সারাহ বেগম কবরী: মেজাজী ও মানবিক
সারাহ বেগম কবরী: মেজাজী ও মানবিক
আমি যখন কম বয়সে বাংলা সিনেমা দেখা শুরু করি তখন বেশি বয়সের কারণে হোক বা অন্য কোনো কারণে হোক চিত্র নায়িকা কবরীর ক্যারিয়ার একটু পড়তির দিকে, আর ববিতা মধ্যগগনে। ববিতাই আমার প্রিয় চিত্রনায়িকা ছিলেন। তবে বড় হতে হতে দেখলাম সিনিয়রদের মধ্যে, এমনকি পত্র-পত্রিকায় কবরীর কদর বেশি। যা হোক বয়স বাড়তে বাড়তে আমারও ববিতা-বায়াস অনেকখানি কমে আসে। আর পরে কবরীর সঙ্গেই কিছু দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। ববিতা-শাবানা প্রমুখ দূরের জগতের অচেনা মানুষই থেকে গেছেন, চিত্রজগতের মানুষেরা যেমন হন। আর কবরীর ছবিগুলোও পরে অনেক দেখেছি। তিনি হয়তো ববিতার মতো গর্জিয়াস নন, তবে তার মতো সাবলীল অভিনেত্রী আর একজনও ছিলেন না। ববিতা যদি সত্যজিত রায়ের ছবিতে অভিনয় করে নাম কুড়ান, তবে কবরীও ছিলেন ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্রের অভিনেত্রী।
আরও পড়ুন: মিনা পাল থেকে ‘কবরী’ রূপে আত্মপ্রকাশের গল্প
কবরীকে সামনাসামনি দেখি ২০০৫ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগে আমাদের এমসিজে ফিল্ম ক্লাব, (যে-সংগঠনটি আমি প্রতিষ্ঠা করি) ও অ্যামিক-বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে জনসংস্কৃতি হিসেবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে ধরে নিয়ে দিনব্যাপী আড্ডা ও সেমিনার হয়। সিনিয়র সহকর্মী গীতিআরা নাসরীন আপার উদ্যোগই এক্ষেত্রে প্রধান ছিল। বাংলাদেশের মূলধারার চলচ্চিত্র তখন ঘোর সঙ্কটে। ওই সময়ে এই সেমিনারটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একাডেমিয়ায় এভাবে বাংলা জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নিয়ে, সম্ভবত তেমন আলোচনা হয়নি আগে। একটা সেশনে আমি আর কবরী পাশাপাশি বসেছিলাম।
অনেকদিন পরে, ২০১৬ সালে এশীয় চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করে এমসিজে ফিল্ম ক্লাব। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাজ্জাক-কবরী আসবেন। প্রথম আলো অনুষ্ঠানের দিন সংবাদ করলো, একমঞ্চে রাজ্জাক-কবরী। তবে রাজ্জাক সেদিন আসেননি। এবার অবশ্য আমি মঞ্চে ছিলাম না, দর্শক সারি থেকে তাকে দেখা হলো। আমার দায়িত্ব ছিল চলচ্চিত্রকার মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে আনার। অন্যদের দায়িত্ব ছিল রাজ্জাক-কবরীকে সসম্মানে টিএসসি অব্দি নিয়ে আসা। রাজ্জাককে আনতে ব্যর্থ আয়োজকদের একজন মুচকি হেসে বললো, কবরীকে নিয়ে রাজ্জাকের পরিবারে বৃদ্ধবয়সেও সমস্যা রয়ে গেছে। প্রথম আলোর সকালের সংবাদের কারণে একটু ঝামেলাই হয়েছে মনে হয়। সত্যি-মিথ্যা জানিনা, তবে মুচকি-হাসা আয়োজকের ওই পরিবারের সদস্যদের সাথে ফোনে ফলো-আপ করতে করতে এরকম মনে হয়েছে।
আরও পড়ুন: চলে গেলেন কিংবদন্তী অভিনেত্রী কবরী
২০১৭ সালে কবরীকে আমি ফোন করি একটি কাজের সূত্রে। পরিচয় দিয়ে ফোন করার কারণ বললাম। প্রেক্ষাপটটা এরকম: প্রথম আলো হঠাৎ আমাকে একটা দায়িত্ব দেয়। পরিচালক আমজাদ হোসেন ও ‘আয়নাবাজি’ করে আলোচিত অমিতাভ রেজা মুখোমুখি বসবেন, আমি দুই প্রজন্মের দুই চলচ্চিত্রকারকে নানান প্রশ্ন করবো। মূল আইডিয়া হলো দুই প্রজন্মের দুই পরিচালক বিপরীত প্রজন্মকে মূল্যায়ন করবেন, আমার ভূমিকা সূত্রধরের। কাজটা করে আমি মজা পেলাম। এখান থেকে একটা আইডিয়া মাথায় এলো। এরকম আরো কয়েকটা ইন্টারভিউ করবো, দুই প্রজন্মের দু’জনের। কবরী-মৌসুমী, রাজ্জাক-শাকিব খান বা ফেরদৌস… বা সিনিয়র চলচ্চিত্র প্রযোজক বনাম এই প্রজন্মের প্রযোজক ইত্যাদি। এভাবে সাক্ষাৎকারভিত্তিক একটা বই হবে। একজন কো-অথরের সঙ্গে আলাপ চূড়ান্ত করলাম। দু’জন ভাগ-বাঁটোয়ারা করে বা একসঙ্গে ইন্টারভিউ করবো, এরকম হলো পরিকল্পনা। শুরু করবো কবরী-মৌসুমীকে দিয়ে। আমজাদ-অমিতাভতো হয়েই আছে। কবরীকে ফোন করলাম।
তিনি ফোনে আইডিয়াটা খুব মন দিয়ে শুনলেন মনে হলোনা। বা বিষয়টা বুঝলেও আগ্রহ দেখালেন না। আলাপের এক পর্য়ায়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, মৌসুমী করবে আমার মূল্যায়ন? আমজাদ হোসেন কী সুন্দর অমিতাভ রেজার সঙ্গে আলাপ করলেন! আর কবরীকে আমি আইডিয়াটা বোঝাতেই পারলাম না!
ক’দিন বাদে উনার সঙ্গে দেখা হলো। অভিনেতা রাজ্জাক প্রয়াত হয়েছেন। এজন্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি টক-শোতে আমাকে ডাকলো। কবরীও আছেন। রাজ্জাককে নিয়ে কথা বললাম। আমার দুয়েকটা পয়েন্ট তিনি পছন্দ করেছেন, লাইভেই বললেন। লাইভ শেষে আমি আবার কথাটা পাড়লাম। তাকে কিছুতেই সাক্ষাৎকারের জন্য রাজী করাতে পারলাম না।
শেষ পর্য়ন্ত তাকে আমার মেজাজী আর অহংকারী মনে হয়েছে। ওই গ্রন্থ-প্রকল্প আর হয়নি। বলা যায় উনি ‘না’ করে দেয়াতেই এটা আর আগায় নি।
২০১৮ সালে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারের সমালোচক ক্যাটাগরিতে চলচ্চিত্র বিচারের জন্য ডাক পড়লো। দু’বছর আগেও ডাক পড়েছিল, তখন বিচারকদের প্রধান ছিলেন আমজাদ হোসেন। এবার কবরী। এসব ক্ষেত্রে অনেকদিন সবাই মিলে বসতে হয়, প্রথম আলো ভবনে বসে অনেক ছবি দেখতে হয়। আবারো তার পাশে বসার সুযোগ হলো, একসঙ্গে কাজ করতে হলো। কাজ করতে গিয়ে দেখলাম, অনেক ক্ষেত্রেই তার সঙ্গে মিলছেনা। বা সমালোচক ক্যাটাগরিতে বিচার করতে গিয়ে যে বিষয়গুলোর ওপর বেশি জোর দেয়া দরকার, তা বাদ দিয়ে ভিন্ন কিছু নিয়ে তিনি বেশি চিন্তিত। যেমন ‘ডুব’ দেখতে দেখতে তিনি নীতু চরিত্র নিয়ে মন্তব্য করলেন, না চরিত্রটা শাওনের মতো হয়নি… জাভেদকে একেবারেই হুমায়ুন আহমেদের মতো লাগছেনা… এরকম। একটু আধটু তর্ক লেগে যায় আমার সাথে। আমাদের সঙ্গে আরও তিনজন বিচারক ছিলেন। আলোচনার ভিত্তিতে আকরাম খানের ‘খাঁচা’কে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে রায় দেয়া হয়। শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও সেরা অভিনেতার পুরস্কারও খাঁচাই পায়। সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পান ‘ছিটকিনি’ চলচ্চিত্রের রুনা খান। ছিটকিনি নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র সমালোচক সাজেদুল আউয়াল।তিনিও কবরীর মতো সম্প্রতি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।
তবে কাজের আলাপের পাশাপাশি আমাদের কিছু ব্যক্তিগত আলাপ হয়। উনার নিজের বা অন্যকারও সূত্রে ব্যাংককে চিকিৎসার কথা ওঠে। আমিও বলি যে ২০১৭ সালে আমার ছেলের বিরল হৃদরোগ হয়, ব্যাংককে গিয়ে তার চিকিৎসা করিয়েছি। তিনি একথা শুনে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে থাকেন। এক লেখক-গবেষককে সাক্ষাৎকার দিতে না চাইলেও, এক বিপন্ন পিতার জন্য তিনি সম্পূর্ণ মনোযোগ বরাদ্দ করেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জানতে চান। ভারতে হৃদবিশেষজ্ঞ কারো কারো সঙ্গে তার পরিচয় আছে, তিনি ফোন নম্বর দেবেন বলেন। পারলে ভারতে গিয়ে সেকেন্ড থট নেবার জন্য আমাকে ছেলেসহ কালই পাঠিয়ে দেন তিনি।
আমি অন্য এক কবরীর দেখা পাই। মানবিক সারাহ বেগম কবরী।
আমাদের প্রথম আলোর কাজ শেষ হয়। অনেক দিন যায়। হঠাৎ কবরী আপার ফোন। কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন। ছেলে কেমন আছেন জিজ্ঞেস করলেন। ভারতে সেকেন্ড থটের কথা আবার মনে করিয়ে দিলেন। যেকোনো সাহায্য লাগলে জানাতে বললেন। আর বললেন, আসেন একদিন দেখা হোক।
আমি এবার বিস্মিত হলাম। তারমতো একজন বড়মাপের সেলিব্রিটি, একজন সাবেক সংসদ সদস্য, আমাকে মনে রেখেছেন, আমার ছেলের বিষয়টি নিয়ে তার উৎকণ্ঠা তখনো বলবৎ।
পর্দায় মুগ্ধতা ছড়ানো হার্টথ্রব কবরী ব্যক্তিজীবনে অনেক একামানুষ ছিলেন বলে জানা যায়। আমি পেলাম তার ভিন্ন পরিচয় – মেজাজী ও মানবিক।
১৭ই এপ্রিল, ২০২১
ফাহমিদুল হক: চলচ্চিত্র বিশ্লেষক
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
- ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১: জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ’
- সুনীল অর্থনীতি ও রূপকল্প-২০৪১
- শিক্ষার ধরন ও বেকারত্ব: দেশে অশিক্ষিতদের চেয়ে শিক্ষিত বেকার ৩ গুন
- ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়
- ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস-১৯৬১ ও দ্বিপক্ষিয় কূটনীতিক সম্পর্ক
- মিডিয়ার শক্তি বা আসক্তি: ম্যাজিক বুলেটের বাকের ভাই ও বদি
- গণমাধ্যমে গণরুচির বিকার
- হালকা বিনোদনের প্রাধান্যে সংস্কৃতির অবনতি
- বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণার দিন শেষ, চার উপায়ে মধ্য আয়ের দেশ