তবু দর্শক কেন দেশি টিভি চ্যানেল দেখছেন না?
তবু দর্শক কেন দেশি টিভি চ্যানেল দেখছেন না?
গত পহেলা অক্টোবর থেকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বিজ্ঞাপনসহ প্রচারিত বিদেশী চ্যানেলগুলো। সরকার এই ব্যবস্থাকে বলছে ক্লিন ফিড। ক্লিন ফিডের ক্লিন চিট নিয়ে বাংলাদেশের টিভি মালিকদের সংগঠন ও কেবল অপারেটররা কার্যত মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে অতি শক্তিশালী এই সরকারের কোন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অধিকাংশ সময় ক্ষোভ থাকলেও যেমন কেউ একটা আন্দোলনের সাহস করেন না, এই ঘটনার ক্ষেত্রেও কেবল অপারেটরদের অসন্তোষ থাকলে তেমন একটা উচ্চবাচ্য করার সাহস দেখাচ্ছেন না। নৈতিকভাবে সাহস দেখানোর সুযোগও নেই। সরকার তাদের পর্যাপ্ত সময়ই দিয়েছিল। তাছাড়া আশেপাশের ছোট দেশগুলোতেও ক্লিনফিড কার্যকর রয়েছে।
সরকারের এই সিদ্ধান্তে কেবল অপারেটররা যতোটা আহত, বিপরীতে ততটাই আহ্লাদিত টিভি মালিকরা। বাংলাদেশী টিভি মালিকরা ভাবছেন বাংলাদেশের স্যাটেলাইট আকাশ এখন শুধু তাদের টিভিময় রবে, সাধারণ মানুষ শুধু তাদের টিভিই দেখবে। তারা প্রচুর টিভি বিজ্ঞাপন পাবেন। ফুলে ফেঁপে উঠবেন। গনমাধ্যমে বিভিন্ন বক্তব্যে দেখলাম এই টাকার পরিমান প্রায় বারশো কোটি টাকার মতো হতে পারে। সব টিভি চ্যানেল সারা বছর মিলে মিশে বারশো কোটি টাকা আয় করবেন। বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে আনন্দে হাসি খুশীতে কাটাবেন। আয়ের টাকা দিয়ে টিভি কর্মীরা যমুনায় শপিং করবেন, বসুন্ধরায় আইসক্রিম খেতে খেতে সিনেমা দেখবেন! সত্যিই কি বিষয়টা বাংলাদেশী টিভি কর্তৃপক্ষেরে জন্য এতোটা আহ্লাদের?
এই লেখা যখন লিখছি তদ্দিনে ক্লিন ফিডের টেলিভিশনে পুরো বাংলাদেশ প্রায় একসপ্তাহ কাটিয়ে দিয়েছে। এই এক সপ্তাহ বাংলাদেশের মা খালারা জি-বাংলা, স্টার জলসা না দেখেই কাটিয়েছেন। তারা এই সময়ে প্রায় চল্লিশটি বাংলাদেশী চ্যানেল দেখেছেন? আসলেই তারা কতোটা দেখেছেন? অন্য অনেকের মতো আমিও এই বিষয়ে কৌতুহলী ছিলাম। সম্পর্কে আমার নানী, যিনি বয়সভারে নুহ্য ও আজিমপুরে থাকেন, দিনের প্রায় সবটা সময় জুড়ে ভারতীয় বাংলা চ্যানেল দেখে কাটান, তিনি এখন কী দেখছেন? কিংবা আমার মা বা খালা যারা ফেনীর বিভিন্ন গ্রামে থাকেন, যেখানো ডিশ সংযোগ রয়েছে, তারা এই সাতদিন কী দেখেছেন? তাদের কাছে কী বাংলাদেশী টিভি চ্যানেলগুলো পৌঁছুতে পেরেছে? প্রত্যেক আগ্রহী মানুষ তার বয়োবৃদ্ধ স্বজন, অবসরে যারা দিনের একটি বড় অংশ টিভি দেখে কাটান, তাদের নিয়ে কিছুটা চিন্তিত ছিলেন।
মজার বিষয় হচ্ছে এই সাতদিনে তারা কিছু বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজে বের করেছেন। তাদের অনেকেই পুত্র কন্যা বা নাতি নাতনীর সহযোগে স্মার্টফোনে ইউটিউবসহ বিভিন্ন মাধ্যমের সাথে পরিচিত হয়ে গিয়েছেন। এটা যে জি-বাংলা বা স্টার জলসার প্রতি অনুরাগ, তা-ই একমাত্র কারণ নয়। বরং, বাংলাদেশী চ্যানেলগুলো কোনভাবেই মানুষের বিনোদনের উৎস হয়ে উঠতে পারছে না। যত সমালোচনাই করি না কেন বাংলাদেশে সরকারী টিভি চ্যানেল ‘বিটিভি’ ছাড়া আর কোন চ্যানেলরই কোন বিশেষত্ব নেই, বিশেষ কোন অনুষ্ঠান নেই। খেলার একটি চ্যানেল ও একটি গানের চ্যানেল অবশ্যি ব্যতিক্রম। এছাড়া সব চ্যানেলই যেন একই। দিনের সূচীতে কয়েকটা টকশো, দুই তিনটা নাটক, আর সংবাদ, সংবাদ এবং সংবাদ। সব চ্যানেল নির্বোধের মতো একে অপরকে কপি করছে। এগুলো দর্শক কোনভাবেই টানছে না। তরুণ তরুণীদের না, মা খালাদেরও না।
টিভি দর্শকদের সাথে কথা বলে আরেকটা জিনিস জানা গেলো, তারা বাংলাদেশী টিভি নাটকের জগাখিচুড়ী ভাষাকে একেবারেই নিতে পারছেন না। একই নাটকে একেকজন একেক ভাষায় কথা বলছেন! দুএকজন বলছেন, এতদিন তারা এই উদ্ভট জিনিসটা আগে কখনো খেয়ালই করেন নি! বাংলা ভাষা বাংলাদেশের নাটকে পঁচে গিয়েছে, তা এখন দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। অথচ একসময় নাটকের ভাষা ছিল প্রমিত। উচ্চারণ ছিল শুদ্ধ। কিন্তু এখন নাটকের দশটা চরিত্র থাকলে তারা কুড়ি রকমের ভাষায় কথা বলেন।
এছাড়া ডায়ালগগুলো খুব নিম্নমানের, মঘজহীন মাথায় লেখা হয়। চায়ের দোকানে বা আড্ডায় যেভাবে কথা বলা হয়, তেমন সরল সস্তা কথাগুলো গরগর করে টিভিতে উচ্চ শব্দে বললেই সেটা নাটক হয়ে যায় না। নাটকের ডায়ালগ মানুষকে টানতে হয়, তাতের চিন্তার খোরাক থাকতে হয়। বাংলাদেশী নাটকে সেই দামী ডায়ালগ ও ভারী চরিত্র এখন কই? দুটো পয়সার জন্য অভিনেতারা এখন সারাদিন ভাড়ামী করেন এবং সেই একই গৎবাঁধা অভিনয়। প্রশ্ন হতে পারে, তাদের নাটক দেখে কে? কলাকুশলীরা নিজেরা নিজেদের নাটকের দর্শক, তারাই দেখেন। একে ওকে নাটক দেখার অনুরোধ জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেন। তাতে কেউ দেখে, কেউ দেখে না। এখনকার নাটকগুলো বিয়ের ভিডিওর সাথে তুলনা করা যায়। বিয়ের ভিডিও বর কনের আত্মীয় স্বজন ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব সার্কেল দেখে থাকে। অন্যরা দেখেনা।
বাংলাদেশী টিভি চ্যানেলগুলোর আরেকটি প্রবণতা হচ্ছে সংবাদ জানানোর তাড়াহুড়ো। টিভি পর্দার প্রায় এক তৃতীয়াংশ জুড়ে থাকে নিউজ স্ক্রল। দর্শক অনুষ্ঠান দেখবে, নাকি স্ক্রলে সংবাদ পড়বে? দর্শকের মন টিভির মূল অনুষ্ঠানে গেঁথে ফেলার চেষ্টাতো করতে হবে। একজন মানুষের মনস্বত্ব বাংলাদেশী টিভি অধ্যক্ষরা বোঝেন না। অনেক টিভি চ্যানেল শুধু নাটক ও নিউজ স্ক্রল দিয়ে ক্ষান্ত হননা, টিভির এক কোনায় খেলার লাইভ স্কোরও দিয়ে দেন! টিভি তাদের কাছে মাছ ধরার ফাঁদের মতো। তারা ফাঁদে সব দর্শক ধরতে চান।
খেলার স্কোর দেখার জন্য খেলার চ্যানেল আছে। নিউজ স্ক্রল দেখানোর জন্য নিউজ চ্যানেল আছে। তাদের কাজ তাদেরকে করতে দেয়া হোক। যিনি বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান দেখাবেন তিনি তা না দেখিয়ে নিউজ ও খেলার স্কোর দেখাচ্ছেন। তথ্যমন্ত্রী মহোদয় মনে হয়, এই বিষয়টাতেও মন দিতে পারেন। দর্শক কতোটা ঠকছেন, কতোটা পাচ্ছেন তিনি তাও দেখা উচিত। রাষ্ট্র যখন কোন টিভি চ্যানেলকে লাইসেন্স দেন তারা কী কী অনুষ্ঠান দেখাবেন তারও অনুমোদন দেন। যিনি নাটক সিনেমা দেখাবেন, তিনি কেন সংবাদ দেখাচ্ছেন তাও রাষ্ট্রের দেখা উচিত। কোন চ্যানেল নাটক, গান, খেলা, সংবাদ মিলিয়ে জগাখিচুড়ি দেখানোর অনুমোদন পেয়ে থাকলে তাও এখন পুনঃনির্ধারণ করা উচিত। এতে পেশাদারিত্ব বাড়বে।
ক্লিন ফিড কার্যকর হচ্ছে তা টিভি মালিকরা আগে থেকেই জানতো। ক্লিন ফিড বাস্তবায়ন হওয়ার সময়টুকুতে বিদেশী চ্যানেলের শুন্যস্থান পূরণে কোন চ্যানেলকে নুন্যতম চেষ্টা করতেও দেখা যায়নি। এই শুন্যসময়ে একটা চ্যানেলও নতুন আঙ্গিকে নিজেদের ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করেনি। তারা ভেবেছে বিদেশী চ্যানেল না চললে তাদের চ্যানেল এমনিতেই দর্শক দেখবে। কেন হে বাপু, দর্শকের কী এতো ঠেকা পড়েছে?
ক্লিন ফিড করে দেয়ার দাবীতে গত সাত দিন মূলত বাংলাদেশী টিভি চ্যানেলগুলো মনোপলি বাজারের সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু তাতে লাভ কার? বরং লসই হলো। দর্শক এখন বাংলাদেশী টিভি চ্যানেলগুলোর প্রতি বিরক্ত হওয়ার সব কারণ খুঁজে খুঁজে বের করছে এবং বিরক্ত হচ্ছে। বিকল্প হিসেবে মা খালার ইউটিউব বা জিফাইভ এর সাথে পরিচিত হচ্ছে। বিজ্ঞাপন এখন ইউটিউবে চলে যাবে। তামিল, তেলেগু বা মালায়লাম সিনেমায় ইউটিউব বাংলাদেশী বিজ্ঞাপন দেখাবে। বাংলাদেশী টিভি চ্যানেলগুলো নিশ্চয়ই তখন বলবে, হে ইউটিউব তোমরাও ক্লিন ফিড হয়ে যাও।
সরকারের রাজস্ব আয়ের জন্য ক্লিন ফিড উপকারী কিছু হতে পারে কিন্তু বাংলাদেশী টিভি মালিকদের জন্য ক্লিন ফিডে খুশী হওয়ার কিছুই নাই। অন্তত যতক্ষন না তাদের টিভি চ্যানেলগুলো গুণগত বিনোদন সম্পন্ন না হয়। অখাদ্য হতে বাঁচার জন্য মানুষ একটা না একটা বিকল্প খুঁজে বের করবেই। বিজ্ঞাপনও সেদিকে প্রবাহিত হবে। ব্যবসায়ীরা দানছত্র খুলে বসেননি যে, তারা অখাদ্য টিভি অনুষ্ঠানের জন্য স্পন্সর করবে। তারা তাদের পণ্যের সঠিক প্রচার চাইবে। এখন ডিজিটাল যুগ। পণ্যের প্রচারে বহু জানালা খোলা, আকাশে বহু পর্দা সাঁটানো।
ক্লিন ফিড শেষে বিদেশী চ্যানেলগুলো শুদ্ধ হয়ে হয়তো ফিরে আসবে। কিন্তু তদ্দিনে দেশী বিপণনকারীরা তাদের পণ্যের তথ্য গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিতে নতুন নতুন প্রচার ক্ষেত্র অনুসন্ধান করবেন। নতুন মাধ্যমগুলো দেশী টিভি চ্যানেলে নতুন প্রতিদ্বন্ধী হয়ে পড়বেন। তখন বিজ্ঞাপনের জন্য আরো আরো মাধ্যমের সাথে প্রতিযোগীতা করতে হবে। আর তাতে তখন কিংবা এখন, এগিয়ে থাকার একটাই মন্ত্র, টিভি অনুষ্ঠানের মান উন্নত করা। সস্তা ও অখাদ্য আয়োজন বাদ দিয়ে কিছু সুখাদ্য তৈরী করতে হবে।
লেখক: মনোয়ার রুবেল। ফ্রিল্যান্স রাইটার ও কলাম লেখক।
Email: [email protected]
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
- ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১: জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ’
- সুনীল অর্থনীতি ও রূপকল্প-২০৪১
- শিক্ষার ধরন ও বেকারত্ব: দেশে অশিক্ষিতদের চেয়ে শিক্ষিত বেকার ৩ গুন
- ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়
- ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস-১৯৬১ ও দ্বিপক্ষিয় কূটনীতিক সম্পর্ক
- মিডিয়ার শক্তি বা আসক্তি: ম্যাজিক বুলেটের বাকের ভাই ও বদি
- গণমাধ্যমে গণরুচির বিকার
- হালকা বিনোদনের প্রাধান্যে সংস্কৃতির অবনতি
- কেন পড়া উচিত ‘সাতকাহন’