারীরিক-মানসিক অবস্থা প্রাথমিক অথবা মাধ্যমিক পর্যায়ের নয়। তাদের প্রতি আপনাদের মনোভঙ্গিও ওই পর্যায়ে থাকা উচিত। প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের যা যেভাবে বলা যায়, মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্যে ওটা আরেকটু আলাদা, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্যে তারচেয়েও আলাদা। আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সম্বোধনে-পরামর্শে যদি উল্লিখিত স্তরের অনুশীলন হয় তবে নিশ্চিত আপনি-আপনারা সবকিছু গুলিয়ে ফেলছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক কিংবা মন্ত্রী অথবা অন্য কেউ যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ‘সন্তানতুল্য’ দাবি করে নিজেদের ‘মাতৃত্ব’, ‘পিতৃত্ব’ ও ‘অভিভাবকত্বের’ পরিচয়কে সামনে আনে তখন অবাক হয়ে যাই। আরও বেশি অবাক হই যখন ‘মন্ত্রিত্বকে’ ছাপিয়ে কেউ যখন ‘মাতৃত্ব’ আর ‘পিতৃত্বের’ নাম জপ করে। যদিও জানি ওটা সম্পর্কের সংবেদনশীল রূপের প্রকাশের স্বার্থে, তবু শেষ পর্যন্ত এটা যে স্রেফ কৌশলী অবস্থান তা বুঝতে বাকি থাকে না।
বিশ্বাস করি ও বিশ্বাসে অটল থাকতে চাই যে, মন্ত্রিসভার দায়িত্বশীলেরা মন্ত্রিত্বের দায়িত্বে। শাবিপ্রবি পরিস্থিতি বলে দিচ্ছে মন্ত্রিত্বের বাইরে তারা মাতৃত্ব, পিতৃত্ব ও অভিভাবকত্ব নিয়েও প্রচারে। আয়নার অস্তিত্বের কথা কি বেমালুম ভুলে যাওয়া হচ্ছে আমাদের?
সমস্যা সমাধানে মাতৃত্ব, পিতৃত্ব, অভিভাবকত্ব শীর্ষক সংবেদনশীলতা উল্লেখ জরুরি নয়। জরুরি হচ্ছে শিক্ষার্থীদের জীবন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ। এখানে ইগো সঙ্কটকে মুখ্য হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার দরকার নাই। যে উপাচার্য ছোট্ট একটা ছাত্রীহলের সামান্য দাবিকে ম্যানেজ করতে না পেরে জাতীয় ইস্যু বানিয়ে ফেলেন তার প্রতি সরকারের সমর্থন অব্যাহত রাখার যুক্তি দেখি না। এই সমর্থন অব্যাহত রাখা মানে সরকারকে বিতর্কিত করা।
যত সময় যাচ্ছে অনশনরত শিক্ষার্থীদের জীবন সংশয়ের মুখে ততবেশি পড়েছে। একই সঙ্গে সরকার ক্রমেই বিতর্কিত হচ্ছে। উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের ব্যর্থতা, অযোগ্যতার দায় এখন সরকারের ঘাড়েই চলে যাচ্ছে।
সময় থাকতে সময়ের মূল্য দিন। শিক্ষার্থীদের বাঁচান; শাবিপ্রবিকে বাঁচান।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় যখন এই নিবন্ধ চূড়ান্ত করলাম তখন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে তাদের আমরণ অনশনরত সহযোদ্ধাদের অনুরোধ জানানো হয়েছে অনশন ভঙ্গের। তারা শপথবাক্য পাঠ করেছে চূড়ান্ত বিজয় অর্থাৎ উপাচার্যের পদত্যাগ অথবা অপসারণের আগ পর্যন্ত ঘরে ফিরবে না। অনশনরতরা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারলেও তারা সময় নিয়েছে। আমাদের আশাবাদ অনশনরতরা অনশন ভঙ্গ করবে, এবং যৌক্তিক দাবি আদায় করতে পারবে।
কবির য়াহমদ: কলাম লেখক ও সাংবাদিক।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
- ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১: জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ’
- সুনীল অর্থনীতি ও রূপকল্প-২০৪১
- শিক্ষার ধরন ও বেকারত্ব: দেশে অশিক্ষিতদের চেয়ে শিক্ষিত বেকার ৩ গুন
- ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়
- ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস-১৯৬১ ও দ্বিপক্ষিয় কূটনীতিক সম্পর্ক
- মিডিয়ার শক্তি বা আসক্তি: ম্যাজিক বুলেটের বাকের ভাই ও বদি
- গণমাধ্যমে গণরুচির বিকার
- হালকা বিনোদনের প্রাধান্যে সংস্কৃতির অবনতি
- বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণার দিন শেষ, চার উপায়ে মধ্য আয়ের দেশ