ভালোবাসার শিক্ষাঙ্গনে...
ভালোবাসার শিক্ষাঙ্গনে...
প্রায় ৫৪৪ দিন পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আবার শিক্ষার্থীদের কলকাকলিতে মুখর হয়ে উঠল। গত বছরের ৮ মার্চ আমাদের দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হলো। তার আগেই চীনসহ বেশ কয়েকটি দেশে নতুন ধরণের এই মরণঘাতী ভাইরাস কোভিড-১৯ দেখা দিয়েছিল। এই ভাইরাস আমাদের স্বাভাবিক জীবনকে তো বটেই, দেশের শিক্ষা কার্যক্রম, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এমনকি মানুষের প্রাত্যহিক জীবনকেও স্তব্ধ করে দিয়েছিল। লকডাউন দিয়ে সরকার এই বিপর্যয়ের মোকাবেলা করতে চেয়েছে। লকডাউনে দোকানপাট, অফিস-আদালত সব বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। আমাদের উৎসব, উদযাপনগুলোও হয় স্থগিত করতে হয়েছে, নাহলে সীমিত পরিসরে পালন করতে হয়েছে।
২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ করে দেয়া হলো দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সবচেয়ে বেশি সময় ধরে বন্ধ ছিল এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। বিভিন্ন বয়সের শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা বিবেচনা করেই এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। অভিভাবকরাও সন্তানদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে রাজি হবেন না, এটাই স্বাভাবিক। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজগুলোও বন্ধ ছিল। কারণ এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদেরও টিকার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি বহুদিন পর্যন্ত। এখনও এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা সম্ভব হয়নি। শীঘ্রই খোলা হবে বলে আমরা শুনতে পাচ্ছি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর এক বক্তব্যে বলেছিলেন, ১২ সেপ্টেম্বর থেকে স্কুল-কলেজ খুলবে। তাঁর এই নির্দেশ বাস্তবায়নে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নানা পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বহু ধরনের নির্দেশনা আমাদের জানানো হলো। পত্রিকার সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় কিংবা টকশোতে এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল স্কুল-কলেজ খোলার বিষয়ে। নানা জল্পনা-কল্পনা আর কী-না-কী হয়, এই আতঙ্কের মধ্যেই খুলতে চলেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। গত ১২ সেপ্টেম্বর খুলেছে স্কুল ও কলেজ।
এ যেন এক উৎসব। স্কুল খোলা হবে এই নির্দেশ পাওয়া মাত্রই প্রাণচাঞ্চল্য দেখা দেয় শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, কর্মচারী তথা শিক্ষার সঙ্গে জড়িত সকলের মধ্যে। কেউ স্কুল ভবন বা শ্রেণিকক্ষ পরিষ্কার করতে ব্যস্ত, কেউ শিক্ষার্থীদের চলার পথে নির্দিষ্ট দূরত্বের চিহ্ন আঁকছেন, কেউ দুই ঘন্টা সময়ে কীভাবে কোন বিষয় ক্লাশ নেয়া যায় সেই রুটিন তৈরিতে ব্যস্ত, কেউবা অনেকদিন পরে শিক্ষার্থীদের বরণ করার নানা বর্ণিল আয়োজনে। প্রধান শিক্ষকগণ হ্যান্ড স্যানিটাইজার, তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র, মাস্ক যোগাড়ে ব্যস্ত। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে, প্রবেশ ফটকে এবং নোটিশ বোর্ডে দেয়া হয়েছে নানা নির্দেশনা। সেজে উঠছে শিক্ষাঙ্গন, প্রাঙ্গণ সাজছে ফেস্টুনে, রঙিন কাগজে, কাপড়ে, লোক-সংস্কৃতির নানা মোটিফে । শ্রেণিকক্ষগুলো বেলুন, কাগজের বল, পাখা, শিকল মালায় বর্ণিল হয়ে উঠেছে। আমরা যারা শিক্ষক, তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছি, কখন সকাল হবে! কখন আসবে আমাদের প্রাণের শিক্ষার্থীরা।
রাস্তায় বহুদিন পরে ইউনিফর্ম পরা রঙিন দেবশিশুদের দেখা গেলো। তাদের হাসি হাসি চকচকে চোখ দুটো মাস্কের আড়ালের ঠোঁটের হাসিকে ঠিকই প্রকাশ করছে। স্কুল গেইটে শিক্ষকরা দাঁড়িয়ে বরণ করছেন শিক্ষার্থীদের। হাত দেয়া হচ্ছে স্যানিটাইজার, একটু দূরে মাপা হচ্ছে তাপমাত্রা, শিক্ষার্থীরা পথচিহ্ন ধরে শ্রেণিকক্ষে গিয়ে দেখে বেঞ্চে বসার জায়গাও চিহ্নিত করা আছে। যিকজ্যাক করে এক বেঞ্চে একজন করে বসার ব্যবস্থা। বন্ধুরা সব এক কক্ষে বসব না। মোট শিক্ষার্থীকে দুই কক্ষে ভাগ করে বসানোর ব্যবস্থা হয়েছে। এতে মনটা একটু খারাপ হলেও স্কুলে যে এসেছে এ আনন্দ তো কম নয়।
অভিভাবকরা সন্তানদের স্কুলে আনা নেয়ার সময় যদি অস্থির না হয়ে শারীরিক দূরত্বটা খেয়াল রাখেন এবং নিজের সন্তানের পাশাপাশি অন্যের সন্তানদেরও একটু খেয়াল রাখেন, তবেই পরিস্থিতিটা নিয়ন্ত্রণে আনা সহজ হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষকরা যদি ধৈর্য্য ধরে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে প্রতিদিন সরকার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখেন, তবে শিক্ষার চাকা চলমান রাখা সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি। কোভিডের মত শত্রুর মোকাবেলা আমরা করতে পারবোই।
শিক্ষার্থীরা শারীরিক দূরত্ব, সারাক্ষণ মাস্ক পরে থাকার নির্দেশনা খুব নিষ্ঠার সাথে মেনে চলছে। অন্তত আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতা তাই। তারা জানে কোনভাবেই সংক্রমিত হওয়া চলবে না। এতে যেমন কষ্ট তেমনি স্কুলে আসা বন্ধ হয়ে যাবে। কোনভাবেই তারা স্কুলে আসা বন্ধ করতে চায় না। বন্ধুদের সাথে মন ভরে খেলতে না পারলেও দেখা হওয়া, গল্প করার আনন্দই বা কম কী? বন্দী জীবনের বিষন্নতা কাটিয়ে মন খারাপের প্রহর কাটিয়ে আনন্দে হেসে উঠেছে ফুলের মতো ছোট্ট ছোট্ট মুখগুলো।
তবে এর মধ্যেই কেউ কেউ স্বজন হারিয়েছে। কারো বা বাবা-মা চাকরি হারিয়ে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শিকার হয়েছেন। কোন কোন শিক্ষার্থী অর্থনৈতিক কারণে শহরের বাস তুলে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে পরিবারের সাথে। হয়তো কোনো বন্ধুকে ক্লাসে খুঁজে না পেয়ে আবারও মন খারাপ হয়ে যাবে কোনো শিক্ষার্থীর। তাদের মনে আক্রান্ত হবার শঙ্কাও ঢুকে গেছে। সেজন্য আনন্দের মাঝে কিছুটা ভয়ও যে নেই, সে কথা জোর দিয়ে বলঅ যাবে না। অল্প সময়ের জন্য মাত্র দুই পিরিয়ড ক্লাস করতে আসছে শিক্ষার্থীরা। যদিও মাঠে সে রকম ছুটোছুটি করতে পারছে না, তবুও বন্দীত্ব ঘুচেছে, এর আনন্দ তো কম নয়।
দেড় বছর পর স্কুলের ঘন্টাগুলো বেজে উঠলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং স্কুলের আশেপাশের বাড়িগুলোতেও আনন্দের আবহ তৈরি হয়। স্কুল খোলার জন্য পথে যানজটে বসে ইউনিফর্ম পরা স্কুল কলেজগামী শিক্ষার্থীদের দেখে কষ্ট ভুলে যান পথচারীও। এখন আমাদের করণীয় সর্বোচ্চ সতর্কতা ও স্বাস্থ্যবিধি পালন নিশ্চিত করে করোনা সংক্রমণ বাড়তে না দেয়া। যাতে আবার সরকারকে পরিস্থিতি মোকাবেলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে না হয়।
সঙ্গীতা ইমাম: শিক্ষক, লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
- ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১: জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ’
- সুনীল অর্থনীতি ও রূপকল্প-২০৪১
- শিক্ষার ধরন ও বেকারত্ব: দেশে অশিক্ষিতদের চেয়ে শিক্ষিত বেকার ৩ গুন
- ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়
- ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস-১৯৬১ ও দ্বিপক্ষিয় কূটনীতিক সম্পর্ক
- মিডিয়ার শক্তি বা আসক্তি: ম্যাজিক বুলেটের বাকের ভাই ও বদি
- গণমাধ্যমে গণরুচির বিকার
- হালকা বিনোদনের প্রাধান্যে সংস্কৃতির অবনতি
- বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণার দিন শেষ, চার উপায়ে মধ্য আয়ের দেশ