‘চাষাভুষা’, চাষাভুষার সন্তান
‘চাষাভুষা’, চাষাভুষার সন্তান
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘চাষাভুষার সন্তান, আমরা সবাই সাস্টিয়ান’ শীর্ষক এক স্লোগান ওঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির একজন শিক্ষক কর্তৃক ‘আমরা কোনো চাষাভুষা নই যে আমাদের যা খুশি তাই বলবে’—এমন এক মন্তব্যের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে এই প্রতিবাদী স্লোগান। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. লায়লা আশরাফুন গতকাল সকালে শ্রেণিবৈষম্যের যে মন্তব্য করেছেন তার জবাব শিক্ষার্থীদের। শিক্ষক শেকড়কে অস্বীকার করলেও শিক্ষার্থীরা শেকড়ের টান উপেক্ষা করতে পারছে না। তাই তাদের সরব প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদে আমরাও শামিল। যদিও সাস্টিয়ান নই, তবু আমরাও এই মাটির সন্তান; চাষাভুষারা আমাদের পূর্বপুরুষ, যাদের উত্তরাধিকার আমরা বয়ে চলেছি সযত্নে।
আমি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী নই। আমার শিক্ষাজীবনের সমাপন অন্য কোথাও। ড. লায়লা আশরাফুনের মত পিএইডি ডিগ্রিধারী না হলেও আমারও পাঠ সমাজবিজ্ঞানে। পাঠের যে বিশালতা তার বেশিরভাগই আমার বা আমাদের মত অনেকের আয়ত্বে না থাকলেও অন্তত সমাজ-পাঠের সাধারণ জ্ঞানটুকু অর্জন ও প্রতিপালনের চেষ্টা করি, যেখানে শ্রেণিবিভাজনের স্থান নেই; বরং অবারিত এখানে সাম্যের পাঠ। অধ্যয়নলব্ধ জ্ঞানের বিষয়ই কেবল নয় এটা, মানসিকতা ও প্রকাশের যা একান্তই ব্যক্তিক চিন্তার প্রতিফলন। তাই বিষয়কে কাঠগড়ায় দাঁড় না করিয়ে শুধু বলা যায় এ যে প্রকাশের অজ্ঞতা, পাঠান্তে লব্ধ জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। লায়লা আশরাফুন এখানে পিএইডিধারী যদিও, তবু এ সীমাবদ্ধতা কিংবা সংকীর্ণতা অতিক্রম করতে পারেননি।
ড. লায়লা আশরাফুন শিক্ষক। তার দাবি তারা ‘বুদ্ধিজীবী শ্রেণি ধারণ করেন’, তারা ‘চাষাভুষা নন যে তাদেরকে যা খুশি তাই বলা যাবে’। তার শিক্ষা, তার অবস্থান তাকে হয়ত তার দাবির বুদ্ধিজীবী শ্রেণিতে স্থান দেয়, কিন্তু কেমন বুদ্ধিজীবী তিনি যিনি শেকড়কে অস্বীকার করেন। চাষাভুষা শব্দ উল্লেখে প্রান্তিক মানুষদের অবজ্ঞা করেন প্রকাশ্যে। কেউ কি অপমান করেছে তাকে? তাকে বা তাদেরকে উদ্দেশ করে কেউ কি ‘কুরুচিপূর্ণ’ মন্তব্য করেছে? তিনি সম্মানের জন্যে শিক্ষকতা পেশায় এসেছেন, সম্মানের জন্যে কাজ করেন বলে জানাচ্ছেন। সম্মাননীয় পেশা যে শিক্ষকতা যা তার মুখ থেকে বেরিয়েছে তা সর্বাংশে সত্য, সম্মানের জন্যে মানুষ শিক্ষকতা পেশায় আসে, এটাও সত্য। তবে তিনি কি সেই সম্মাননীয় পেশার সম্মানকে ধরে রাখতে পেরেছেন? পারেননি। না পারার কারণ ওই উদ্ধত, অশালীন, অসংলগ্ন এবং শেকড়কে তাচ্ছিল্য করা মন্তব্য। এমন মন্তব্য একজন শিক্ষকের কাছ থেকে আসলে আদতে শিক্ষকের মহান পেশাকে কলঙ্কিত করা হয়। ড. লায়লা আশরাফুন সেটাই করেছেন।
দেশবাসী ইতোমধ্যেই জেনে গেছে, শাবিপ্রবির এই শিক্ষার্থী-আন্দোলন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের নয়। এটা একান্তই বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ বিষয়। শুরুতে একটি হলের প্রভোস্টের অসদাচরণের প্রতিবাদে নির্দিষ্ট ওই হলের ছাত্রীদের বিক্ষোভ। কিন্তু ব্যর্থ প্রশাসন এটাকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছে যা এখন জাতীয় ইস্যু হয়ে ওঠার অপেক্ষায়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী ছাত্রী হলের প্রভোস্ট সহযোগী অধ্যাপক জাফরিন আহমেদ লিজার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে সত্য কিন্তু তার আগে নিপীড়নমূলক এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যেখানে বিনা উসকানিতে পুলিশ হামলা করেছে শিক্ষার্থীদের ওপর। এতে পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পুলিশ এসে হামলা করবে তা শিক্ষার্থীরা মেনে নেবে—এমন করুণ অবস্থা এখনও হয়নি ছাত্রসমাজের। ফলে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের জাগরণ ওঠেছে ক্যাম্পাসে। পূর্বের সব দাবি তাই এখন এক দাবিতে পরিণত হয়েছে, এবং তা উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগ। এরআগে পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে অনেক শিক্ষার্থীকে হাসপাতালে যেতে হয়েছে, আইসিইউতেও। এই যে নির্যাতন, এই নির্যাতনে কি দমে যাবে শিক্ষার্থী-আন্দোলন? মনে হয় না। বরং তা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে দেশের অপরাপর ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়লেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
সপ্তাহ ধরে চলমান এই আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা আগ্রাসী হয়নি। পুলিশ গুলি চালিয়েছে, লাঠিপেটা করেছে, মামলা দিয়েছে। শুরুর মার খাওয়ার পর প্রতিরোধ করেছে শিক্ষার্থীরা। এরপর আন্দোলনের একটা পর্যায়ে এই শিক্ষার্থীরা আবার শান্তির বার্তা ছড়াতে পুলিশের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে গিয়ে বলেছে—‘পুলিশ তুমি ফুল নাও, আমার ক্যাম্পাস ছেড়ে দাও’! ক্যাম্পাসে পুলিশের আগ্রাসী ভূমিকা, অবস্থানে তারা সংক্ষুব্ধ, তবে আগ্রাসী হয়ে পুলিশকে ধাওয়া দিয়ে স্থায়ীভাবে ক্যাম্পাস-ছাড়া করতে যায়নি। এখানে তাদের প্রাপ্তমনস্কতার প্রশংসা করতে হয়। ফুল হাতে তাদের এই আহ্বানকে আন্দোলনের শিল্পিত প্রকাশ রূপেও বর্ণনা করা যায়। দেশের অন্যতম সেরা একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা মন-মনন-চিন্তা ও প্রকাশে যে উচ্চতর এরচেয়ে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে!
শিক্ষার্থীরা যেখানে উচ্চতর চিন্তায় সেখানে কিছু শিক্ষক কি সেটা ধারণ করতে পারছেন? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে কেউ কেউ পারছেন না। ড. লায়লা আশরাফুন তার বড় প্রমাণ। শিক্ষার্থীদের ‘কুরুচিপূর্ণ’ মন্তব্যের অভিযোগের বিরুদ্ধে মানববন্ধনের নামে বিতর্কিত ভিসির পক্ষ নিয়ে তিনি যে দাম্ভিক মন্তব্য করেছেন তা সুরুচির পরিচয় বহন করে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তুঙ্গু পরিস্থিতিতে তার মত একজন শিক্ষক যেখানে স্থির-চিন্তার প্রকাশ ঘটাতে পারতেন সেখানে তিনি আগুনে ঘি ঢেলেছেন। বিক্ষুব্ধ করছে শিক্ষার্থীদের, একই সঙ্গে আমরা যারা সরাসরি আন্দোলনে নেই সেই আমাদেরকেও সংক্ষুব্ধ করছেন। এটা শিক্ষক অবস্থানে থাকা কারও যথাযথ মন্তব্য হতে পারে না। কৃষক-মজুর সমাজের ঐতিহ্যিক উত্তরাধিকার হিসেবে আমরা এর প্রতিবাদ করি।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। শিক্ষার্থীদের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে আমরা একাত্ম। শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে এখন পর্যন্ত অনড়। তারা কেবলই উপাচার্যের সংশ্লিষ্ট অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলছে। উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের ভাইরাল হওয়া এক কথোপকথন নিয়ে এখন পর্যন্ত তাদের মাথাব্যথা নেই, যদিও ওটা আরেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষত নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে চরম অপমানজনক মন্তব্য। আন্দোলনকে নানাভাবে ভাগ না করে কেবল একটা নির্দিষ্ট দাবিতে মনোনিবেশে তাদের এই দৃঢ়তা আশাব্যঞ্জক। এইধরনের মন্তব্যের বিরুদ্ধে উপর্যুক্ত কর্তৃপক্ষ তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেবেন আশা করি। অথবা সংক্ষুব্ধ কেউ এই অপমানের আইনি প্রতিবিধানের পথে গেলে যাক। তবে আমরা চাই নারী নিয়ে এইধরনের অপমানের বিচার হওয়া উচিত।
শিক্ষক-শিক্ষার্থী পরস্পরবিরোধী সত্ত্বা নয়। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তাদের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ হওয়া আবশ্যক। সর্বোচ্চ পর্যায়ে শিক্ষা নিতে আসা শিক্ষার্থী আর সর্বোচ্চ পর্যায়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া শিক্ষকের মধ্যকার সম্পর্ক শিক্ষাস্তরের প্রাথমিক আর মাধ্যমিক পর্যায়ের মত হওয়ার কথা নয়। এই সম্পর্ক পরস্পরের মধ্যকার সম্মানের হতে হবে। তা না হলে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের শঙ্কা থাকবেই। এই পর্যায়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী তাদের নিজেদের অবস্থান ভুলে গেলে সেটা হবে হতাশার। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকশ’ শিক্ষক যে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন এমন না, কয়েক হাজার শিক্ষার্থী যে শিক্ষকদের অপমান (যদিও অপমানের কোন প্রমাণ কেউ দেখায়নি) করছেন এমনও না। তবে যারাই অদ্যকার এই উত্তুঙ্গু পরিস্থিতিতে আগুনে ঘি ঢালবে তারা মোটেও শিক্ষাবান্ধব কেউ নয়। তাদের উচিত হবে সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়া।
শাবিপ্রবিতে এই যখন পরিস্থিতি তখন নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিষ্ঠান রীতিমত ‘গণঘুমে’। এই ঘুম ভাঙবে কবে তাদের? এত জল ঘোলা করে যদি সবশেষে নামা হয় তবে যা কিছু বাকি তা জল নয়, উচ্ছিষ্টই! দাবি করি ‘গণঘুম’ থেকে জাগুক তারা। আচার্য, সরকার কিংবা যারাই নিয়ন্ত্রক তারা শিক্ষা ও শিক্ষার্থীবান্ধব হয়ে বাঁচিয়ে দিক দেশের অন্যতম সেরা এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে।
‘বাঁচাও শাবি, সরাও ভিসি’—শিক্ষার্থীদের এমনই দাবি। শিক্ষার্থীদের এই দাবিতে যুক্তি আছে। যুক্তি থাকায় গণভিত্তিও আছে!
কবির য়াহমদ: সাংবাদিক ও লেখক।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
- ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১: জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ’
- সুনীল অর্থনীতি ও রূপকল্প-২০৪১
- শিক্ষার ধরন ও বেকারত্ব: দেশে অশিক্ষিতদের চেয়ে শিক্ষিত বেকার ৩ গুন
- ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়
- ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস-১৯৬১ ও দ্বিপক্ষিয় কূটনীতিক সম্পর্ক
- মিডিয়ার শক্তি বা আসক্তি: ম্যাজিক বুলেটের বাকের ভাই ও বদি
- গণমাধ্যমে গণরুচির বিকার
- হালকা বিনোদনের প্রাধান্যে সংস্কৃতির অবনতি
- বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণার দিন শেষ, চার উপায়ে মধ্য আয়ের দেশ