প্রসঙ্গ বরিশাল: অপ্রয়োজনীয় বিজ্ঞপ্তি, বিব্রতকর পরিস্থিতি
প্রসঙ্গ বরিশাল: অপ্রয়োজনীয় বিজ্ঞপ্তি, বিব্রতকর পরিস্থিতি
বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুনিবুর রহমান শোভনের সরকারি বাসভবনে হামলা, পুলিশ ও স্থানীয় মেয়র অনুসারী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যকার সংঘর্ষের ঘটনাটি স্থানীয় বিষয় হিসেবে থাকেনি। এটা সারাদেশের আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠেছে। কেবল আলোচনারই নয়, এটা নিয়ে জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা প্রায় মুখোমুখি অবস্থায় চলে গেছে। ঘটনার একদিনের মাথায় সিভিল সার্ভিস ক্যাডারদের সংগঠন জরুরি সভা করে এই ঘটনায় এক পক্ষকে দোষারোপ করে ‘আইনের মাধ্যমেই দুর্বৃত্তদের মোকাবেলা করা হবে’ এবং ‘আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে’ বলে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে।
আইন নিজস্ব গতিতে চলবে- এটা স্বতঃসিদ্ধ কথা, সর্বক্ষেত্রে এটাই হওয়া উচিত। আমলাদের সংগঠনের এমন অঙ্গীকার আশাবাদী করার কথা আমাদের। তবে এই আশাবাদের বেলুন চুপসে যায় যখন দেখা যায় সেই আইনের শাসনের পথ রচনায় যে বিচারিক ধারা সেখানে তারা নিজেরাই বাঁধ সেধেছে। কীভাবে? আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার স্বীকৃত মাধ্যম বিচারব্যবস্থা, সে বিচার যে পথ পরিক্রমায় সম্পাদিত হয় সেটা তদন্ত। সেই তদন্তের আগেই তারা একপাক্ষিকভাবে একটা পক্ষকে বিশেষত স্থানীয় মেয়রকে অপরাধী সাব্যস্ত করেছে। এখানে আইনের শাসনের পথে তারা কি অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল না?
এরবাইরে আরও আছে। সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তাদের সংগঠন ‘দুর্বৃত্তদের মোকাবেলা’ করা হবে বলে অঙ্গীকার করেছে। এখানে কে দুর্বৃত্ত, কীভাবে, কোন বিবেচনায়, কারা এবং কেন এমন মন্তব্য? সরকারি কর্মচারীদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন কি কাউকে এভাবে দুর্বৃত্ত বলে আখ্যা দিতে পারে, এবং তাও আবার বিচারের আগে, এমনকি তদন্তের আগে? এই অধিকার কি তারা রাখে? রাখে না। কারণ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে তারা রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট কিংবা গোষ্ঠীবদ্ধ নাগরিকের প্রতি এভাবে আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করতে পারে না। এটা শোভনীয় নয়।
বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের দায়িত্বশীলরা বরিশালের ঘটনায় সংক্ষুব্ধ হতেই পারেন। তারা জরুরি সভা করতেই পারেন, কিন্তু এই সভা করে তারা কোন রাজনৈতিক ব্যক্তি-গোষ্ঠী বা নির্দিষ্ট বলয়ের কাউকে অথবা স্বতন্ত্র হিসেবে কাউকে এভাবে দুর্বৃত্ত আখ্যা দিতে পারে না। একান্তই যদি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিতেই হয় তাদের তবে সেখানকার ভাষা হবে পরিশীলিত ও শোভন। তারা তদন্তের আগে, বিচারের আগে কাউকে অপরাধী হিসেবে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিতে পারেন না, কারণ এতে মামলার তদন্ত কার্যক্রম প্রভাবিত হওয়ার শঙ্কা থাকে।
যে ঘটনা নিয়ে এতকিছু সেখানে এরইমধ্যে একাধিক মামলা হয়েছে। ইউএনও মুনিবুর রহমান শোভন ও বরিশাল কোতোয়ালি থানার উপ-পরিদর্শক বাদী হয়ে পৃথক মামলাগুলো করেছেন। উভয় মামলার প্রধান আসামি বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। এদিকে, ঘটনার চারদিন পর রোববার বরিশালের প্যানেল মেয়র-২ রফিকুল ইসলাম খোকন ও সিটি করপোরেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা বাবুল হালদার জেলার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে ইউএনওর বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলার আবেদন করেছেন। আদালত মামলাগুলোর আবেদন আমলে নিয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। এই মামলাগুলো ও বিচার কোন পথে যাবে সেটা সময় বলবে। এদিকে, এরইমধ্যে বিষয়টি জনপ্রতিনিধি অথবা রাজনীতিবিদ এবং আমলাদের গোত্রীয় সমস্যা হিসেবে দাঁড়িয়েও গেছে। যার শুরুটা বুঝে কিংবা না বুঝে করে ফেলেছে আমলাদের শীর্ষ সংগঠন।
বরিশালের এই ঘটনাকে আমরা স্থানীয় একটা সমস্যা হিসেবে দেখতে আগ্রহী ছিলাম। এমন ঘটনা দেশের নানা জায়গায় ঘটে থাকে, এবং ওগুলো এতদিন স্থানীয় পর্যায়েই সীমাবদ্ধ ছিল। জাতীয় পর্যায়ের গণমাধ্যমগুলো দিনের পর দিন সেগুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকেনি, আমলাদের শীর্ষ সংগঠনও এনিয়ে জরুরি সভা এবং সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল কি না এনিয়েও এত আলোচনা হয়নি। কিন্তু এবার স্থানীয় পর্যায়ের এই সমস্যাকে জাতীয় পর্যায়ে বিশেষত রাজনীতিবিদ অথবা জনপ্রতিনিধি এবং প্রশাসনের দ্বন্দ্ব হিসেবে মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের কঠোর অবস্থানই। তারা আক্রোশ কিংবা অবিবেচনাপ্রসূত একটা সিদ্ধান্তে যা করেছে সেটা প্রশাসন ও সরকারদলকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। এর জন্যে তারা তদন্ত, বিচার এবং আইনের প্রতি আস্থা রাখতে পারত, কিন্তু সেটা করেনি। বলা যায়, আইন-আদালতকে অস্বীকার করেই তারা যে অবস্থান নিয়েছে তাতে করে সরকার পড়েছে বিব্রতকর অবস্থায়, একই সঙ্গে দেশও পড়তে যাচ্ছে সঙ্কটে।
মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর কর্মী সমর্থকদের দ্বারা ইউএনওর বাসভবনে হামলার অভিযোগ এবং পুলিশ-আনসার ও দলীয় নেতাকর্মীদের এই সংঘর্ষের ঘটনায় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ ও সরকার কোন পক্ষেই অবস্থান নেয়নি। বরং স্থানীয় এই ঘটনার আইনি প্রতিবিধানের পথেই আস্থা রেখেছিল। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তার সতর্ক প্রতিক্রিয়ায় ঘটনার পরেরদিনই জানিয়েছিলেন- বরিশালের পরিস্থিতি প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হয়েছে। সরকারের প্রভাবশালী এই মন্ত্রী ওইদিন বলেছিলেন, ‘‘আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। আমি পুলিশ কমিশনারের সঙ্গেও কথা বলেছি। পুলিশ জানিয়েছে তারা ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। দোষীদের ধরতে অভিযান চলছে। নেত্রীর নির্দেশে কাজ করছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না’’। এখানে আওয়ামী লীগের যে অবস্থান সেটার দ্বারা প্রশাসনের কারও ক্ষুব্ধ হওয়ার কথা ছিল না, দলীয় নেতাকে বাঁচানোর কোন অভিসন্ধিও ছিল না দলের। ওবায়দুল কাদের পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে কথা বলার প্রসঙ্গ টেনে দোষীদের ধরতে অভিযানের কথাও জানিয়েছিলেন। এ থেকে সরকার ও দলের অবস্থান স্পষ্ট ছিল, এবং স্থানীয় মেয়রের পারিবারিক ও রাজনৈতিক পরিচিতি যে কোনোভাবেই মামলার তদন্ত প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করবে না সে নিশ্চয়তাও ছিল।
সরকারের পক্ষ থেকে এতকিছু সত্ত্বেও বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের জরুরি সভা ও সংবাদ বিজ্ঞপ্তি ছিল অপ্রয়োজনীয়। এর মাধ্যমে তারা সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি করেছে।
আমলাতন্ত্রের বাড়াবাড়ি সব সময়েই ছিল। ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমল হয়ে বাংলাদেশের বর্তমান, সবখানে আমলাদের জয়জয়কার। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ পদে সাবেক/বর্তমান আমলাদের পদায়ন, রাজনৈতিক সরকারের মন্ত্রিসভায় সাবেক আমলাদের অন্তর্ভুক্তি, রাজনৈতিক দলে সাবেক আমলাদের মূল্যায়ন, নির্বাচনে ব্যবহার, নির্বাচন পরিচালনা কমিটিতে দায়িত্ব দেওয়াসহ নানা ঘটনা আমলাদের তাদের দায়িত্বের বাইরে আরও অনেককিছুতে অংশগ্রহণের যে অভীপ্সা এটাও শুভ লক্ষণ নয়। অন্য অনেক কিছু আমাদের চোখ এড়িয়ে গেলেও এবং আমরা গুরুত্ব দিয়ে না দেখলেও বরিশালের ঘটনা থেকে দৃষ্টি সরানো যাচ্ছে না। বলা যায়, আমলাদের অপ্রয়োজনীয় অবস্থান আমাদেরকে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এটা জরুরি ছিল না।
বরিশালের ঘটনা আমাদেরকে যে পরিস্থিতির মুখে ফেলেছে সেখানে বিজয়ী ও বিজিত পক্ষ খোঁজা ঠিক হবে না। এটাকে রাজনীতিবিদ ও আমলাদের লড়াই হিসেবে না দেখে ‘বিচ্ছিন্ন’ এক ঘটনা হিসেবে দেখা দরকার। এই ন্যক্কারজনক ঘটনার ন্যায়বিচার দাবি করার পাশাপাশি অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে দায়িত্বশীলতা প্রত্যাশা করি।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
- ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১: জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ’
- সুনীল অর্থনীতি ও রূপকল্প-২০৪১
- শিক্ষার ধরন ও বেকারত্ব: দেশে অশিক্ষিতদের চেয়ে শিক্ষিত বেকার ৩ গুন
- ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়
- ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস-১৯৬১ ও দ্বিপক্ষিয় কূটনীতিক সম্পর্ক
- মিডিয়ার শক্তি বা আসক্তি: ম্যাজিক বুলেটের বাকের ভাই ও বদি
- গণমাধ্যমে গণরুচির বিকার
- হালকা বিনোদনের প্রাধান্যে সংস্কৃতির অবনতি
- বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণার দিন শেষ, চার উপায়ে মধ্য আয়ের দেশ