রোজিনার কারাবাস: মন্ত্রী, মন্ত্রণালয় ও সংবাদপত্রের ভূমিকা
রোজিনার কারাবাস: মন্ত্রী, মন্ত্রণালয় ও সংবাদপত্রের ভূমিকা
প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক মামলায় জামিন আদেশের অপেক্ষায় কারাগারে রয়েছেন। চারদিন ধরে তার জামিনের আদেশ আটকে রয়েছে ঢাকার মুখ্য মহানগর আদালতের (সিএমএম) হাকিম বাকী বিল্লাহর আদালতে। মঙ্গলবার যে জামিনের শুনানি শুরু হয়েছিল তার সমাপ্তি ঘটে বৃহস্পতিবার, এবং দুইদিনের সাপ্তাহিক ছুটি সামনে থাকা সত্ত্বেও আদেশ আসেনি; আদেশের দিন ধার্য হয়েছে আগামী রোববার। ওইদিন জামিন নিষ্পত্তি হবে বলে আশা করি, তবু এনিয়েও প্রশ্ন জাগে। এই প্রশ্নের কারণ মূলত বাদী পক্ষের শক্তিশালী অবস্থান যেখানে মুক্তির দাবি বারবার ধাক্কা খাচ্ছে তাদের নানা প্রচার, অপপ্রচারসহ নানাবিধ কৌশলে। সচিবালয়ে অবৈধ আটক প্রক্রিয়া, মামলার ধারা নিয়ে নানাবিধ আলোচনা, মামলার যৌক্তিকতা নিয়ে নানাবিধ প্রশ্ন, সরকারের অবস্থান নিয়ে নানাবিধ গুঞ্জন বাদেও আমরা বিজ্ঞ আদালতের প্রতি আস্থা রাখতে চাই। এই আস্থা সাংবিধানিক প্রথা-প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে।
জামিনযোগ্য, পরস্পরবিরোধি ও দুর্বল অভিযোগ এবং আইনের উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন উল্লেখে অনেক বিজ্ঞ আইনজ্ঞ ও সাবেক বিচারপতিরা এই মামলায় রোজিনা ইসলামের গ্রেপ্তারের পর তৎক্ষণাৎ জামিন পাওয়ার অধিকার রাখেন বলে তাদের অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন, এখনও করছেন। তারা জামিনের পক্ষে নানা যুক্তি দেখিয়েছেন, কেন তার জামিন হয়নি এনিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। এতকিছু সত্ত্বেও বাস্তবতা হচ্ছে জামিনের অপেক্ষায় কারাগারে থাকতে হচ্ছে রোজিনা ইসলামকে। থাকতে হবে রোববার পর্যন্ত, অথবা বলা যায় পরবর্তী সিদ্ধান্ত আসা পর্যন্ত।
নিম্ন আদালত কতখানি রাজনৈতিক ও নির্বাহী বিভাগের প্রভাবমুক্ত এনিয়ে দেশে প্রশ্ন রয়েছে। এই প্রশ্ন যে অমূলক নয় তা নানা সময়ে নানা ঘটনায় প্রমাণ হয়েছে। ক্ষমতার কাছে রীতি-প্রথা-প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিকতার ব্যত্যয় আমরা নানা সময়ে দেখেছি, এখনও দেখছি। বিবিধ বাধ্যবাধকতা ও সেন্সরশিপে হয়ত সরাসরি অনেক কিছু বলা যায় না কিন্তু বাস্তবতাকে ত অস্বীকার করা যায় না। শিকদার ভ্রাতৃদ্বয়ের একজনের ঘটনায় আমরা দেখলাম তড়িৎ গতির জামিন প্রক্রিয়া, বসুন্ধরার এমডির ঘটনায় আমরা দেখলাম দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সংবাদ গণমাধ্যমে আসার পর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আদেশ। মোসারাত জাহান মুনিয়া নামের এক কিশোরীর আত্মহত্যার প্ররোচনা মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার পরেও আমরা সরকার-প্রশাসনের কোনধরনের ভূমিকাই দেখিনি। এতে ক্ষমতার কাছে সহজাত-ধর্মের ব্যত্যয়ের যে নজির সেগুলো অস্বীকার করি কীভাবে? এর উলটো যে দিক সেখানে ক্ষমতার ভারে পিষ্ট হয়ে যাওয়ার উদাহরণ সেটা দেখছি রোজিনা ইসলামের ক্ষেত্রে।
রোজিনাকে গ্রেপ্তারের পর আমরা দেখলাম স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞাপন যেখানে তদন্তাধীন বিষয় সত্ত্বেও তাকে একপাক্ষিকভাবে চোর সাব্যস্ত করে চরিত্রহননের প্রচেষ্টা। এই যে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হলো সেটা রাষ্ট্রের অর্থ খরচে। রাষ্ট্র তার নাগরিকের চরিত্রহননে অশোভন ইঙ্গিতে, অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দ-বাক্য ব্যবহারে এমন বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারে? সেই অধিকার কি তাদের আছে? এখানে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় বলতে পারে তাদের সংবাদ সম্মেলন বর্জন করেছে সচিবালয়ে দায়িত্বরত সাংবাদিকদের একাধিক সংগঠন। কিন্তু প্রকৃত অর্থে কি সংবাদ বর্জন হয়েছিল? স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন রোজিনা ইসলামকে উদ্দেশ করে আক্রোশের শব্দ-বাক্যের ব্যবহারে বক্তব্য দিয়েছেন সেগুলো কি গণমাধ্যম বর্জন করেছিল? করেনি। বরং সেগুলো গুরুত্ব দিয়েই প্রকাশ-প্রচার হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে দায়ের মামলায় যে অভিযোগগুলো তুলেছে সেগুলো কি আসেনি কোন গণমাধ্যমে? এসেছে, এবং এনিয়ে আলোচনাও হয়েছে। তাহলে রাষ্ট্রের জনগণের অর্থ ব্যয়ে কেন বিজ্ঞাপন প্রচার করতে হলো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে? এটা কি রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় নয়?
কথা ওঠেছে, সাংবাদিকদের একাধিক সংগঠন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলন বর্জনের পর কেন সেই একই মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞাপন প্রকাশ করল কিছু গণমাধ্যম। এখানে নানা মত নানাজনের। এই বিজ্ঞাপন প্রকাশে সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমের দ্বিচারি ভূমিকা নিয়ে অনেকের প্রশ্ন। কিন্তু তারা কি ভেবেছে নির্দিষ্ট সংবাদ সম্মেলন বর্জন মানে পুরো মন্ত্রণালয়কেই বর্জন করা নয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সকল সংবাদকে বর্জন করা হলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী অসত্য বক্তব্যকে প্রকাশ করত না গণমাধ্যমগুলো। এখানে নির্দিষ্ট সংবাদ সম্মেলন বর্জন হয়েছে ঘটনার প্রতিবাদে। আর ঘটনার প্রতিবাদ মানে কারও প্রতি, কোন প্রতিষ্ঠানের প্রতি আক্রোশ নয়; যা কখনই করবে না কোন গণমাধ্যম, এবং এটা গণমাধ্যমের চরিত্রও নয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞাপন প্রচার না করলে ‘সেন্সরশিপ’ তৈরি হতো এমন মন্তব্য করেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম। প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক মন্তব্য প্রতিবেদনে তিনি লিখেছেন, ‘‘আমরা কেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞাপন ছেপেছি, এ নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠেছে। এটি প্রকাশ করা না হলে এমন একটি সেন্সরশিপ তৈরি করা হতো, যা আমরা পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করি।’’ মাহফুজ আনামের এই ‘সেন্সরশিপ’-এর ধারণা প্রকাশকে অনেকে অনেকভাবে নিতে পারেন, কিন্তু প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য ‘সেন্সরশিপ’-এর বিরোধিতা করতে থাকা মিডিয়াগুলো যদি সত্যি সত্যি এই বিজ্ঞাপন প্রকাশে নিজেদের সিদ্ধান্তের প্রকাশ ঘটাতে যেত তখন কি ‘সেন্সরশিপ’ বিষয়ক স্ববিরোধিতা হয়ে যেত না? তবে হ্যাঁ, এখানে পত্রিকার সম্পাদকীয় নীতি নিয়ে আলোচনা হতে পারে, কারণ পত্রিকায় কী প্রকাশ হবে, না হবে সেটা নির্ধারণের ক্ষমতা সম্পাদকীয় বোর্ডের। চাইলে তারা এই বিজ্ঞাপন প্রকাশ নাও করতে পারতেন। তারা বা তাদের অনেকেই সে সিদ্ধান্ত নেননি কারণ রোজিনা ইসলাম ইস্যুতে যেখানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং সাংবাদিক ও সংবাদপ্রতিষ্ঠান মুখোমুখি অবস্থায় রয়েছে বলে ধারণা অনেকের তখন এই বিজ্ঞাপন প্রকাশ না করলে গণমাধ্যমের চরিত্র ও পেশাদারিত্বের প্রসঙ্গ সামনে চলে আসত। এই পেশাদারিত্ব প্রসঙ্গ এসেছে যেখানে সচিবালয়ে কর্মরত সাংবাদিকদের একাধিক সংগঠন সংবাদ সম্মেলন বর্জন করেছে সেখানেও। আগেও বলেছি ওটা নির্দিষ্ট ঘটনায় নির্দিষ্ট সাফাই-অনুষ্ঠানের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া, যার রেশ দীর্ঘমেয়াদি হয় না, হবেও না বলে ধারণা করি।
সাংবাদিকরা দাবি আদায়ে নানা সময়ে নানা ঘটনায় সংক্ষুব্ধ হতে পারেন কিন্তু পেশাদারিত্বের প্রশ্নে তারা তাদের সাংবাদিকতা পেশার গৌরব ও চরিত্রকে সমুন্নত রাখবেন এটাই স্বাভাবিক। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাফাই সংবাদ সম্মেলন বর্জন মানে স্থায়ীভাবে ওই মন্ত্রণালয় বা সরকারের সংবাদ বর্জন নয়। এটা একদিকে যেমন অসাধ্য তেমনি অন্যদিকে এর চেষ্টাও অনুচিত। আমার ধারণা এইধরনের প্রচেষ্টা হবেও না।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলন বর্জন করে তাদেরই বিজ্ঞাপন প্রচারকে অনেকে গণমাধ্যমের ‘অর্থের লোভ’ বলে চিত্রিত করতে চেয়েছেন। হ্যাঁ, এই বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে গণমাধ্যমগুলো কিছু অর্থ পাবে এবং সেটা সরকারের কাছ থেকেই। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর (ডিএফপি) দেশের গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন বিষয়ক সিদ্ধান্তগুলো দিয়ে থাকে। ডিএফপির তালিকাভুক্তরা যে বিজ্ঞাপন পায় সেখানে কোন গণমাধ্যম কর্তৃপক্ষ অন্যথা করার সাধ্য কি রাখে? প্রশ্নটা কঠিন এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংশ্লিষ্ট হলেও বাস্তবতাকে অস্বীকার করার সাধ্য নাই।
গণমাধ্যম ও সরকার পরস্পরবিরোধি সত্ত্বা নয়। এখানে এক পক্ষ অন্য পক্ষের মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ নেই, চেষ্টা করাও উচিত নয়। ব্যক্তি কোনো ঘটনায় সংক্ষুব্ধ হতে পারেন কিন্তু প্রতিষ্ঠান সেটা পারে না। এটা করার চেষ্টা হলে প্রথা-প্রতিষ্ঠান আদতে বিলুপ্ত হয়ে যায়। গণমাধ্যমের মত দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের এখানে যে দায়িত্বশীলতা দেখানোর দরকার সেটাই দেখিয়েছে। গণমাধ্যম সংবাদ তৈরি করে না, পরিবেশন করে। এই পরিবেশনার সঙ্গে জনস্বার্থ যেখানে জড়িত সেখানে সে দায়িত্ব পালন করে থাকে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ আরও কিছু দায়িত্বশীলের দায়িত্বশীলতাকে এড়িয়ে যাওয়ার যে প্রবণতা সেটার বিপরীতে গণমাধ্যম বদলা নেওয়ার কথা ভাবেনি। এখানে গণমাধ্যম তার দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে। কঠিন পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমের এই ভূমিকা উল্লেখের দাবি রাখে।
দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সচিবালয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠানের একজন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক অবৈধভাবে আটকে থাকা সত্ত্বেও দেরি করে সংবাদ প্রকাশ করেছে প্রথম আলো। এনিয়ে এক পক্ষের সমালোচনার জবাবে বলা যায়, একজন সাংবাদিক অবৈধভাবে আটকে রাখার বিষয়টি প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্রেফ প্রথম আলোর বিষয় ছিল না, এটা ছিল দেশের সাংবাদিকতার ওপর আঘাত। এই আঘাতের জবাব তাই এককভাবে একটি প্রতিষ্ঠানের দেওয়ার দরকার ছিল না। প্রথম আলোর সেই অপেক্ষা, দেরিতে সংবাদ প্রকাশের ঘটনায় দেশের সাংবাদিকরা নিজেদের পেশার একজনের এমন অবস্থাকে অস্তিত্বের সঙ্কট হিসেবে দেখেছে বলেই আজ রোজিনা ইসলাম কেবল প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকই নন, তিনি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে বিরাজমান প্রতিকূলতার মুখে ঋজু হয়ে দাঁড়ানো এক অগ্রসেনানী রূপে পরিচিত হয়েছেন। সংবাদ প্রকাশে তাড়াহুড়ো হলে এসবের কিছুই হতো না। এটাও অন্য অনেক সাংবাদিক নিগ্রহের ঘটনার মত আরেক ঘটনা হিসেবেই প্রতিপন্ন হতো। এখানে প্রথম আলো কর্তৃপক্ষের ধৈর্যের যে প্রকাশ ঘটেছে তার ইতিবাচক ফল কেবল তারাই এককভাবে পাবে না, এর সুফল ভোগ করবে দেশের সাংবাদিক সমাজও।
রোজিনা ইসলাম চারদিন ধরে কারাগারে রয়েছেন। এই চারদিন তার জীবন থেকে হারিয়ে গেলেও এর ইতিহাসমূল্য রয়েছে। কঠিন এই সময়, তবু বলছি এটা অতিঅবশ্যই ইতিবাচক সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
- ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১: জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ’
- সুনীল অর্থনীতি ও রূপকল্প-২০৪১
- শিক্ষার ধরন ও বেকারত্ব: দেশে অশিক্ষিতদের চেয়ে শিক্ষিত বেকার ৩ গুন
- ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়
- ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস-১৯৬১ ও দ্বিপক্ষিয় কূটনীতিক সম্পর্ক
- মিডিয়ার শক্তি বা আসক্তি: ম্যাজিক বুলেটের বাকের ভাই ও বদি
- গণমাধ্যমে গণরুচির বিকার
- হালকা বিনোদনের প্রাধান্যে সংস্কৃতির অবনতি
- বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণার দিন শেষ, চার উপায়ে মধ্য আয়ের দেশ