ডোবার কিছু কি রয়েছে বাকি?
ডোবার কিছু কি রয়েছে বাকি?
যুক্তরাজ্যে ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটের সামনে বিষয়টি অসাধারণ। দরজার সামনে বড় লন। সে লন পেরিয়ে উল্টোদিকে একটি ফটোগ্রাফি বুথ। ওখানেই বড় বড় ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন ফটো সাংবাদিকেরা। ধরুন, প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ঢুকছেন তার অফিসে। তাকে গাড়ি নামিয়ে দেয়া হলো লনের গোড়ার দিকটায় মূল সড়ক ঘেঁষে। এর প্রায় ২০ গজ পথ তাকে লনের পাশের ফুটপাত ধরে হেঁটে এসে ঢুকতে হবে ১০ নং-এ। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগুচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। এদিকে বুথ থেকে কেউ একজন হাঁক দিলেন 'বরিস' বলে। হাঁটতে, হাঁটতেই তিনি তাকালেন। অমনি ঝলকে উঠলো ক্যামরাগুলো। এইটুকু সময়ের মধ্যে যে যতটা যথাসময়ে ক্লিক করতে পারলো ছবিটা তুলে নিলো। ব্যস।
দূরের কথা বলি কেনো। আমাদের যারা ছবি তুলে নাম করেছেন, বিশেষ করে নিউজ ফটোগ্রাফি। রিপোর্টার হিসেবে অনেক অ্যাসাইমেন্ট কাভার করতে গিয়ে দেখেছি, তারাও বিশিষ্ট জনের একটা ভালো ছবি তোলার জন্য একটু তাকাতে বলেন। ক্ষণিকের জন্য তিনি তাকান। ছবি হয়ে যায়।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার দিন, ফটো সাংবাদিকদের এমন অনুরোধে সাড়া দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (তখনকার বিরোধী দলীয় নেত্রী) কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়েছিলেন ছবি তোলার সুযোগ করে দিতে। বলা তো হয়ই সেটুকু না হলে তিনি গিয়ে তার জন্য নির্ধারিত জায়গাটিতে বসতেন। আর প্রথম গ্রেনেডটি ঠিক সেখানটাতেই পড়েছিলো।
সুতরাং নিউজ ফটোগ্রাফিতে কিছুটা অনুরোধ, উপরোধ চলে। চলে কিছুটা অভিনয়ও। যদি আদৌ আপনি তাকে অভিনয় বলতে চান।
প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন প্রেস কনফারেন্সে টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যানরা প্রেস কনফারেন্স শুরু হওয়ার আগেই কিছু শট টেক করে নেন। সেগুলো এমন যে, দর্শকসারিতে সাংবাদিকরা বসে আছেন তারা যেনো প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনছেন এমন একটা লুক। এসময় একটু অভিনয়ই সাংবাদিকদের করতে হয়। বাঘা বাঘা সাংবাদিকদের আমরা দেখেছি, মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে এসব অডিয়েন্স শট নেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন ক্যামেরাম্যানদের। সকলেই জানে, প্রেস কনফারেন্সের সময় প্রধানমন্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে তাদের পক্ষে এই শট নেওয়া সম্ভব হবে না, সে কারণেই এই অভিনয়টুকু করিয়ে নেওয়া। আর খবর পরিবেশনের সময় এটুকু বাড়তি ফুটেজ প্রয়োজন হবে।
সুতরাং ফুটেজ দরকার আছে। কিন্তু সে ফুটেজ সংগ্রহ যদি পেশাদারিত্বের সাথে হয়, তার মধ্যেও যদি সাংবাদিকতার নর্মস গুলো বজায় থাকে তবেই ভালো হয়।
দিন কয়েক আগে ঢাকার একটি হোটেলের ভেতরে একটি বেসরকারি ব্যাংকের এটিএম বুথ বসানোর উদ্বোধনী চলছিলো। আয়োজকদের বিশেষ অনুরোধে সে কর্মসূচিটিতে অংশ নেই। ফিতা কেটে উদ্বোধন। উভয় পক্ষের প্রধানসারির কর্তা ব্যক্তিরা দাঁড়িয়ে গেছেন। এমন সময় একজন ক্যামেরাম্যানের অনুরোধ এটিএম বুথে যে দুটো লাইট জ্বলছে, সেটা নিভিয়ে দিতে হবে। ব্যস কর্মকর্তারা লেগে পড়লেন, কোথা থেকে কেমন করে সে আলো নেভাবেন। খোঁজাখুঁজি চলছিলো কোথায় তার সুইচ ইত্যাদি। ক্যামেরা ম্যানরা ক্যামেরা নামিয়ে বসে আছেন, ওদুটো না নেভানো হলে, তাদের পক্ষে যেনো ক্যামেরাই তাক করা সম্ভব নয়। এতে সাজানো আয়োজনটায় বিঘ্ন ঘটলো। আলো ছিলো এই বুথের সঙ্গে ইনবিল্ট। অবশেষে মূল প্লাগ খুলে দিয়ে আলো নেভানো হলো। তাতে পুরো বুথটাই হয়ে গেলো অন্ধকার। ব্যস এবার আর কি করা! প্লাগ লাগিয়ে সেই বুথ আলোকিত করে কর্তা ব্যক্তিরা ফিতা কাটলেন। ক্যামেরাম্যানরা তারই ছবি তুললেন। একজন ব্যাংক কর্মকর্তা সঙ্গে অদূরে দাড়িয়ে ছিলাম। তিনি বিরক্ত। ফিস ফিস করে জানতে চাইলেন, ভাই এই লাইটটি নেভানোর জন্য আপনারা কি আমাদের সঙ্গে এমনটা করতে পারেন? বললাম- না। একজন সংবাদকর্মীর দায়িত্ব হচ্ছে, পরিস্থিতি মেনে নিয়ে তার মধ্য থেকে তার কাজটি করে যাওয়া। পরিস্থিতির মধ্যে থেকে সে যতটা দক্ষতার সঙ্গে নিজের কাজটুকু করতে পারবে সেটাই হবে তার যোগ্যতার প্রকাশ। কর্মসূচি সাজবে, আয়োজকদের পছন্দে, সাংবাদিকের পছন্দে নয়।
কেনো এতো এতো গল্প ফাঁদলাম, নিশ্চয়ই এতক্ষণে কারো বোঝার বাকি নেই। সত্যিই আমরা বেশ খানিকটা বাড়াবাড়ি করেছি। যথেষ্ঠই অপেশাদারের আচরণ করেছি। যথাসময়ে অ্যাসাইনমেন্টে পৌঁছাতে না পারাটা সংবাদকর্মীর অযোগ্যতা। দেরীতে পৌঁছে একজন সম্মানিত, জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীকে নতুন করে ভ্যাকসিন নেওয়ার অভিনয় করতে অনুরোধ করা, আর সেই ফুটেজ দিয়ে খবর পরিবেশন মোটেই দক্ষতা, কিংবা যোগ্যতার প্রকাশ নয়। এটা স্রেফ অপেশাদারীত্ব।
আর মন্ত্রী মহোদয়ই কেনো সামান্য টিভি খবরের জন্য, এমন অভিনয় করতে গেলেন? অপেশাদারীত্বকে প্রশ্রয় যখন দেওয়া হলো, তা সকলের জন্যই ক্ষতির। সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে কোনো কিছুই আর গোপণ থাকে না। ফলে যা হলো- একজন দক্ষ মন্ত্রীর ইমেজ নষ্ট হলো। সাংবাদিকতাও ডুবলো। অবশ্য, ডোবার যদি কিছু বাকি থাকে, তাহলেইতো ডোবার প্রশ্ন।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
- ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১: জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ’
- সুনীল অর্থনীতি ও রূপকল্প-২০৪১
- শিক্ষার ধরন ও বেকারত্ব: দেশে অশিক্ষিতদের চেয়ে শিক্ষিত বেকার ৩ গুন
- ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়
- ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস-১৯৬১ ও দ্বিপক্ষিয় কূটনীতিক সম্পর্ক
- মিডিয়ার শক্তি বা আসক্তি: ম্যাজিক বুলেটের বাকের ভাই ও বদি
- গণমাধ্যমে গণরুচির বিকার
- হালকা বিনোদনের প্রাধান্যে সংস্কৃতির অবনতি
- বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণার দিন শেষ, চার উপায়ে মধ্য আয়ের দেশ