বড় পাখি খাঁচায়! ...
বড় পাখি খাঁচায়! ...
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক ঢাকায় এসেছিলেন ১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে। বাংলাদেশে তার দায়িত্ব শেষ হয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। যেদিন সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এরপর যুদ্ধবন্দি হিসেবে ভারতে দুই বছর কারাগারে থাকেন সিদ্দিক। ১৯৭৩ সালে দিল্লী চুক্তির মাধ্যমে মুক্তি পেয়ে পাকিস্তান ফিরে আবার সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। পদোন্নতি পান ব্রিগেডিয়ার হিসেবে। ১৯৮৮ সালে তৎকালীন সামরিক শাসক জেনারেল জিয়ার সাথে ভাওয়ালপুরে এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন সিদ্দিক সালিক। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র সিদ্দিক সালিক বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম নিয়ে ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ নামে একটি বই লিখেন ১৯৭৬ সালে। যা ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। বইটি বাঙ্গালীর মুক্তি সংগ্রাম নিয়ে লেখা বিদেশীদের সেরা বইগুলোর মধ্যে একটি। তথ্য সমৃদ্ধ এই বইটিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রাজনীতির বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে। এছাড়া অপরেশন সার্চলাইটসহ যুদ্ধের নয় মাসে পাক বাহিনীর বিভিন্ন অভিযান ও পরাজয়ের ইতিকথাও স্থান পেয়েছে বইটিতে। বইটি লিখতে গিয়ে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনী বা পাক সরকারের কাছ থেকে কোন রকম সহযোগিতা পাননি। বাংলাদেশে দায়িত্বপালকালে যেসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছিলেন সেগুলোই তিনি বইটিতে সংযুক্ত করেছেন।
প্রায় সাড়ে চার শ’ পৃষ্ঠার এই বইটিতে সিদ্দিক সালিক তিনটি পর্বে তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। রাজনৈতিক, রাজনীতি-সেনাবাহিনী ও সেনাবাহিনী এই তিনটি অধ্যায়ে বিভিন্ন অনুচ্ছদের মাধ্যমে তিনি সেই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরেছেন। সিদ্দিক সালিক বইটির দ্বিতীয় অধ্যায়ে দুই পর্বে অপারেশন সার্চলাইটের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। প্রথম পর্বে ঢাকা অভিযান, পরের পর্বে চট্টগ্রামসহ সারাদেশের অভিযান। ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইটির বর্ণনা অনুযায়ী ২৬ মার্চের ঘটনা প্রবাহ তুলে ধরা হলো।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নিয়ে ঢাকা সেনানিবাসে মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন যখন গভীর চিন্তায় মগ্ন এমনই এক সময়ে তার অফিসের সবুজ টেলিফোন বেজে ওঠে। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার, সময় সকাল ১১টা। টেলিফোনের অন্য প্রান্তে ছিলেন লে. জেনারেল টিক্কা খান। তিনি বলেন খাদিম, ইট ইজ টু নাইট। এতে খাদিমের মধ্যে তেমন কোন ভাবান্তর হয়নি। কারণ তিনি এ রকম একটি নির্দেশেরই অপেক্ষায় ছিলেন। তার জন্য তিনি প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছিলেন। রংপুর থেকে ঢাকায় এনেছিলেন ২৯ ক্যালিভারির ট্যাংক বাহিনী। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহর অর্থাৎ রাত একটাকে নির্ধারিত করা হয়েছিল আক্রমণের উপযুক্ত সময় হিসেবে। কারণ সেই সময়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের করাচী বিমানবন্দরে পৌঁছার করার কথা।
অপরেশন সার্চলাইট দুই ভাগে বিভক্ত। ঢাকায় অভিযানে নেতৃত্ব দেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী আর সারা দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে অভিযান চালান মেজর জেনারেল খাদিম। আর পুরো অপারেশনের গতি-প্রকৃতি ঢাকায় বসে পর্যবেক্ষণ করেন লে. জেনারেল টিক্কা খান।
সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, সেই রাতে তাদের মত জুনিয়র অফিসারের তেমন কিছু করার ছিল না। রাত ১০ টার দিকে তারা মার্শাল ল’ এ্যাডমিনস্ট্রেটরের অফিসে ছিলেন। রাতটি যাতে সহজ আর স্বাচ্ছন্দ্যে পার করা যায় সেজন্য কফির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এছাড়া ওয়ারলেস লাগানো একটা জিপ অফিসের সামনে তৈরি ছিল। বসন্তের সেই রাতে ঢাকার আকাশে ভরপুর জ্যো¯œা ছিল। আরামের সেই রাতে শহরবাসীও ছিল গভীর নিদ্রায় ।
তবে সেই রাতে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি শহরে আরেক শ্রেণীর মানুষ সক্রিয় ছিলেন। তারা হলেন বাঙ্গালী পুলিশ, ইপিআর সদস্য, বর্তমান ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা, ছাত্র, আওয়াম লীগের নেতা-কর্মী ও দলের স্বেচ্ছাসেবক। তারা শেখ মুজিবুর রহমান, জেনারেল ওসমানীসহ গুরুত্বপূর্ণ বাঙ্গালী অফিসারদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিলেন। প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন শক্ত প্রতিরোধের। তারা ঢাকার রাস্তায় বেরিকেড দিচ্ছিলো। এমন পরিস্থিতিতে রাত সাড়ে এগারোটার দিকে ঢাকার স্থানীয় কামান্ডর অপারেশনের অনুমতি চায়। তার যুক্তি, সময় যতো যাচ্ছে প্রতিরোধ তত কঠিন হচ্ছে। এ সময় অফিসের সবাই ঘড়ি দেখেন। তারা অনুমান করেন প্রেসিডেন্ট এখানো কলম্বো-করাচীর মধ্য পথে আছেন। করাচী পৌছার পরই শুরু হবে অভিযান।
ঢাকা সেনানিবাস থেকে প্রথম যে গাড়ি বহরটি বের হয় সেটি বাঁধার সম্মুখিন হয় ফার্মগেইট এলাকায়। সেখানে অনেক বড় একটি গাছ কেটে রাস্তায় বেরিকেড দেওয়া। এছাড়া পুরাতন গাড়ি, পরিত্যাক্ত বয়লারসহ বিভিন্ন ধরনের জিনিস দিয়ে তৈরি করা হয়েছিলো প্রতিবন্ধকতা। এ সময়ও শহরের রাস্তায় কয়েক হাজার আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী শ্লেগান দিচ্ছিলেন। সিদ্দিক সালিক তাদের জয় বাংলা শ্লোগান টিক্কা খানের অফিসের বারান্দা থেকেও শুনেছিলো। তার ভাষ্য অনুযায়ী, শ্লোগানের মাঝে রাইফেলের গুলির শব্দও শোনা যাচ্ছিলো।
মূল অভিযান রাত একটায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও অনেক জায়গায় একটার আগেই আক্রমণ শুরু হয়। যখন সেনারা প্রথম আক্রমণ শুরু করে তখন পাকিস্তান রেডিও তরঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষীণ কন্ঠস্বর ধরা পড়ে। কন্ঠস্বর শুনে মনে হচ্ছিলো এটা আগেই রেকর্ড করা। যে বার্তায় শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে সবার প্রতি আহ্বান জানান। সালিক নিজে শেখ মুজিবের সেই ঘোষণা শোনেননি। তবে এর কিছুক্ষণ পরেই রকেট লঞ্চারের দুটি ফারারের শব্দ শুনতে পান। যা রাস্তার বেরিক্যাড সরাতে সেনারা যা ব্যবহার করেছিল।
সে রাতে লে. কর্নেল জেড.এ. খান ও মেজর বেলাল শেখ মুজিবের বাড়িতে পরিচালিত অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন। সেনারা যখন মুজিবের বাড়ির ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছিলো তখন বাড়ির সামনে থেকে গুলি ছোড়া হয়। এরপর কয়েকজন সেনা বাড়ির দেওয়াল টপকে ভেতরে প্রবেশ করে। সেখানে স্টেনগানের ফায়ার আর চিৎকার করে শেখ মুজিবকে ডেকে তারা সেনাদের আসার বার্তা দেয়। কিন্তু ভেতর থেকে কোন সাড়া আসেনি। এরপর পাক সেনারা মুজিবের শোবার ঘরে বাহির থেকে তালা দেওয়া দেখতে পায়। সৈন্যরা গুলি করে তালা ভেঙ্গে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে। এরপর তিনি (মুজিব) নিজেকে গ্রেফতারের আহ্বান জানান। শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর ৫৭ ব্রিগেডের কমান্ডর মেজর জাফর তার ওয়ারলেসে বলেন, ‘ বিগ বার্ড ইন কেইজ’ আদার নট ইন দ্যা নেস্ট’ ওভার।
এই ম্যাসেজ শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পরই সিদ্দিক সালিক দেখতে পান একটি আর্মি জীপে করে বিগ বার্ডকে(শেখ মুজিব) ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসা হচ্ছে। তার পরনে সাদা শার্ট। এ সময় কেউ একজন টিক্কা খানকে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি তাঁর সাথে দেখা করতে চান কী না? টিক্কা খানের জবাব, আমি তাঁর মুখ দেখতে চাই না! পরের দিন সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুকে ফ্লাগ স্টাফ হাউজে স্থানান্তর করা হয়। যেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় কারচীতে। এ সময় শেখ মুজিবকে নিয়ে কী করা হবে তা নিয়ে ধুম্রজাল তৈরি হয়েছিল। এ সময় সিদ্দিক সালিক তার বন্ধু মেজর বিলালকে জিজ্ঞাসা করেন কেন শেখ মুজিবকে আক্রমণের প্রথম পর্যায়ে শেষ করে কেন দেওয়া হয়নি? সে জানায় জেনারেল মিঠ্ঠা তাকে ব্যাক্তিগতভাবে নির্দেশ দিয়েছিলেন যাতে মুজিবকে জীবিত গ্রেফতার করা হয়।
শেষ রাতের দিকে মুজিব যখন ক্যান্টমেন্টে বন্দী তখন ঢাকা মাহনগরী পুড়ছিল। সিদ্দিক সালিক তার বারান্দা থেকে টানা চার ঘন্টা ভয়ঙ্কর সব দৃশ্য দেখেন। আগুনের লেলিহান শিখা আকাশ ছুঁয়েছিল। ধোঁয়ার মেঘ তৈরি হয়েছিল ঢাকার আকাশে। যাতে বসন্তের পরিষ্কার আকাশের চাঁদের আলো ঢাকা পড়ে। শহরে সবচেয়ে বড় আগুনের শিখাটি উঠেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। এই এলাকায় সেনারা কিছুটা বাঁধার সম্মুখিন হয়। তবে ভোর চারটার মধ্যেই তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। শহরের অন্যপ্রান্তে রাজারবাগে ইপিআর সদস্যদের নিরস্ত্র করে পাক বাহিনী। আর শহরের অন্য সব জায়গায় সেনারা ফাঁকা গুলি ছোড়ে শুধুই আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য।
২৬ শে মার্চে আলো ফোটার আগেই সেনারা তাদের অভিযান শেষ করে। ভোর ৫ টার দিকে জেনারেল টিক্কা খান তার সোফা থেকে উঠেন। এ সময় রুমাল দিয়ে ড্রিংকসের গ্লাস পরিষ্কার করতে করতে বারান্দা দিয়ে তাকিয়ে বলেন, ওহ্ এখানেতো কোন আত্মাও নেই। এ সময় সিদ্দিক সালিক বাইরে তাকিয়ে দেখেন একটা কুকুর একাকী শহরের দিকে হেঁটে যাচ্ছে।
(লেখক, সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়)
• Salik, Siddiq (1997), Witness to Surrender, Dhaka: University Press Limited.
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
- ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১: জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ’
- সুনীল অর্থনীতি ও রূপকল্প-২০৪১
- শিক্ষার ধরন ও বেকারত্ব: দেশে অশিক্ষিতদের চেয়ে শিক্ষিত বেকার ৩ গুন
- ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়
- ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস-১৯৬১ ও দ্বিপক্ষিয় কূটনীতিক সম্পর্ক
- মিডিয়ার শক্তি বা আসক্তি: ম্যাজিক বুলেটের বাকের ভাই ও বদি
- গণমাধ্যমে গণরুচির বিকার
- হালকা বিনোদনের প্রাধান্যে সংস্কৃতির অবনতি
- বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণার দিন শেষ, চার উপায়ে মধ্য আয়ের দেশ