শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪ || ৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

হালকা বিনোদনের প্রাধান্যে সংস্কৃতির অবনতি

ড. নাদির জুনাইদ, শিক্ষক ও গণমাধ্যম বিশ্লেষক

১৯:৩৯, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১

আপডেট: ১৯:৫৩, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১

৫৪৬৮

হালকা বিনোদনের প্রাধান্যে সংস্কৃতির অবনতি

ড. নাদির জুনাইদ
ড. নাদির জুনাইদ

ইদানিং প্রায়শঃই ওটিটি (ওভার দ্য টপ) প্ল্যাটফর্ম নিয়ে আলোচনা এবং লেখালেখি করা হচ্ছে। আলোচনায় প্রায়ই থাকছে উচ্ছ্বাস যে টেলিভিশন চ্যানেলের এবং সিনেমা হলের উপর নির্ভর না করে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে নাটক-চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ দর্শকের জন্য সুবিধা সৃষ্টি করেছে। বলা হচ্ছে, নির্মাতারাও এখন ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য তাদের কাজ তৈরি করতে পারবেন যা তাদের স্বাধীনতা যোগাবে। নিশ্চয়ই ওটিটি প্ল্যাটফর্মের সম্ভাবনা আছে, এবং সঠিকভাবে সেই সম্ভাবনা ব্যবহার করতে পারলে দর্শকের উপকার হবে। কিন্তু কোনো আলোচনায় এই প্রশ্নটি  শুনতে পাই না ― নতুন এই প্ল্যাটফর্মে যে নাটক-চলচ্চিত্র দেখানো হবে তার বিষয়বস্তু যদি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রদর্শিত কাজগুলির মতোই হয় তাহলে ওটিটির কারণে আমাদের সংস্কৃতিতে কি কোনো গুণগত পরিবর্তন আসবে? ওটিটিতে যে উপাদানসমূহ আসবে তা যদি দর্শককে কেবল অগভীর বিনোদন যোগানোর জন্য চটকদার এবং জৌলুসপূর্ণ হয়ে ওঠে, এবং সেখানে কোনো সামাজিক বক্তব্য না থাকে তাহলে ওটিটির মাধ্যমে আমাদের সংস্কৃতির মান এবং দর্শকের রুচি উন্নত হবে কী করে?

আমাদের সংস্কৃতি তখনই উপকৃত হবে যদি নতুন প্ল্যাটফর্মে প্রদর্শিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গতানুগতিকতা-মুক্ত এবং প্রথাবিরোধী বিষয়বস্তু অন্তর্ভূক্ত করা হয়। একই কথা টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠানের জন্য এবং বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। গত বিশ বছরে দেশে টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলো বেশির ভাগ টেলিভিশন নাটকে এবং মূলধারার চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির বাইরে নির্মিত চলচ্চিত্রেও বেড়েছে চাকচিক্যময় এবং চটুল উপাদান ব্যবহারের প্রবণতা। অনেক বেশি দর্শককে আকৃষ্ট করে নির্মাতারা ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হয়েছেন। কিন্তু চিন্তাশীল বক্তব্য এবং সুস্থ বিনোদন না থাকার কারণে দর্শকের রুচি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর, সামাজিক বক্তব্যবিহীন হালকা বিনোদন-সর্বস্ব নাটক-চলচ্চিত্রের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পরেও তা নিয়ে সমালোচনা তো করা হচ্ছেই না, বরং এই ধরনের নাটক-চলচ্চিত্র আমাদের সমাজে নিয়মিত তৈরি হচ্ছে। প্রচার এবং প্রশংসা পাচ্ছেন এমন নাটক-চলচ্চিত্রের নির্মাতারা।  

এই প্রশ্নই মনে তৈরি হয় যে আমাদের সমাজে কি এখন বহু মানুষ উঁচু মানের এবং অতি সাধারণ মানের নাটক-চলচ্চিত্রের পার্থক্য বুঝতে পারেন? যে নাটক-চলচ্চিত্রে প্রাধান্য দেয়া হয় ব্যক্তিগত রোমান্টিক সম্পর্কের গতানুগতিক কাহিনী, চটুল হাস্যরস, আর অতি-সাদামাটা এবং কখনো কুরুচিপূর্ণ সংলাপ, যেখানে ক্যামেরা এবং দৃশ্য সম্পাদনার নান্দনিক ব্যবহার নেই, নেই কোনো গভীর সামাজিক বিশ্লেষণ আর সচেতনতা সৃষ্টিকারী বক্তব্য সেই ধরনের নাটক-চলচ্চিত্রই যখন গণমাধ্যমে এবং অনেক মানুষের কাছে প্রশংসিত হয় তখন এমন ধারণাই করতে হয় যে উঁচু মানের নাটক-চলচ্চিত্রের সাথে দর্শকদের পরিচয় করিয়ে না দেওয়ার কারণে দুর্বল এবং অগভীর নাটক-চলচ্চিত্রকেই বহু মানুষ এখন ভাল মানের কাজ মনে করছেন। কার্ল মার্কস যেমন বলেছিলেন যে যার সুরবোধ নেই তার কাছে শ্রেষ্ঠ সংগীতের কিছুই পৌঁছাবে না। আমাদের দেশে এই সমস্যাটিই এখন প্রবল। মানুষের মনে নান্দনিক এবং শৈল্পিক বোধ তৈরি করবে, তাদের সচেতনভাবে চিন্তা করতে সক্ষম করে তুলবে এমন নাটক-চলচ্চিত্র না তৈরি হচ্ছে, না অতীতে নির্মিত এমন নাটক-চলচ্চিত্র শহরে-গ্রামে বহু মানুষ দেখতে পারে সেই পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে। 

কোনো চলচ্চিত্র অনেক দর্শক দেখলেই (তা গণমাধ্যমে আকর্ষণীয় প্রচারের জন্যও হতে পারে) কি গণমাধ্যমে সেই চলচ্চিত্র-নির্মাতার প্রশংসা করা যৌক্তিক? নাকি বিশ্লেষণ করে দেখা উচিৎ সেই চলচ্চিত্র দর্শকদের চিন্তাশীল বক্তব্য কিংবা রুচিসম্মত বিনোদন দিয়েছে কিনা? যদি কোনো চলচ্চিত্র স্থুলতাসর্বস্ব বিনোদন এবং তারল্যনির্ভর আচরণ আকর্ষণীয়ভাবে দেখায় এবং বহু দর্শক এমন চলচ্চিত্র দেখার কারণেই যদি ছবির নির্মাতা গণমাধ্যমের প্রশংসা পেতে থাকেন তাহলে সমাজে অগভীর চিন্তা এবং রুচির দারিদ্রই তৈরি হবে। কেবল ক্যামেরা দিয়ে দৃশ্যধারণ করে সম্পাদনার মাধ্যমে সেই দৃশ্যগুলি জোড়া দিলেই নাটক-চলচ্চিত্র হয়ে যায় না। তাহলে তো ক্যামেরা আর এডিটিং প্যানেল থাকলেই যে কেউ চলচ্চিত্রকার হয়ে যেতে পারেন। মনে রাখতে হবে চলচ্চিত্র একটি শিল্প মাধ্যম এবং উঁচু মানের চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য একজন পরিচালককে ক্যামেরা-ভাষা সম্পর্কে জানার পাশাপাশি সংগীত ও চিত্রকলার মতো শিল্পমাধ্যম সম্পর্কে যেমন জানতে হবে, তেমনি তার জ্ঞান থাকতে হবে সাহিত্য, ইতিহাস, সমাজ, এবং রাজনীতি সম্পর্কে যেন চলচ্চিত্রের নির্মাণশৈলী এবং বক্তব্য দুই দিকেই চলচ্চিত্রকার চিন্তার গভীরতা যুক্ত করতে পারেন। যে চলচ্চিত্রে একটি চিন্তাশীল সংলাপও থাকে না, থাকে না কোনো গভীর সামাজিক বক্তব্য তা চলচ্চিত্র তথা একটি শিল্পমাধ্যম হয়ে উঠতে পারে না। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যে সাদামাটা কথোপকথন, আর গতানুগতিক নির্মাণশৈলীর মাধ্যমে গভীরতাহীন কোনো কাহিনী তুলে ধরলে তা কী করে চলচ্চিত্রের মতো একটি শিল্পমাধ্যম এবং সামাজিক বক্তব্য প্রদানের হাতিয়ার হয়ে উঠবে?

আমাদের দেশে অতীতে তৈরি হয়েছে জীবন থেকে নেয়া, ধীরে বহে মেঘনা, সূর্যকন্যা, মেঘের অনেক রং, সূর্যদীঘল বাড়ি, ঘুড্ডি, মাটির ময়না প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র। নির্মাণশৈলী এবং বিষয়বস্তু দুই দিক থেকেই এই ছবিগুলো হয়ে উঠেছিল অগতানুগতিক এবং গভীরতাসম্পন্ন। গত শতকের সত্তর এবং আশির দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রতি সপ্তাহে প্রচারের জন্য যে নাটকগুলি তৈরি করা হতো এবং যে ধারাবাহিক নাটকগুলি তখন দেখানো হতো তা দর্শককে বিনোদন যোগাতো। কিন্তু সেই বিনোদন স্থুলতাসর্বস্ব ছিল না। বিনোদনের পাশাপাশি সেই নাটকগুলি বিষয়বস্তুর মননশীলতা আর উঁচু মানের অভিনয়, নির্মাণপদ্ধতি এবং সংলাপের কারণে দর্শককে একইসাথে রুচিস্নিগ্ধ এবং সমাজসচেতন করে তুলতো। পুরনো দিনের এমন অনেক নাটকই এখন ইউটিউবে আছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে দর্শকদের হালকা বিনোদনধর্মী বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রতিনিয়ত দেখানোর মাধ্যমে তাদের এখন কেবল বিনোদন উপভোগেই অভ্যস্ত করে ফেলা হয়েছে। অনলাইনে সুনির্মিত এবং চিন্তাশীল বহু চলচ্চিত্র আর নাটক খুঁজে বের করে তা দেখার সুযোগ থাকলেও এই ধরনের নান্দনিক এবং সামাজিকভাবে অর্থবহ সাংস্কৃতিক উপাদান গ্রহণের জন্য আগ্রহী মন তো তৈরি করা হয়নি। হালকা বই পড়তে অভ্যস্ত পাঠকরা বা কোনো বইই যারা পড়ে না সেই পাঠকরা যেমন বইমেলায় গিয়ে শওকত ওসমান, সত্যেন সেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আহমদ ছফার বই কিনবে না তেমনি চটুল আর হালকা বিনোদনে দর্শকদের বুঁদ করে রেখে তাদের রুচি নিম্নগামী করে তোলা হলে আমরা আশা করতে পারি না সেই দর্শকরা নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের প্রতিদ্বন্দ্বী বা শতরঞ্জ কি খিলাড়ী, মৃণাল সেনের পদাতিক বা আকালের সন্ধানে, ঋত্বিক ঘটকের যুক্তি, তক্কো আর গপ্পো, জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইড, আলমগীর কবিরের রূপালি সৈকতে, তারেক মাসুদ আর ক্যাথরিন মাসুদের মুক্তির গান-এর মতো চলচ্চিত্র আর তথ্যচিত্র দেখবে।  

ভোগবাদী সমাজে হালকা বিনোদনধর্মী সাংস্কৃতিক উপাদান প্রাধান্য দেয়ার মূল কারণ অর্থনৈতিক মুনাফা অর্জন। সেই লাভ অর্জন করে এই ধরনের উপাদান নির্মাণের সাথে জড়িত অল্পসংখ্যক ব্যক্তি। কিন্তু বহু দর্শক বুঝতেও পারে না টাকা খরচ করে তারা যা দেখছে তা তাদের মনের উন্নতি ঘটাচ্ছে না। যথেষ্ট চিন্তা এবং পরিশ্রম ছাড়া খুব সহজেই ফর্মুলাভিত্তিক নাটক-চলচ্চিত্র তৈরি করে কিছু নির্মাতা আর প্রযোজক প্রচুর অর্থ অর্জন করেন এবং হালকা উপাদান বহুল মাত্রায় গ্রহণের কারণে নাগরিকদের শৈল্পিক বোধ, গভীরভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা এবং সামাজিক সচেতনতা তৈরি হয় না। মানুষ যখন বুদ্ধিউজ্জ্বল থাকে না তখন সেই মানুষদের ধোঁকা দেওয়া, শোষণ করা খুব সহজ। পশ্চিম বাংলার কবি এবং লেখক নবারুণ ভট্টাচার্য সমাজে  নীচু মানের সাংস্কৃতিক উপাদান টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, “দিশেহারা মানুষকে নেশায় বুঁদ করে রাখার জন্য যেমন  মদের দোকান দরকার, সেরকম টেলিভিশন সিরিয়াল দরকার, সোপ অপেরা দরকার, নোংরা প্রোগ্রাম দরকার, ব্লু-ফিল্ম দরকার। এগুলোর অঢেল সাপ্লাই বা বিশাল বিতরণের ব্যবস্থা দরকার। মানুষ যদি চুপ করে যায়, মানুষ যদি একটা ধোঁয়ার মধ্যে থাকে, সে কোনো প্রশ্ন করবে না।”

বাংলাদেশের বর্তমান সমাজে হালকা বিনোদনের প্রাধান্যের কারণে সংস্কৃতির মানের যে অবনতি ঘটেছে তা এই সময়ে বহু মানুষের বিশেষ করে কমবয়সীদের আচরণ খেয়াল করলেই বোঝা যায়। যাদের বয়স এখন বিশ এবং আরও কম তারা এমন পরিবেশে বেড়ে উঠেছে যেখানে অতীতের মতো শক্তিশালী এবং চিন্তাঋদ্ধ সাংস্কৃতিক উপাদান তৈরির প্রবণতা এবং চর্চা তারা দেখতে পায়নি। এখন মানহীন টিকটক-ভিডিও এবং কখনো খুবই অশালীন নানা ভিডিও, ট্রল, মিম তৈরি করে ফেসবুকে প্রচারের এবং দেখার জন্য অনেকে যে আগ্রহ দেখাচ্ছে কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে ধরনের মুখরোচক আলোচনা এবং রুচিহীন মন্তব্য করা এবং অন্যের সম্পর্কে বাজে কথা বলার প্রবণতা প্রতিনিয়ত আমাদের চোখে পড়ছে তা থেকেই অনেক মানুষের রুচি বর্তমান সময়ে কতোটা নিম্নগামী হয়েছে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। সমাজে চিন্তাশীলতার পরিবর্তে চটুলতার বিস্তার ঘটলে সাংস্কৃতিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবেই। আমরা যদি নির্লিপ্ত থাকি তা হলে সাংস্কৃতিক পরিবেশের মানের ধারাবাহিক অবনতি এবং মানুষের রুচির ক্ষয় ঘটতেই থাকবে। সেই পরিস্থিতি বর্তমান সময়ের এবং আগামী দিনের নাগরিকদের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। সমাজে বহু মানুষের মধ্যে সুরুচি, যুক্তিবোধ, এবং সচেতনতা তৈরি হবে কিনা তা আমাদের দায়িত্বশীল আচরণ করার উপরই নির্ভর করছে। 

ড. নাদির জুনাইদ: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 
 

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank