মঙ্গলবার   ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ || ১০ পৌষ ১৪৩১ || ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

কেন পড়া উচিত ‘সাতকাহন’

মেহেরাজ জেবিন ইফতি

১৮:৩৮, ৩০ জুন ২০২২

৫৫৪১

কেন পড়া উচিত ‘সাতকাহন’

সমরেশ মজুমদারের প্রতিটি লেখায় নতুনত্ব পাই। তবে তার লেখার প্রতি নিগুঢ় টান সৃষ্টি হয়েছে ‘সাতকাহন’ পড়ে। যে একবার সাতকাহন পড়ে ফেলেছে সে কিছুতেই একে নিয়ে না ভেবে পারবে না। এমনকি, বইটি পড়ুয়া যাদেরকে এই বই সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছে তাদেরকে সবসময় দেখা গেছে সাতকাহনের প্রতি আবেগপ্রবণ হয়ে উঠতে। তারা প্রায় সবাই-ই একটি বিষয়ে একমত হয়েছে যে, প্রতিটি মেয়েরই অন্তত একবার হলেও সাতকাহন পড়াই উচিত।

কিন্তু এ বইয়ের নাম কেন সাতকাহন হলো! সে বিষয়ে চিন্তা করার পরে একটি উত্তর মাথায় এলো, বইটি আপাতদৃষ্টিতে একটি নারীকে মূখ্য ভূমিকায় রাখলেও এখনো পর্যন্ত প্রায় সকল নারীর জীবনের গল্পের সুরকেই ফুটিয়ে তোলে সাতকাহন। তাই হয়তো লেখক একে সাতকাহন নাম দিয়েছেন। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে কেন পড়া উচিত সাতকাহন? কেনইবা এই বিশেষ বইটির ওপর এতটা গুরত্ব দেয়া হয়েছে!

চারদিকে তাকালেই দেখতে পাবেন একবিংশ শতাব্দীতে এসেও একটি মেয়েকে আজও ‘মেয়েছেলে’ হিসেবেই বেশি বিবেচনা করা হয়। মেয়েরা মানুষ আর হয়ে উঠতে পারলো না বইকি। মেয়েদের মানুষ হয়ে ওঠা বিষয়টি মাথায় আসলেই কেন যেন চিত্রনায়িকা শাবানার সেই, ‘মেয়েরাও মানুষ’ চলচ্চিত্রের নাম মনে পড়ে যায়। লোকমুখে এই সিনেমা নিয়ে কম ঠাট্টা-তামাশা শুনিনি। অনেক ডিগ্রিধারী তথাকথিত শিক্ষিত ভদ্রলোককেতো এও বলতে শুনেছি, মেয়েদেরও আজকাল নাকি মানুষ হওয়ার সাধ জাগে। সত্যি বলতে এই যে মেয়েদের এই মানুষ হওয়ার লড়াইটা সেটা আজকের বা একদিনের নয়। যুগ যুগ ধরেই এটি চলে এসেছে। সৃষ্টির শুরু থেকে হয়ে আসা এই লড়াই কালের বিবর্তনে এসে আজও খুব একটা পরিবর্তিত হয়নি।

আজও মেয়েদের সেই প্রাচীন যুগের মতো যুদ্ধ করেই টিকে থাকতে হয়। হতে পারে ধরনটা খানিকটা আলাদা। কিন্তু এটাই সত্যি যে প্রত্যেকে মেয়েই আলাদা গল্প নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতেও হয়তো, হয়তোই বা বলছি কেন! নিশ্চয়ই পরবর্তিকালেও একটা মেয়েকে নিজের মতো করে বাঁচতে চাইলেই বন্ধুর পথ ধরেই এগোতে হবে। কিন্তু এর জন্য মাঝে মাঝে দরকার পড়ে অনুপ্রেরণা বা মোটিভেশন। যদিও বর্তমানে মোটিভেটরদের সংখ্যা এত বেশি এবং আমাদের শোনার সময় এত কম যে মানুষ মোটিভেশনকে বস্তাপঁচা আবর্জনার মতোই অগ্রাহ্য করে। তবুও বলি কখনোসখনো সবারই দরকার হয় একটুখানি মোটিভেশনের বা গাইডলাইনের। জানা কথাগুলোই পুনরায় শোনা গেলে হঠাৎই পরিবর্তন এনে মানুষকে চাঙ্গা করে দিতে পারে।

এবার আসা যাক সাতকাহন উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনায়। কেন সাতকাহন অভিনব তা বুঝতে হলে একটুআধটু ধারণা তো দেয়াই যেতে পারে। সাতকাহন উপন্যাসটিতে বিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে পুরুষশাসিত সমাজে নারীর দুর্বিষহ অবস্থান তুলে ধরার পাশাপাশি আরও প্রকাশ পেয়েছে নারীবাদী চেতনা। তবে এই চেতনা যে টিপিক্যাল নারীবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অনেকটাই ভিন্ন ধরনের তা বইটি পড়লেই যে কেউ আন্দাজ করতে পারবেন। দীপাবলি, সাতকাহনের মুখ্য চরিত্র, যে জলপাইগুড়ির চা বাগানে বড় হওয়া এক কিশোরী, যার জীবনের উত্থানপতনের গল্প নিয়েই লেখা হয়েছে এই সাতকাহন। আপোষহীন-সংগ্রামী এই নারী চরিত্র নিঃসন্দেহে সমরেশ মজুমদারের অন্যতম সেরা সৃষ্টি। যা পড়ে এখনো পর্যন্ত কেউ পরিশ্রান্ত হয়নি, বরং শিখতে পেরেছে অনেক বেশি কিছু।

ছোট্ট করে বলতে গেলে, একজন নারী হিসেবে আপনার একটি মেয়ের নারী হয়ে ওঠার এই উপাখ্যানটি অবশ্যই পড়া উচিত। আর পুরুষ হিসেবে আপনি যদি এই উপন্যাস পাঠ করেন, তবে অবশ্যই বলতে হবে, নারীকে অসম্মান করার আগে দ্বিতীয়বার ভাবতে বাধ্য হবেন। সুতরাং সবারই, বিশেষ করে প্রত্যেক নারীরই এই বইয়ের স্বাদ চেখে দেখা উচিত। একটি সহজ সারল্যে ভরা মেয়ে কীভাবে কাঠিন্যের খোলসের মাঝে আবৃত হয়ে ওঠে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন সমরেশ মজুমদার।

উপন্যাসের সার্বিক পর্যালোচনা করে এর পাঠকের পাঠানন্দ নষ্ট করতে রাজি নই। তাছাড়া এই বইয়ের ওপর এ অবধি মোটামুটি কমবেশি অনেকগুলো পুস্তক পর্যালোচনা করা হয়ে গিয়েছে। তাই একই কথা বারবার আলোচনা করে পাঠকের বিরক্তির কারণও হতে চাই না।

সাতকাহন কোন বিষয়কে নির্দেশ করে? সাতকাহন উপন্যাসটিতে বিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে পুরুষশাসিত সমাজের নারীর অবস্থান তুলে ধরার পাশাপাশি প্রকাশ পেয়েছে প্রবল নারীবাদী চেতনা। প্রোটাগনিস্ট দীপাবলি জীবনের বন্ধুর পথ কীভাবে আপোষহীনভাবে সাফল্যের সাথে জয় করেছে তারই রূপায়ণ হলো সাতকাহন। এ হলো চিরচেনা পুরুষশাসিত সমাজের বিরুদ্ধে লড়াকু যোদ্ধার গল্প। যে গল্প আজও হাজারও মেয়ের জীবনকে যাপন আবার উদযাপন দুটোই করতে উদ্বুদ্ধ করে। নারীশিক্ষা বিষয়টি যে কতোটা গুরুত্ববহন করে বলতে গেলে তার জলজ্যান্ত উদাহরণ রয়েছে সাতকাহনে।

দীপাবলী ছাড়াও আরও অনেকগুলো নারী চরিত্র এসেছে উপন্যাসটিতে। যাদের বুদ্ধিদীপ্ত টিকে থাকার লড়াই সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। যেমন ধরুন দীপাবলি, রমলা সেন আর মায়ার আধুনিকতা দেখে হয়তো বর্তমানের অনেকের চিন্তা-চেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে হয়। এমনকি দীপাবলীর ঠাকুমা মনোরমা সেকালের মানুষ হয়েও অনেকের চেয়ে আধুনিকতার পরিচয় দিয়েছেন। চা বাগানকে ঘিরে যাদের জীবিকা, তাদের জীবন সম্পর্কে চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায় বইটিতে। বর্ণনাগুলো এতই নিখুঁত যে, কল্পনাপ্রবণ পাঠকের পড়ার সময় চা বাগানে ঝির ঝির করে বৃষ্টি পড়ার ছবি দেখাটাও অসম্ভব নয়। মনে হবে চোখের সামনে ভাসছে অন্য ধরনের এক জীবন। পঞ্চাশের দশকে ভারতে এমন অনেক জায়গা ছিল, যেখানে তখনও বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। এই উপন্যাসের চা বাগানটিও সে ধরনের একটি জায়গা যেখানে আধুনিক সভ্যতার পদচারণা সবে শুরু হয়েছে।

এ উপন্যাসের বিশেষত্ব হলো, সমরেশ মজুমদার নিজে একজন পুরুষ হয়েও নারীর দুর্গম পথ চলা সুস্পষ্ট ভাবে সেই বিংশ শতাব্দীতে মানুষের সামনে উন্মোচন করেছেন। যা কোনো লেখক তখন চাইলেই পারতো কিনা কে জানে! তিনি দেখিয়েছেন সমাজের ঘুণেধরা সংস্কারের বিরুদ্ধাচরণ করে সমাজে কীভাবে নিজের অবস্থান তৈরি করেছে এক নারী। যেমন, তিনি লিখেছেন, “তুমি যদি জিততে চাও তাহলে তোমাকে নির্মম হতে হবে। অভিযানে বেরিয়ে দলের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে অভিযান বাতিল হয়না, অসুস্থকে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। সেই উপায় না থাকলে তাকে ফেলে রেখেই এগোতে হবে। এক্ষেত্রে দয়ামায়া ইত্যাদি ব্যাপারগুলো খুবই প্রতিবন্ধকতা তৈরী করে। কোনও কোনও মানুষ জীবনের নির্দিষ্ট লক্ষে এগিয়ে যাওয়ার সময় এমনই কঠোর হন। তাদের নিষ্ঠুর বলা হয়। ইতিহাস ওইসব মানুষের জন্য শেষ পর্যন্ত জায়গা রাখে।” এভাবেই সাধারণ শব্দের সোজাসাপটা ব্যবহার করেই উপন্যাসটিকে তিনি পাঠকের মনে গেঁথে দিতে সক্ষম হয়েছেন। সাধারণের মাঝেই দীপাবলিকে গল্পের মাঝে  অসাধারণ করে চিরঞ্জীব করে রেখেছেন।

গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার চরিত্রের বিকাশ এবং জীবনবোধের পরিবর্তন গল্পটিকে অন্য এক রূপ দিয়েছে। বাংলার প্রতিটি নারীই আজও দীপাবলির মাঝে অল্প হলেও নিজেকে খুঁজে পাবে কিংবা নিজের মাঝে দিপাবলীর ছাপ দেখতে পছন্দ করবে। কেউ হয়তো ঘুরে দাঁড়াতে শিখেছে। আপোষহীন ভাবে ‘হ্যাঁ’ কে ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ কে ‘না’ বলতে শিখেছে। নিজের ওপর হয়ে যাওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে পেরেছে। পুরুষেরাও এ উপন্যাস পড়লে নিশ্চিতভাবে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিতে আমূল পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবেন যা বর্তমান সমাজে সবচেয়ে বেশি করে প্রয়োজন।

সুতরাং বলা বাহুল্য যে চরিত্রটি প্রবল স্বকীয়তায় পরিপূর্ণ। লোভ, ঘৃণা, প্রেম, রিপুর তাড়না, বাঁচার ইচ্ছে, উচ্চাকাঙ্ক্ষা; সবমিলিয়ে সৃষ্টি হয়েছে সমরেশ মজুমদারের দীপাবলী। দুই খণ্ডের বিশাল উপন্যাসটি পড়তে পাঠকদের কখনওই একঘেয়েমি লাগবে না কারণ তারা কয়েক পৃষ্ঠা পড়েই দীপার জীবনের সাথে পরিচিতি অনুভব করবেন। কেউ কেউ তো এক বসায়ই একেকটি খণ্ড শেষ করে ফেলেন। এ বই পড়ার সময় মনে হয় জীবন্ত একটি চলচ্চিত্র চোখের সামনে প্রদর্শন হচ্ছে যা অতীত এবং বর্তমানকে কাটছাঁট করে ভবিষ্যৎটাকে মোহনীয় সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে গড়ে তোলে।

তবে বইটি পড়ে এ কথা না বলে পারছি না যে সবারই এই বই পড়া উচিত হলেও সবার সবটুকু গ্রহণ না করাই ভালো। শেষ মুহূর্তে মনে হবে, আত্মসম্মান চূড়ায় উঠতে উঠতে খানিকটা আত্ম-অহংবাদে রূপ নিয়েছে। যার ফলে ব্যক্তির চারপাশে একটি অদৃশ্য দেয়াল নিজের অজান্তেই গড়ে ওঠে, যা সুস্থ স্বাভাবিক জীবন কাটানোর পথে অন্তরায় হয়ে যায়। এটাও সাতকাহনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা যে, সাহসী হওয়া অবশ্যই ভালো কিন্তু অতিরিক্ত সাহসও আবার জীবনে ভয়ংকর বৈপরীত্য নিয়ে আসতে পারে।

 মেহেরাজ জেবিন ইফতি: লোকাল মিডিয়া হাব ফেলো, ডয়চে ভেলে অ্যাকাডেমি এশিয়া।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank