জার্মান ফেডারেল নির্বাচন
অভাবিত ফলাফল, জোট গঠনের জটিলতা
জার্মান ফেডারেল নির্বাচন
অভাবিত ফলাফল, জোট গঠনের জটিলতা
সেপ্টেম্বরের শেষভাগে বার্লিনে সূর্যের দেখা পাওয়াটাই মুশকিল। অথচ কি আশ্চর্য! ২৬ সেপ্টেম্বরের রোববারটিতে ছিলো বার্লিন ছিলো দারুণ রৌদ্রজ্জ্বল। বিষয়টিকে প্রকৃতির প্রতীকি আচরণ হিসেবেই দেখছেন অনেকে। প্রকৃতিও হয়তো চাইছে বার্লিনের কেন্দ্র ক্ষমতায় পরিবর্তন। রোববারের বুন্ডেসটাগ নির্বাচনে অনেকটা সেই রায়ই দিয়েছেন জার্মান ভোটাররা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী জার্মানিতে সবচেয়ে শোচনীয় ফলাফল পেয়েছে বর্তমান ক্ষমতাসীন ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন- সিডিইউ এবং তাদের সহযোগী ক্রিশ্চিয়ান সোশ্যালিস্ট ইউনিয়ন- সিএসইউ জোট বা এক নামে বললে ইউনিয়ন জোট। আঙ্গেলা মের্কেলের ইতিহাস সৃষ্টিকারী ১৬ বছরের শাসন শেষে আরমিন লাশেটের নেতৃত্বাধীন সিডিইউ/সিএসইউ যে এমন ধাক্কা খাবে তা হয়তো আন্দাজ করতে পারেননি ইউনিয়নের নীতি-নির্ধারকরাও। যদিও ভোটের হিসেবে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি- এসপিডি'র চেয়ে সামান্যই পিছিয়ে সিডিইউ/সিএসইউ।
২০তম জার্মান ফেডারেল নির্বাচনে ওলাফ শোলৎস-এর এসপিডি পেয়েছে ২৫.৭% ভোট। যা ২০১৭ সালের তুলনায় ৫.২% বেশি। অন্যদিকে, ৮.৮% কমে গিয়ে এবার লাশেটের সিডিইউ/সিএসইউ পেয়েছে ২৪.১% ভোট। গেলোবারের নির্বাচনের ফলাফলের সঙ্গে তুলনা করলে এবার সবথেকে বেশি ভোট বেড়েছে গ্রিন পার্টির- প্রায় ছয় শতাংশ। দলটি এবার পেয়েছে ১৪.৮ শতাংশ ভোট। সাড়ে ১১ শতাংশ ভোট পেয়ে চতুর্থ অবস্থানে ফ্রি ডেমোক্র্যাটিক পার্টি- এফডিপি। ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো বুন্ডেসটাগে আসন পেয়ে চমকের পাশাপাশি বিভেদ এবং শঙ্কার রাজনীতি ছড়িয়ে দিয়েছিলো অলটারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড- এএফডি। এবার তাদের ভোট কমেছে ২.৩%। পেয়েছে ১০.৩% ভোট। প্রায় সাড়ে চার শতাংশ ভোট কমে গিয়ে সমাজবাদী বামপন্থীরা পেয়েছে ৪.৯% ভোট।
ভোটের ব্যবধানে সিডিইউ/সিএসইউ থেকে মাত্র এক দশমিক ছয় শতাংশ এগিয়ে এসপিডি। অতি সামান্য এই পার্থক্যের কারণে দুই পক্ষই দাবি করছে, পরবর্তী সরকার গঠনে জনগণ তাদের সুস্পষ্ট রায় দিয়েছে। কিন্তু দুই পক্ষই কেন এমন দাবি করছে?
ভোটপ্রাপ্তির হিসেবে এগিয়ে থাকলেই যে কোনো দল সরকার গঠন করতে পারবে- জার্মান সংবিধানে এমন সুস্পষ্ট কোনো বিধান নেই। এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে যে কোনো দলই অন্য কোনো দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে সরকার গঠন করতে পারবে। অর্থাৎ এবারের নির্বাচনে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সিডিইউ/সিএসইউ যদি গ্রিন পার্টি এবং এফডিপি'র সঙ্গে জোট গঠন করতে পারে, তাহলে সরকার তারাই গঠন করবে। সেক্ষেত্রে ভোটে এগিয়ে থেকেও বিরোধী দলে যেতে হবে এসপিডিকে।
তাই এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না, আঙ্গেলা মের্কেলের স্থলাভিষিক্ত কে হতে যাচ্ছেন। অন্নত চার ধরনের জোট গঠনের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে এবারের নির্বাচনের ফলাফলে। জোটের সেই জট খুললেই পরিষ্কার হবে কে হবেন জার্মানির পরবর্তী চ্যান্সেলর। ওলাফ শোলৎস নাকি আরমিন লাশেট?
এবারের নির্বাচনী ফলাফল যে পরিস্থিতি তৈরি করেছে, জার্মানদের জন্য তা নতুন অভিজ্ঞতা। জার্মানিতে সত্তর এবং আশির দশকেও কিন্তু তিনদলীয় জোট সরকার দেখা গেছে। তবে সেখানে তবে সেসব ক্ষেত্রে প্রথম এবং দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা দলগুলির মধ্যে সুস্পষ্ট ব্যবধান ছিলো। ফলে ফলে অন্য ছোটো দলগুলোর সঙ্গে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই কিন্তু দর কষাকষি করে সরকার গঠন করা সম্ভব হয়েছিলো। কিন্তু এবারের বুন্ডেসটাগে আসন পাওয়া সাতটি দলের ভোটপ্রাপ্তির যে হার, তা অনেকটাই বিভ্রান্তিকর এবং জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। পরবর্তী জোট সরকার গঠন এবং চ্যান্সেলর নিয়োগে তাই কয়েক সপ্তাহ নয়, বরং লেগে যেতে পারে কয়েক মাস।
অনেক দেশেই দুই বা ততোধিক দলের মধ্যে জোট সরকার ব্যবস্থা দেখা যায়। তবে সেসব দেশে সংবিধানের মধ্যেই সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকে, কিভাবে গঠন করা হবে ওই জোট সরকার। কিছু ক্ষেত্রে কোন দল সরকার গঠন করবে সেই সিদ্ধান্ত দেন সংশ্লিষ্ট দেশটির রাষ্ট্রপ্রধান। সাংবিধানিকভাবেই তিনি এই ক্ষমতা পেয়ে থাকেন। তবে জার্মান আইনে ঠিক বিষয়টিতে অস্পষ্টতা রয়েছে। ২০১৭ সালে সরকার গঠনে যখন জটিলতা এবং দীর্ঘসূত্রীতা দেখা দেয়া, আলোচনা যখন স্থগিত হয়ে যায়, তখন তাতে হস্তক্ষেপ করেন জার্মান প্রেসিডেন্ট ফ্যাঙ্ক ভাল্টার স্টাইনমায়ার। এসপিটিকে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো মহাজোটে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান। তবে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, কোন দলকে সরকার গঠনের আহ্বান জানানোর আনুষ্ঠানিক কোনো ক্ষমতা জার্মান প্রেসিডেন্টের নেই। অবশ্য নতুন নির্বাচন আহ্বান করা কিংবা তার কার্যালয়ের মাধ্যমে অন্য যে কাউকে চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ দেয়ার ক্ষমতা তার আছে।
এবার তাই অনন্য এক জটিল পরিস্থিতির মুখে পড়তে যাচ্ছে জার্মানি। এগিয়ে থাকা এসপিডি আর দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সিডিইউ/সিএসই- দুই শিবিরই যে সরকার গঠনে জোরালোভাবে সক্রিয় হবে তাতে সন্দেহ নেই। নতুন জোট সরকারে যে গ্রিন পার্টি এবং এফডিপি থাকছে, তাও মোটামুটি নিশ্চিত। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, নেতৃত্বে থাকবে কোন দল? চ্যান্সেলর হবেন কে? এসপিডি নাকি সিডিইউ/সিএসইউ? ওলাফ শোলৎস নাকি আরমিন লাশেট? ছোট দলগুলোকে পাশে পেতে কতটা ছাড় দিতে হবে বড় দলগুলোকে? জোট গঠনের আলোচনা যদি অনেকবেশি দীর্ঘ হয় সেক্ষেত্রে কি হবে? কতদিন অপেক্ষা করতে হবে? এসবের সুনির্দিষ্ট কোনো জবাব এখন পর্যন্ত কারো কাছে নেই।
বিপ্লব শাহরিয়ার: জার্মানপ্রবাসী সাংবাদিক।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
- ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১: জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ’
- সুনীল অর্থনীতি ও রূপকল্প-২০৪১
- শিক্ষার ধরন ও বেকারত্ব: দেশে অশিক্ষিতদের চেয়ে শিক্ষিত বেকার ৩ গুন
- ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়
- ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস-১৯৬১ ও দ্বিপক্ষিয় কূটনীতিক সম্পর্ক
- মিডিয়ার শক্তি বা আসক্তি: ম্যাজিক বুলেটের বাকের ভাই ও বদি
- গণমাধ্যমে গণরুচির বিকার
- হালকা বিনোদনের প্রাধান্যে সংস্কৃতির অবনতি
- বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণার দিন শেষ, চার উপায়ে মধ্য আয়ের দেশ