রেহানার কানযাত্রা হ্যাশট্যাগ মিটু আন্দোলন ও মিডিয়ার প্রচারবাণিজ্য
রেহানার কানযাত্রা হ্যাশট্যাগ মিটু আন্দোলন ও মিডিয়ার প্রচারবাণিজ্য
সাজ্জাদ বকুল |
কয়েক বছর আগে ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ নামে একটি সামাজিক আন্দোলন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। নারীদের সাথে ঘটে চলা যৌন হয়রানির প্রতিবাদে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই আন্দোলনের সূচনা হয়। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের আনাচে-কানাচে। ২০১৭ সালের শেষের দিকে হলিউডের প্রভাবশালী চলচ্চিত্র প্রযোজক হার্ভে উইনস্টেইনের বিরুদ্ধে হলিউডের বেশ কয়েকজন জনপ্রিয় অভিনেত্রীকে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির অভিযোগ থেকে এই আন্দোলনের সূচনা। কিন্তু উইকিপিডিয়া মারফত জানা যাচ্ছে, এর গোড়াপত্তন হয়েছিল তারো প্রায় এক দশক আগে, ২০০৬ সালে। সে বছর মার্কিন নারী সমাজকর্মী টারানা বার্ক মাইস্পেস নামের সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ আন্দোলনের সূচনা করেন।
বিবিসি বাংলা অনলাইনে ২০১৮ সালের ২৫ জানুয়ারি প্রকাশিত ‘‘মি টু’ কি সত্যিই মেয়েদের জীবনে যৌন নির্যাতনের ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়াবে?’’ শীর্ষক একটি মন্তব্য-প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, টারানা বার্ক ১৯৯৭ সালে ১৩ বছর বয়সী এক কিশোরীর মুখে তার প্রতি ঘটা যৌন নির্যাতনের কাহিনি শোনেন এবং তখনই তাঁর বুকের ভেতর এই ‘মি টু’ শব্দবন্ধটি জন্ম নিয়েছিল। সমাজকর্মী টারানা পরে যৌন সহিংসতার বিরুদ্ধে একটি প্রচার আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং এর নাম রাখেন ‘মি টু’ অর্থাৎ ‘আমিও’ যৌন হয়রানির শিকার। তবে কৃষ্ণাঙ্গ টারানার এই আন্দোলনকে বিশিষ্ট শেতাঙ্গ নারীবাদীরা তখন পাত্তা দেন নি।
২০১৭ সালের অক্টোবরে হলিউডের প্রযোজক হার্ভে উইনস্টেইনের বিরুদ্ধে নারীদের যৌন হয়রানির নানা অভিযোগ নিয়ে একটি সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এর সূত্র ধরে হলিউডের নায়িকা আলিসা মিলানো হার্ভের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনে সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘#মি টু’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেন। এরপর থেকে আরো অনেক নারীই সোশ্যাল মিডিয়ায় এই শব্দবন্ধ ব্যবহার করে তাদের প্রতি ঘটা যৌন হয়রানির বিষয়গুলো সামনে আনতে থাকেন। দাবানলের মতো তা ছড়িয়ে পড়তে থাকে টুইটার, ফেসবুকসহ নানা সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে। সেখান থেকে সেই আন্দোলন পথে গড়ায়, বিভিন্ন দেশে রাস্তায় নেমে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এই আন্দোলনে সমর্থন যোগাতে থাকেন।
এই আন্দোলনের ঢেউ এতোটাই শক্তিশালী ছিল যে পৃথিবীর বহু দেশের চলচ্চিত্র, টেলিভিশন, সাংবাদিকতা, শিক্ষাঙ্গনসহ নানা অঙ্গনের নারী নিপীড়ক পুরুষদের কথা সামনে আনতে থাকেন ঘটনার শিকার নারীরা। সে ছিল এক অভূতপূর্ব সামাজিক আন্দোলন। যৌননিপীড়ক পুরুষদের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। বহু নিপীড়ক পুরুষকে এর জন্য খেসারত দিতে হয়েছে। হার্ভে উইনস্টেইনের বিরুদ্ধে তারকা অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, গিনেথ প্যালট্রোসহ বেশ কয়েকজন নামকরা অভিনেত্রী ধর্ষণের অভিযোগ আনেন। এসব অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। অন্তত দুটি ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০২০ সালের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালত হার্ভেকে ২৩ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশি তরুণ চলচ্চিত্রকার আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ নির্মিত দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘রেহানা মরিয়াম নূর’ এই ‘মি টু’ আন্দোলনকে আবার সামনে আনতে পারে। মাঝখানে ঝিমিয়ে পড়া এই সামাজিক আন্দোলনের পালে হাওয়া লাগাতে পারে সাদের এই ছবি, এমন আলোচনা অবশ্য দেশি মূলধারার গণমাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়াতে আমার চোখে পড়েনি। ছবিটা কান চলচ্চিত্র উৎসেব ‘আঁ সার্তেঁ রিগা’য় প্রতিযোগিতার জন্য অফিসিয়াল সিলেকশন পেয়েছে। সেখানে এরই মধ্যে চলচ্চিত্রটি প্রদর্শিত হয়েছে এবং দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে বেশ আলোচনা হচ্ছে ছবিটা নিয়ে।
সাদই প্রথম বাংলাদেশি চলচ্চিত্রকার যাঁর ছবি ফ্রান্সের ঐতিহ্যবাহী কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রতিযোগিতার জন্য অফিসিয়াল সিলেকশন পেয়েছে। কান উৎসবে নানা দেশের নবীন প্রতিশ্রুতিশীল ও মেধাবী চলচ্চিত্রকারকে বিশ্ববাসীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে তার প্রথম বা দ্বিতীয় চলচ্চিত্রকে ‘আঁ সার্তেঁ রিগা’ ক্যাটেগরিতে প্রতিযোগিতার জন্য সুযোগ দেওয়া হয়। এর আগে বাংলাদেশের অকালপ্রয়াত গুণি নির্মাতা তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ চলচ্চিত্রটি কান উৎসবের ‘ডিরেক্টরস ফোর্টনাইট’ শাখায় প্রদর্শিত হয়েছিল। তবে সেটি উৎসবের মূল অংশ বা প্রতিযোগিতা বিভাগ ছিল না।
তাই সাদের দ্বিতীয় ছবি ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ যে সাফল্য নিয়ে এসেছে তা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জন্য নিঃসন্দেহে গৌরবের। এ জন্য একনিষ্ঠ, প্রচারবিমুখ এই তরুণ চলচ্চিত্রকারের জন্য আমার ‘টুপি খোলা’ অভিবাদন। দেশের সর্বস্তরের মানুষ সাদ, তাঁর ছবি ও টিমের সদস্যদের প্রাণভরা ভালবাসা জানাতে দ্বিধা করছেন না। বাংলাদেশের মূলধারার মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায় স্বাভাবিকভাবেই এই ছবি নিয়ে তোলপাড় চলছে। অনেক আলোচনার ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। তবে সেই আলোচনায় সাদের এই ছবি যে নারীর প্রতি যৌনপীড়ন ও তার প্রতিবাদের গল্প বলেছে এবং ছবিটি এই বিষয়কে আবার সামনে আনবে সে আলোচনা কোথাও দেখছি না।
অথচ যতোটুকু বোঝা যাচ্ছে তাতে এই ছবির সাফল্য শুধু যে এর নিরীক্ষাধর্মী চলচ্চিত্রভাষার কারণে এসেছে তা নয়, বরং প্রতীয়মান হচ্ছে এর গল্পও ছবিটিকে সাফল্য এনে দিয়েছে। এই ছবির গল্পে একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এক ছাত্রীর প্রতি তাঁর কলেজশিক্ষকের যৌন হয়রানির প্রতিবাদে রেহানা মরিয়ম নূর নামে সেই কলেজের একজন শিক্ষিকার লড়াই, এ সময় তাঁর শিশুকন্যাকে নিয়ে মানসিক টানাপোড়েন শক্তিশালী ভাষায় চলচ্চিত্রটিতে তুলে ধরা হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
ছবিটি আমার এখনো দেখার সুযোগ হয় নি। কান চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নেওয়া এ দেশের কয়েকজন সাংবাদিক বাদে এ দেশের প্রায় কারোরই ছবিটি দেখার সুযোগ এখনো হয় নি। তবে ছবিটির ট্রেলার ও এর অভিনেত্রী বাঁধনের কাছ থেকে মিডিয়ামারফত পাওয়া কিছু তথ্য এবং জার্মান গণমাধ্যম ডয়চে ভেলের অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত কানে সাদের প্রেস কনফারেন্সে দেওয়া বক্তব্যের ভিডিও থেকে ছবিটির বিষয় সম্পর্কে এমন ধারণাই পাওয়া যায়।
সাদের ছবি ‘রেহানা মরিয়ম নূর’-এর সঙ্গে ‘#মি টু’ আন্দোলনের সরাসরি সম্পর্ক হয়তো নেই, কিন্তু দূরবর্তী সম্পর্ক নিশ্চয় রয়েছে। ছবিটিতে যে বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে তেমন পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতেই ২০০৬ সালে মার্কিন নারী সমাজকর্মী টারানা বার্ক এই আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। আর হার্ভে উইনস্টেইনের মতো চলচ্চিত্রজগতের প্রভাবশালী পুরুষদের দ্বারা হয়রানির শিকার হওয়া নারীরাই এই আন্দোলনের পালে নতুন করে হাওয়া লাগান ২০১৭ সালের শেষ নাগাদ। সেই ইতিহাস আমি শুরুতে তুলে ধরেছি। সাদের এই ছবি বাংলাদেশে এই আন্দোলনের পালে নতুন করে হাওয়া লাগাবে বলে ধরে নেওয়া যায়।
কিন্তু বাংলাদেশের মূলধারার মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায় সাদ ও তাঁর ‘রেহানা’ নিয়ে আজ পর্যন্ত যা বলাবলি, লেখালেখি হচ্ছে তাতে ছবির মূল বিষয়টিই যেন অনুপস্থিত। মূলধারার মিডিয়াগুলোর আড়ালে থাকতে পছন্দ করা সাদকে ‘রহস্যময়’ ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপনে তুমুল আগ্রহ আমার নজরে পড়েছে। তাঁকে যেভাবেই হোক পাকড়াও করে সাক্ষাৎকার নেওয়ার চেষ্টা এবং এর বদলে নিজেদের সার্কুলেশন-টিআরপি-হিট-ভিউ বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত মনে হয়েছে মিডিয়াগুলোকে। আর সেই সাথে কিছু মিডিয়ায় এই ছবির অভিনেত্রী বাঁধনকে ‘হট আইটেম’ হিসেবে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে তো কোনো লুকোছাপা দেখতে পাচ্ছি না।
গত ৭ জুলাই দেশের একটি স্বনামধন্য সংবাদপত্রের বিনোদনপাতায় ‘রেহানা’-সূত্রে বাঁধনের একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয় যার শিরোনাম ছিল ‘স্ক্রিনে যে অস্থিরতা, তা আমার জীবনেও আছে’। এই সাক্ষাৎকারে অন্যান্য প্রসঙ্গের পাশাপাশি বাঁধন প্রিমিয়ার শোতে কী পোশাক পরবেন সেই বিষয়ে তথ্য থাকলেও শিরোনামের ওইটুকু তথ্য ছাড়া ছবির বিষয়বস্তু নিয়ে একটি বাক্যও খরচ করা হয়নি। আর এই সাক্ষাৎকারের সাথে বাঁধনের এমন একটি বড় আকারের ছবি ছাপা হয়েছে যার সাথে ছবির রেহানার মিল তো দূরের কথা, আগে কখনোই কোনো পত্রিকায় বাঁধনের এমন ‘হট আইটেম মার্কা’ ছবি ছাপা হতে দেখি নি বা হলেও আমার নজরে পড়ে নি। মজার বিষয় হলো, ছবিটি আবার বাঁধনের সৌজন্যেই প্রকাশিত হয়েছে। অর্থাৎ বাঁধনই এমন ছবি সরবরাহ করেছেন পত্রিকাটিকে।
এই সাক্ষাৎকারের ঠিক নিচেই ‘সাদের গল্প, ‘রেহানা’র গল্প’ নামে আরেকটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে ছবিটির পোস্টারসহ। শিরোনামেই বোঝা যাচ্ছে লেখাটি ছবিটির গল্প নিয়ে। কিন্তু সাড়ে তিনশরও বেশি শব্দের এই লেখাটিতেও মাত্র ১৯টি শব্দের একটি বাক্যে ছবির গল্পকে তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে নারীর প্রতি যৌন সহিংসতার কোনো উল্লেখ নেই। সেদিনই ছবিটি কান উৎসবে প্রদর্শিত হয়। সাদ অনেক লুকোছাপা করলেও পত্রিকাটিতে সেই লেখা প্রকাশের আগেই ছবিটির বিষয়বস্তু সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া গিয়েছিল। বাঁধনের সাক্ষাৎকারেও তাঁকে ছবির বিষয় নিয়ে সরাসরি কোনো প্রশ্ন দেখা যায় নি।
চলচ্চিত্র একটি বাণিজ্যিক শিল্পমাধ্যম। মিডিয়াও আসলে তা-ই। যদিও দুটো মাধ্যমেরই সমাজের প্রতি, মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে বলে মনে করা হয়। সাদ যে তাড়না থেকে যে গল্পে ছবিটি বানিয়েছেন, যা তাঁর নিজের দেখা-বোঝা-অভিজ্ঞতা থেকেই তৈরি করা বলে ডয়চে ভেলের সেই ভিডিওর কল্যাণে সাদের মুখ থেকেই জানা যাচ্ছে। অভিনেত্রী বাঁধন যাতে একজন নারীর প্রতি যৌনপীড়নের ঘটনায় আরেক নারীর প্রতিবাদ ও এ সংক্রান্ত নানা মানসিক টানাপোড়েন বিশ্বস্ততার সাথে পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে পারেন তার জন্য পরিচালকের বছরব্যাপী প্রচেষ্টার কথাও আমরা গণমাধ্যমে বাঁধনের মুখ থেকেই জানতে পেরেছি।
নারীদের জন্য যৌনপীড়নের মতো বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা নিয়ে তৈরি ছবির ক্ষেত্রে যতোটা হইচই মূলধারার মিডিয়ায় হয়েছে তাতে ছবির মূল বক্তব্য আড়ালে পড়ে গেল কেন তা ভাববার বিষয় বৈকি! তবে এর উত্তরও আমাদের কমবেশি জানা। চলচ্চিত্রের মতো একটি বাণিজ্যিক ‘আইটেম’ নিয়ে বাণিজ্যমুখী গণমাধ্যম তো বাণিজ্যই করতে চাইবে। তাই তো সেই স্বনামধন্য সংবাদপত্রের ওয়েবপোর্টালের লাইফস্টাইল বিভাগে আজ ১৩ জুলাই ‘সাদের পছন্দে রেড ওয়াইন জাম্পস্যুটটি পরেছিলেন বাঁধন’ শিরোনামে একটি ফিচারধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে কানে বাঁধন যেসব পোশাক পরেছিলেন তার সচিত্র বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।
মিডিয়া এখন সাদ বা বাঁধনকে পুঁজি করে তাদের প্রচার বাড়াতে চাইবে এটাও না হয় মেনে নেওয়া গেল। কিন্তু খোদ পরিচালক আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ ও অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধনও কম হতাশ করলেন না। সাদ কানের সেই প্রেস কনফারেন্সে যা বলেছেন তার মোদ্দা কথা হলো, তিনি বাজার ভেবে বা কে কীভাবে ছবিটা গ্রহণ করবে তা ভেবে ছবি করেন না। তাঁর দেখা, শোনা, অভিজ্ঞতায় পাওয়া মানুষের জীবনের সংকটের গল্প নিয়ে তিনি ছবি বানান ও বানাতে চান। আমরা জানি, সেভাবেই বানিয়েছেন প্রথম ছবি ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’।
সাদের দ্বিতীয় ছবি ‘রেহানা মরিয়ম নূর’-এর বিষয় সংবেদনশীল। ছবির জন্য যে বাঁধনকে পরিচালক সাদ চরিত্রের উপযোগী করে গড়ে তুলেছেন, পুরো একটা বছর ধরে সেই চরিত্রের ভেতরে বাস করতে উৎসাহিত করেছেন, কানের লাল গালিচায় বা প্রিমিয়ার শোতে বাঁধনকে ছবির রেহানারূপে উপস্থাপন করতে পারলে নিঃসন্দেহে ছবির বিষয়টার প্রতি বিশ্বদর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা সম্ভব হতো। অন্তত বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ সেই সময় সাদের ছবিকে ঘিরে কানে কী হচ্ছে সে বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রেখেছিলেন। তাই কানে সাদ, বাঁধন বা তার টিম যদি ছবির মূল বার্তাটিকে তুলে ধরার কোনো সুযোগ নিতে চেষ্টা করতেন তাহলে তা ছবিটিকে আরো সফল করে তুলতো বলেই আমার ধারণা।
সেটা তারা কীভাবে করতে পারতেন? আমরা এ প্রসঙ্গে স্মরণ করতে পারি ‘#মি টু’ আন্দোলনের সূচনাকালে হলিউডের বেশ কয়েকজন অভিনেত্রীর কথা, যাঁরা ২০১৮ সালের গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে কালো গাউন পরে হাজির হয়েছিলেন নারীর প্রতি যৌননিপীড়কদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে। সে বছর ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটেনে বাফটা অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে নারীদের পাশাপাশি পুরুষ টিভি ও চলচ্চিত্র তারকারা ‘টাইমস আপ’ ও ‘মি টু’ আন্দোলনের সমর্থনে কালো পোশাক পরে হাজির হয়েছিলেন। কানে সাদ তাঁর টিমকে নিয়ে এ রকম কিছু করতে পারতেন।
তবে আমাদের এটাও মাথায় রাখতে হবে, সাদ খুবই তরুণ একজন চলচ্চিত্রকার। তিনি প্রেসের সামনে কথা বলতে, নিজেকে শো-অফ করতে অভ্যস্ত নন। তার ওপর এই বয়সেই এতো বড় বৈশ্বিক প্ল্যাটফরমে গিয়েছেন, সব কিছু তার ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করেছে, প্রেস কনফারেন্সে তাঁর বক্তব্য থেকেও সেটা বোঝা যায়। তাই কানে তাঁর কাছ থেকে নারীর প্রতি যৌন সহিংসতার বিরুদ্ধে এর আগে হলিউডে বা ব্রিটেনে করা প্রতিবাদের আদলে কিছু আশা করা একটু বেশিই হয়তো হয়ে যায়।
কানের কয়েকদিনে বাঁধন নানা রকম ঝলমলে, নিজেকে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করা যায় এমন পোশাক পরলেও প্রেস কনফারেন্সে তিনি ও পরিচালক বাঁধনসহ টিমের বাকিরা কালো পোশাকেই ছিলেন। কিন্তু সেটা যে তাঁর ছবির বিষয় ও ‘#মি টু’ আন্দোলনকে মনে করিয়ে দিতেই, প্রেস কনফারেন্সের ভিডিওতে তেমন বক্তব্য পাইনি। আসলে নারীর জন্য এমন বিভিষীকাময় একটি বিষয়কে নিয়ে নির্মিত ছবিকে ঘিরে মিডিয়ার এমন বাণিজ্যমুখী উপস্থাপন দেখে মনে হয়েছে, অন্তত সাদ বা বাঁধন যদি সেই বৈশ্বিক প্ল্যাটফরমে ‘মি টু’র প্রসঙ্গটি সামনে আনতেন তাহলে ছবিটার প্রতি সুবিচার করা হতো।
অবশ্য বাংলাদেশের কোনো মিডিয়াতে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ ও ‘মি টু’র সংযোগ নিয়ে কোনো প্রতিবেদন চোখে না পড়লেও সেই জার্মান মিডিয়া ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগের ওয়েব পোর্টালে কিন্তু গত ১০ জুলাই ‘মি টু’ আন্দোলন ও রেহানা মরিয়ম নূর’ শিরোনামে একটি ব্লগ প্রকাশিত হয়েছে। তাহলে কি আমরা ভাবব আমাদের মিডিয়াগুলোর বেশিরভাগই এখনো যথেষ্ট ম্যাচিউরড হয়ে উঠতে পারে নি? না, সেটা ভাবতে চাই না। আশা রাখব, ছবিটা নিয়ে মানুষের আগ্রহ থাকতে থাকতেই ছবির গল্পের মূল থিমটার সাথে ‘মি টু’ আন্দোলনের সংযোগ নিয়ে মিডিয়া কথা বলবে।
ড. সাজ্জাদ বকুল। সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ। ই-মেইল: [email protected], [email protected]
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
- ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১: জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ’
- সুনীল অর্থনীতি ও রূপকল্প-২০৪১
- শিক্ষার ধরন ও বেকারত্ব: দেশে অশিক্ষিতদের চেয়ে শিক্ষিত বেকার ৩ গুন
- ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়
- ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস-১৯৬১ ও দ্বিপক্ষিয় কূটনীতিক সম্পর্ক
- মিডিয়ার শক্তি বা আসক্তি: ম্যাজিক বুলেটের বাকের ভাই ও বদি
- গণমাধ্যমে গণরুচির বিকার
- হালকা বিনোদনের প্রাধান্যে সংস্কৃতির অবনতি
- বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণার দিন শেষ, চার উপায়ে মধ্য আয়ের দেশ