বাংলাদেশে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার হালচাল
বাংলাদেশে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার হালচাল
মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা এমন একটি ব্যবস্থাপনা কৌশল, যা একটি প্রতিষ্ঠানের অভীষ্ঠ লক্ষ্যসমূহ অর্জনের জন্য আভ্যন্তরীণ মানবসম্পদের সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির ওপর আলোচনা করে। কর্মীদের প্রতিষ্ঠানের প্রতি আকৃষ্ট করা, আগ্রহীদের মধ্য থেকে যোগ্যদের খুঁজে বের করা ও নিয়োগ দেয়া, কর্মীদের অনুপ্রাণিত করা, কর্মীদের সাথে প্রতিষ্ঠানের সু-সম্পর্ক বজায় রাখা, তাদের কর্মজীবনে উত্তরোত্তর উন্নয়নের পথ সৃষ্টি করা এবং প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের নিয়ম ভঙ্গের জন্য শাস্তি দেয়া সহ প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ সম্পর্কিত সব ধরনের কাজই প্রতিষ্ঠানের মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার মূল উদ্দেশ্য হলো প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যসমূহ অর্জন করা, বিক্রয় ও রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, মুনাফা অর্জন ও বর্ধন, মার্কেট শেয়ার বৃদ্ধি এবং প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি উন্নততর করণ।
প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়ে কাজ করার সময় মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগকে সেই দেশের শ্রম আইন মেনে চলতে হয়। বর্তমানে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা আধুনিক বিশ্বের একটি চৌকস চাকুরী ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে বাংলাদেশে এর জনপ্রিয়তা এবং ক্ষেত্র একেবারেই নতুন বলা চলে। আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে এ পেশার চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের কর্মক্ষমতার যথার্থ ব্যবহারের লক্ষ্যে বর্তমানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করছে। কারণ একটি প্রতিষ্ঠানের সাফল্য অর্জন অনেকাংশেই নির্ভর করে সেই প্রতিষ্ঠানটির মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার উপর।
যে কোন প্রতিষ্ঠানে মানব সম্পদই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান সম্পদ। কোন প্রতিষ্ঠানে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ যত বড় কিংবা যত মূল্যবান ও অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি বা প্রযুক্তিই থাক না কেন, সেগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে কাংখিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজন হয় দক্ষ মানব সম্পদের। কোন প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জন কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্য অনেকটা নির্ভর করে দক্ষতা ও যোগ্যতা সম্পন্ন মানব সম্পদের উপর। তাই বলা যায়, যে কোন প্রতিষ্ঠানের জন্য মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় একটি বিভাগ।
"মানব সম্পদ" ধারণাটি যথেষ্টই আধুনিক, বিগত শতাব্দির শেষ দিকেও কোন প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের "সম্পদ" হিসেবে দেখা হত না। তারা ছিলেন শুধুই শ্রমিক, উচ্চ পদস্থ কর্তাদের আদেশ পালন করা ছিল তাদের প্রথম ও প্রধান কাজ। ধীরে ধীরে কোম্পানিগুলো দেশে-বিদেশে বিস্তার লাভ করার পর উপলব্ধি করল যে, এই ধারা অব্যহত রাখার কান্ডারী হল তাদের কর্মীগণ। একটি প্রতিষ্ঠানের লোকবলই তাদের সবচাইতে বড় সম্পদ। এই উপলব্ধি থেকেই "মানব সম্পদ উন্নয়ন" ধারণার প্রবর্তন ঘটে। বাংলাদেশে বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির হাত ধরে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ এর যাত্রা শুরু হয় ২২/২৫ বছর আগে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সাথে প্রতিযোগীতায় টিকে থাকার জন্য দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও দ্রুত মানব সম্পদ উন্নয়ন শাখা চালু করছে, এতে আকর্ষণীয় কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে।
সময়ের তাগিদে আমাদের দেশের প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ অতীব গুরুত্বের সাথে কাজ করে যাচ্ছে, যাতে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বা কর্মচারীগণ তাদের অভিজ্ঞতা, সততা এবং দূরদর্শিতার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বিংশ শতাব্দির শুরুর দিকে সারা বিশ্বে শিল্প বিপ্লব শুরু হলে তুমুল প্রতিযগিতায় টিকে থাকার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের দিয়ে অবৈধভাবে কাজ করিয়ে নেয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। এর ফলে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিতে থাকে। মূলত এই শ্রমিক অসন্তোষের ফলেই মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা ধারণার জন্ম হয়। তৎকালীন সময়ে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার কাজ ছিল শ্রমিকদের কর্ম-ঘণ্টার হিসাব রাখা এবং তাদের যথোপযুক্ত পারিশ্রমিক নিশ্চিত করা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্রয়োজনের তাগিদে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার পরিধি অনেক বিস্তৃত হয়েছে। মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রথাগত জনপ্রশাসন (পারসোনেল ম্যানেজমেণ্ট) থেকে পৃথক। বিংশ শতাব্দির শুরুর দিকে মানব সম্পদ ব্যাবস্থাপনার শুরু হয়েছিল মূলত ফেদ্রিক টেইলর বৈজ্ঞানিক ব্যাবস্থাপনা তত্ব থেকে। বৈজ্ঞানিক ব্যাবস্থাপনা মূলত উৎপাদনে প্রক্রিয়ার কার্যকারীতা, দক্ষতা এবং মিতব্যাযয়িতা আনয়ন করেছিল। এই বৈজ্ঞানিক ব্যাবস্থাপনাকে প্রায়োগিক করার জন্য এর আরো একটি উন্নত তত্বের প্রয়োজন ছিল যা, মানব সম্পর্ক বিজ্ঞান বা হিউম্যান রিলেশন সায়েন্স নামে পরিচিতি পায়। পরবর্তীতে এই মানব সম্পর্ক বিজ্ঞানই মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনায় রুপ নেয়।
কর্মের ধরন এবং প্রতিষ্ঠানের কর্ম পরিবেশ শ্রমিক-কর্মচারীর প্রেষণা ব্যাপকভাবে প্রভাবান্বিত করে থাকে। প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মীদের কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্যে কিছু একটার প্রয়োজন হয়। শুধুমাত্র বেতন একজন কর্মচারীর প্রতিষ্ঠানে কাজ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট নয়। কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানে কাজ করার জন্যে উক্ত প্রতিষ্ঠানের সার্বিক পরিবেশও প্রয়োজন হয়। যদি কাজের পরিবেশ না থাকে, তাহলে কর্মচারীর কাজের গুণমান বা কাজের সাধারণ মানের অবনতি ঘটবে। কর্মচারীর মূল ধারণা হলো- একজন কর্মচারীকে তার পূর্ণ ক্ষমতানুযায়ী কাজ করতে দেওয়া, নিজের মত করে কাজ করতে দেয়া, যাতে সে তার নিজের উদ্ভাবনীকে কাজে লাগাতে পারে। প্রকৃত পক্ষে প্রতিষ্ঠানের মানব সম্পদের মধ্যে “Feeling of ownership” এই ধারনায় যতক্ষণ পর্যন্ত সে না আসতে পারে, কর্মীর প্রকৃত উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ কর্ম নৈপুণ্যতা ও ফলপ্রসূ উৎপাদনশীলতার পরিস্ফুটন ঘটতে পারেনা।
সবার ক্ষেত্রেই নতুন প্রতিষ্ঠানে মানিয়ে নেওয়া নিয়ে শংকা থাকে। সমালোচনা, তিরস্কারের চাইতেও প্রশংসায় অনেক সময় কাজের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। আনন্দময় ও ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করতে পারলে কর্মক্ষেত্র যেকোন রুচিশীল ও মননশীল মানুষেরই পছন্দ হবে। পারস্পরিক সম্মানবোধটা না থাকলে কর্মক্ষেত্রকে আনন্দময় করে তোলা অসম্ভব। কর্মজীবনে খুশি থাকতে পারাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। অনিচ্ছাকৃতভাবে কাজ করা, কাজ অসমাপ্তভাবে করা এবং কাজ শেষে কাজের প্রশংসা না পাওয়ায় এক ধরনের নেতিবাচক চাপ তৈরি করে। কর্ম ও কর্মক্ষেত্রের প্রতি সম্মান দেখানোর ক্ষেত্রে সিনিয়রদের যথেষ্ট আন্তরিকতার দরকার। যে সমস্যা দ্রুততম সময়ে সমাধান সম্ভব তা দীর্ঘ সময় জিইয়ে রাখার অর্থ প্রতিষ্ঠানকেই ক্ষতিগ্রস্ত করা। ছোট কিংবা বড় যেকোন দল পরিচালনায় জ্ঞানগত দিকের পাশাপাশি আচরণগত জ্ঞান থাকাটা খুব জরুরী। কারণ, যেহেতু এই কর্মীবাহিনীই হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের চাকাকে সচল রাখবার নিয়ামক শক্তি।
মালিক পক্ষের দ্বায়িত্ব এই কর্মীবাহিনীকে তাদের অধিকার সচেতন করা, তাদের দায় ও দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া। তাদের একক ও সামস্টিক সমস্যার কথা জানতে হবে, তাদের কথা বলার সুযোগ দিতে হবে, সমস্যা সমাধানে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভিন্ন ভিন্ন কৌশলগত উদ্যোগ নিতে হবে। এই প্রক্রিয়া গুলো তাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের প্রতি আন্তরিকতা বৃদ্ধি ও মোটিভেশন প্রক্রিয়া হিসেবে কাজ করবে। কাজের দক্ষতা থাকলেই হয় না, সহকর্মীদের সঙ্গে মেশার দক্ষতাও থাকতে হয়। এটা ঠিক যে, জীবনের সবকিছুই নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী সব সময় চলে না। যেখানে কাজের পরিবেশ ভালো সেখানে যোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। যদি সহকর্মীরা হয় চমৎকার মন মানসিকতার তবে কার না ভাল লাগে। উর্ধ্বতনরা যদি হয় সুবিবেচক, আন্তরিক, কর্মরতদের আরাম-আয়েশ ও প্রয়োজনীয়তা পূরণে হন যত্নশীল, তবে কার না পছন্দ হবে! এসব সুন্দর কর্ম পরিবেশ যে প্রতিষ্ঠানে থাকে তা হয় ভাল লাগারই একটি জায়গা। মন আর শরীর যদি চাঙ্গা থাকে, তাহলে কোন কিছুতেই নেতিবাচক প্রভাব পরে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করলেও অতৃপ্ত আসে না। কর্মীরা তখন নিজের কাজ আর প্রতিষ্ঠানের কাজ আলাদা করে দেখে না। শিল্পকে রক্ষা করার জন্য আইন শৃঙ্খলা বাহীনির প্রয়োজন হবে না, বরং প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাই প্রতিষ্ঠান রক্ষার ঢাল হিসেবে কাজ করবে। তাই প্রতিষ্ঠানে দক্ষ মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি দরকার ইতিবাচক পরিবেশ।
মোঃ জিয়াউল হক, ব্যবস্থাপক, মানব সম্পদ ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ, নেক্সাস টেলিভিশন
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
- ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১: জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ’
- সুনীল অর্থনীতি ও রূপকল্প-২০৪১
- শিক্ষার ধরন ও বেকারত্ব: দেশে অশিক্ষিতদের চেয়ে শিক্ষিত বেকার ৩ গুন
- ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়
- ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস-১৯৬১ ও দ্বিপক্ষিয় কূটনীতিক সম্পর্ক
- মিডিয়ার শক্তি বা আসক্তি: ম্যাজিক বুলেটের বাকের ভাই ও বদি
- গণমাধ্যমে গণরুচির বিকার
- হালকা বিনোদনের প্রাধান্যে সংস্কৃতির অবনতি
- বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণার দিন শেষ, চার উপায়ে মধ্য আয়ের দেশ