যে আগুন ছড়িয়েছিল সবখানে
যে আগুন ছড়িয়েছিল সবখানে
৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩। যুদ্ধাপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশের রায়ের বিরুদ্ধে তারুণ্যের আগুনশিখা গণজাগরণ বাংলাদেশের ইতিহাসের এক পথ পরিক্রমা। এই পথ ধরে রচিত হয়েছে কলঙ্কমোচনের সোনালী সিঁড়ি। সেদিন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় ঘোষিত হয়, কিন্তু প্রো-একাত্তর প্রজন্ম সে রায় মেনে নেয়নি। প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে দেশ। আদালতে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণের পরেও দেওয়া হয় যাবজ্জীবন দণ্ড। মানবতাবিরোধী অপরাধের সুস্পষ্ট প্রমাণের পরেও এমন দণ্ড মেনে নেয়নি দেশ। দাবি ওঠে সর্বোচ্চ শাস্তির। ঢাকা-সিলেট-চট্টগ্রামসহ সারাদেশের মানুষ কসাই কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবি তুলে। সৃষ্টি হয় অভূতপূর্ব এক গণজাগরণ। এই গণজাগরণের ওঠে আসা গণদাবির মুখে সরকার আইন সংশোধন করে। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির পথ উন্মুক্ত হয় আইনিভাবে, যার পথ ধরে একে একে শাস্তি পায় আরও বেশ কজন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী।
তেরোর সেই গণজাগরণ শহীদ জননী জাহানারা ইমামের গণআন্দোলনের চেতনা থেকে উৎসারিত। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে গড়ে ওঠা এই আন্দোলন একদিনের অর্জন নয়। শহীদ জননীর দেখিয়ে দেওয়া পথ ধরে ব্লগারেরা দীর্ঘদিন ধরে তাদের লেখনির মাধ্যমে অনলাইন মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছিল। অনলাইনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী একটা প্রজন্ম গড়ে ওঠেছিল যারা একাত্তরের গণহত্যার পরিকল্পনাকারী রাজাকার, আল বদর, আল শামস, শান্তিকমিটি সদস্যদের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামকে অব্যাহত রেখেছিল। এই প্রজন্মের সবাই যে অনলাইনে গবেষণা কিংবা লেখালেখি করেছিল তা নয়, তাদের লেখনির মাধ্যমে এক শ্রেণির মানুষ নিজেদের আত্মপরিচয়ের সন্ধানে ছিল। যাদের অনেকেই দেখেনি জাহানারা ইমামের সে আন্দোলনের দিনগুলো; তবু বুকে ধারণ করে ছিল সে চেতনা।
সব কালে, সব সময়ে বাংলাদেশমুখি মানুষের সংখ্যা ছিল অগণন। মানুষ যখনই সুযোগ পেয়েছে, ডাক পেয়েছে তখনই সাড়া দিয়ে বাংলাদেশবিরোধীদের প্রতি জানিয়ে গেছে তাদের প্রবল ঘৃণা। সাংগঠনিকভাবে হোক আর ব্যক্তি পর্যায়েই হোক প্রবল ঘৃণাকে আগলে রেখে অপেক্ষায় ছিল প্রতিবাদী কোনো ডাকের। যুদ্ধাপরাধীরা সময়ে-সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতার অংশ হয়ে গেলেও তাদের অতীত, একাত্তরে তাদের ভূমিকা-গণহত্যা ভুলে যায়নি দেশের মানুষ। রাজাকারদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়াকে দাঁতে দাঁত চেপে হয়ত সহ্য করা হয়েছে কিন্তু আখেরে এই প্রতিক্রিয়া হয়েছে কার্যকরভাবে অবিনাশী।
যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে ঘৃণাপ্রকাশের উল্লেখযোগ্য প্রতিবাদের পেছন খুঁজতে গেলে উল্লেখ করতে হয় তেমন কিছু ঘটনা। একাত্তরের গণহত্যা এবং যুদ্ধাপরাধের প্রধানতম সাইনবোর্ড গোলাম আযম বাংলাদেশে আসে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের আমলে। পাকিস্তানি এই নাগরিক তার অসুস্থ মাকে দেখতে আসার নামে বাংলাদেশে আসে। প্রতিবাদ করার জন্যে খুব বেশি লোক ছিল না। তবু এরমধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কাজী নূর-উজ্জামানসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা তার এই আগমনের জোরালো প্রতিবাদ করেন। ফলে মাওলানা মান্নানের ইনকিলাব নামক পত্রিকা এই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ইসলামবিরোধী বলে আখ্যা দিয়েছিল। ধর্মান্ধ এই গোষ্ঠীদের কাছে গোলাম আযম মানে ইসলামের প্রতিশব্দ। একাত্তরের গণহত্যার মুল পরিকল্পনাকারী হিসেবের বাইরেও এই গোলাম আজমগং মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য মুসলিম দেশে মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পর অপপ্রচার চালিয়েছিল বাংলাদেশে ইসলাম বিনষ্ট হয়েছে বলে। ফলে ওআইসি এবং বেশ কিছু ইসলামি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে অনেক দেরি করেছিল।
১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের সর্বশেষ সাংবিধানিক পেরেক ঠুকে দেন জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। কলমের খোঁচায় দেশের ওপর লেগে যায় ধর্মীয় লেবাস। গড়ে ওঠে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী জোট। নেতৃত্বে ছিলেন- আহমদ শরীফ, শাহরিয়ার কবির, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। কিন্তু তারা নির্বিঘ্নে তাদের প্রতিবাদ চালিয়ে যেতে পারেননি। সামরিক শাসকের রক্তচক্ষু আর সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠীর রোষানলে পড়েন। রাজাকার মান্নানের ইনকিলাব পত্রিকা তাদের বিরুদ্ধে নেমে পড়ে সম্মুখ সমরে। ফলে হেন কোন অভিধা বাকি থাকেনি তাদের জন্যে। তবু তারা প্রতিবাদে মুখর ছিলেন এবং লৌকিক কোন অর্জন ঘরে তুলতে না পারলেও চেতনার বীজকে প্রোথিত করেছিলেন। যা এক দাবানল হিসেবে পরিগণিত হয়। এরপর জামায়াতে ইসলামি দলের ভারপ্রাপ্ত আমিরের পদ থেকে রাজাকার আব্বাস আলী খানকে সরিয়ে দিয়ে গোলাম আজমকে ‘আমির’ ঘোষণা করলো তখন চেতনার স্ফুলিঙ্গ জ্বলে ওঠে। সামনে চলে আসে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত হয় গণআদালত।
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর যখন পাকিস্তানি নাগরিক ও যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমকে জামায়াতে ইসলামি তাদের দলের আমির ঘোষণা করে। একটা দলের প্রধান কে হবে সেটা তাদের নিজস্ব বিষয় থাকলেও যখনই একজন পাকিস্তানি নাগরিক এবং শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীকে একটা রাজনৈতিক দলের প্রধান করা হয় তখনই বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সুধীসমাজ। জাহানারা ইমামকে আহ্বায়ক করে ১৯ জানুয়ারি ১৯৯২, ১০১ সদস্যবিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী প্রতিরোধ মঞ্চ, ১৪টি ছাত্র সংগঠন, প্রধান প্রধান রাজনৈতিক জোট, শ্রমিক-কৃষক-নারী এবং সাংস্কৃতিক জোটসহ ৭০টি সংগঠনের সমন্বয়ে ১৯৯২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠিত হয়। কমিটি ১৯৯২ সালে ২৬ মার্চ ‘গণআদালত’-এর মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একাত্তরের নরঘাতক গোলাম আজমের ঐতিহাসিক প্রতীকী বিচার অনুষ্ঠান করে। গণআদালতে গোলাম আজমের বিরুদ্ধে দশটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপিত হয়। অ্যাডভোকেট গাজিউল হক, ড. আহমদ শরীফ, স্থপতি মাজহারুল ইসলাম, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, সুফিয়া কামাল, কবীর চৌধুরী, কলিম শরাফী, শওকত ওসমান, লে. কর্নেল (অব.) কাজী নুরুজ্জামান, লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী, ব্যারিস্টার শওকত আলী এবং জাহানারা ইমামকে নিয়ে ১২ জন বিচারক সমন্বয়ে গঠিত গণআদালতের রায়ে গোলাম আযমের ১০টি অপরাধ মৃত্যুদণ্ডযোগ্য বলে ঘোষণা করেন। গণআদালতের চেয়ারম্যান হিসেবে রায় ঘোষণা করে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এবং একই সঙ্গে তিনি গণআদালতের রায় কার্যকর করার জন্য সরকারের কাছে দাবিও জানান।
গণআদালতের এই রায় কার্যকরের দাবি জানিয়ে লাখো জনতার পদযাত্রা জাতীয় সংসদের স্পিকার, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে স্মারকলিপি দেয়। ১০০ জন সংসদ সদস্য গণআদালতের রায়ের পক্ষে সমর্থন ঘোষণা করেন। ওখানেই থেমে থাকেননি শহীদ জননী। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় দেশব্যাপী গণস্বাক্ষর, গণসমাবেশ, মানববন্ধন, সংসদ যাত্রা, অবস্থান ধর্মঘট, মহাসমাবেশ ইত্যাদি কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে আন্দোলন আরও বেগবান করেন, জনসমর্থন পায় এই আন্দোলন। কিন্তু রায় কার্যকর না করে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করে তৎকালীন বিএনপি সরকার। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২৬ মার্চ ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা দিবসে গণআদালত বার্ষিকীতে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণতদন্ত কমিটি ঘোষিত হয় এবং আরও আট শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর নাম ঘোষণা করা হয়। যার মধ্যে ছিল আব্বাস আলী খান, মতিউর রহমান নিজামী, মো. কামারুজ্জামান, আবদুল আলীম, দেলাওয়ার হোসেইন সাঈদী, মওলানা আবদুল মান্নান, আনোয়ার জাহিদ এবং আবদুল কাদের মোল্লা।
ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ করে জাহানারা ইমামের মৃত্যু, এরপরের নেতৃত্বহীনতা ও বৈরি রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির আন্দোলন প্রায় হারিয়ে যায়। মাঠের আন্দোলন হারালেও অনলাইনের আন্দোলন হারিয়ে যায়নি, গড়ে ওঠে এমন এক প্রজন্ম যারা একাত্তরকে ধারণ করে। ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় এই আন্দোলন আবারও মাঠে আবির্ভূত হয় মিরপুরের কসাই খ্যাত আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন রায়ের পর। মানবতাবিরোধী এই অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে দেশ, সৃষ্টি হয় গণজাগরণের।
তেরোর সেই গণজাগরণের অষ্টম বার্ষিকী আজ (৫ ফেব্রুয়ারি)। সে আন্দোলন সফল হয়েছিল। রাজাকারের বিরুদ্ধে অন্তর্গত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশে মানুষ বাংলাদেশবিরোধীদের প্রকাশ্যে ঘৃণা করতে শিখেছিল। রাজাকারকে রাজাকার বলার সাহস সঞ্চয় করেছিল দেশ। সেই গণজাগরণের পথ ধরে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী অনেকের ফাঁসি সম্পন্ন হয়েছে। সাঈদীসহ আরও কজন আছেন কারাগারে। তবে এই সময়ে এসে গতিমন্থরতায় ভুগছে বিচার প্রক্রিয়া; বিচারিক আদালত, উচ্চ আদালত সব জায়গায়ই। সরকারের মধ্যেও আগ্রহ নেই আগের মত।
তেরোর গণজাগরণ বাংলাদেশের গৌরবময় এক ইতিহাসের অংশ। আন্দোলনকারীরা নানা অপপ্রচার, উগ্রবাদী আক্রমণের মুখে পড়েছেন, চাকরি-ব্যবসা হারিয়েছেন অনেকেই; কিন্তু তারা তাদের ব্যক্তিগত সকল ক্ষতি উপেক্ষা করে দেশের কলঙ্কমুক্তির একটা অধ্যায়ের সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন। বাংলাদেশমুখী নাগরিকের কাছে এই আন্দোলন গৌরবের অংশ, একই সঙ্গে বাংলাদেশবিরোধীদের কাছে এটা বিব্রতকর এক অধ্যায়। তেরোর সেই ধাক্কা এখনও সামলে ওঠতে পারেনি তারা, তাই এই সময়েও মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের গৌরবময় অনেক ঘটনার অপ্রকাশ্য বিরোধিতার সঙ্গে সঙ্গে গণজাগরণেরও বিরোধিতা করে তারা। একাত্তরের পরাজয়ের সঙ্গে বিশ-তেরোর সেই পরাজয় ক্ষত হয়ে এখনও বিঁধে তাদের।
বিশ-তেরো আমাদের ইতিহাসের এক সোনালী অধ্যায়। যে অধ্যায়ের সুফল এখন ভোগ করছে দেশ। যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিয়ে একটা প্রজন্ম চুপিসারে গড়ে ওঠলেও তাদের আদর্শকে ঘৃণা করে দেশের অধিকাংশ মানুষ। তেরোর সেই গণজাগরণের পথ ধরে সর্বশেষ যুদ্ধাপরাধী শাস্তি পাওয়ার মাধ্যমে দেশ চূড়ান্তভাবে কলঙ্কমুক্ত হবে এমন প্রত্যাশা আমাদের।
কবির য়াহমদ: সাংবাদিক ও লেখক।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
- ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১: জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ’
- সুনীল অর্থনীতি ও রূপকল্প-২০৪১
- শিক্ষার ধরন ও বেকারত্ব: দেশে অশিক্ষিতদের চেয়ে শিক্ষিত বেকার ৩ গুন
- ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়
- ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস-১৯৬১ ও দ্বিপক্ষিয় কূটনীতিক সম্পর্ক
- মিডিয়ার শক্তি বা আসক্তি: ম্যাজিক বুলেটের বাকের ভাই ও বদি
- গণমাধ্যমে গণরুচির বিকার
- হালকা বিনোদনের প্রাধান্যে সংস্কৃতির অবনতি
- বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণার দিন শেষ, চার উপায়ে মধ্য আয়ের দেশ