বুধবার   ২৭ নভেম্বর ২০২৪ || ১২ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

কুয়েতে কারাদণ্ড পাওয়া পাপুল দেশে এখনো ‘মাননীয় সাংসদ’!

কবির য়াহমদ, সাংবাদিক ও লেখক

০৯:৩৬, ৩০ জানুয়ারি ২০২১

আপডেট: ০৯:৩৮, ৩০ জানুয়ারি ২০২১

১১৫২

কুয়েতে কারাদণ্ড পাওয়া পাপুল দেশে এখনো ‘মাননীয় সাংসদ’!

সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল কুয়েতের একটি আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন। তার আগে থেকে তিনি গ্রেপ্তার রয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে। এটা কেবল দেশের গণমাধ্যমেই নয়, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেরও খবর। দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্টকারী এই কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ অদ্যাবধি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এই ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণ এই তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় সংসদের কাছে উপস্থাপন না হওয়া। আদমপাচার ও অর্থপাচারের অভিযোগে তিনি কুয়েতে চারবছরের দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার এসেছে এই রায়। তবে তারও কয়েক মাস আগে থেকেই তিনি কুয়েতের কারাগারে। বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে কোনো আদালতে কোনো দণ্ড ঘোষিত না হওয়ায় সংসদ সদস্যপদ টিকিয়ে রেখেছেন তিনি।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে কুয়েতের আরবি দৈনিক আল কাবাস ও আরব টাইমসে পাপুল এমপির বিরুদ্ধে যখন মানবপাচারের অভিযোগের খবর প্রকাশিত হয় তখন সেই খবর বাংলাদেশের গণমাধ্যমেও প্রকাশ হয়। ওই সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন কোনধরনের খোঁজখবর না নিয়েই বলে ওঠেন ওটা ‘ফেইক নিউজ’। অথচ এই মন্তব্য করার আগে খবরাখবর নেওয়াটাই ছিল তার দায়িত্বশীল ভূমিকা। সংবাদপ্রকাশের অব্যবহিত পর ওটা করা হয়নি সরকারের পক্ষ থেকে। পরে দূতাবাস সূত্রসহ নানা মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়ার পর এনিয়ে সরকারের আর কোন ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি। সরকারি দল আওয়ামী লীগ বলছে কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল আওয়ামী লীগ দলীয় সাংসদ নন বলে তার বিরুদ্ধে দলীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই তাদের। দলের এই বক্তব্যে যৌক্তিকতা আছে, কিন্তু জাতীয় সংসদ? সংসদের অভিভাবক হিসেবে স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী এ নিয়ে কোন ভূমিকা পালন করেননি। কেন পালন করেননি বা করতে পারেননি এখানে তার দায় কতখানি সেটাও এক্ষেত্রে বিবেচনায় আনা দরকার। স্পিকার নানা মাধ্যমে গ্রেপ্তারের তথ্য জানতে পেরেছেন বলে গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, তবে আনুষ্ঠানিকভাবে সংসদ সচিবালয়ের কাছে এনিয়ে কেউ তথ্য দেয়নি। আনুষ্ঠানিক তথ্য না পেলে সাংসদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার মত সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা স্পিকার ও নির্বাচন কমিশনের রয়েছে কি? কেবল কাগুজে নিয়মকানুনের বাইরে যেখানে দেশের ভাবমূর্তির প্রসঙ্গ জড়িত সেখানে সংসদ সচিবালয়, সরকারের ভূমিকা কী রকম হলে সেটা দায়িত্বশীল ভূমিকা হিসেবে আখ্যা দেওয়া যায়? ভাবতে হয় বৈকি!

কাগুজে সীমাবদ্ধতা থাকে অনেকক্ষেত্রে, কিন্তু দেশের ভাবমূর্তির প্রশ্নে কোথাও যদি কোনো সীমাবদ্ধতা থেকে থাকে সেক্ষেত্রে কিছু নৈতিক দায়িত্ব এসে যায়; এই নৈতিক দায়িত্ব কি পালন করেছে সরকারের কোন প্রতিষ্ঠান, অংশ? হতে পারে এমন কোনো ঘটনার মুখে আগে পড়েনি দেশ। সংবিধান প্রণয়ন, সংশোধন ও নানা ধারা সংযোজন-বিয়োজনের নানা সময়ে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব না হওয়ায় হয়ত বিদেশে গ্রেপ্তার-অভিযুক্ত সাংসদকে নিয়ে সরকারের করণীয় নিয়ে সাধারণীকরণ অর্থে কিছু ছিল না, কিন্তু অদ্যকার ঘটনার পর নিশ্চিতভাবেই এটা নিয়ে পরিস্কার সিদ্ধান্তে পৌঁছার সুযোগ হয়েছে। এখানে যদি সাংবিধানিক কোনো সীমাবদ্ধতা থেকে থাকে তবে এই সীমাবদ্ধতা ঘুচাতে সম্ভব সকল কিছু করা উচিত। বিশেষত যখন এটা দেশের ভাবমূর্তি-বিনাশী।

কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল স্রেফ একজন বাংলাদেশি নাগরিক নন, তিনি বাংলাদেশের আইনপ্রণেতা। তার এই পরিচয় সাধারণ দশজনের পরিচয়ের সঙ্গে পার্থক্য রয়েছে। তিনি দেশের প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তি। তার এই স্খলনের সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তির প্রসঙ্গ জড়িত। বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্য বিদেশের একটা আদালতের রায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন এরচেয়ে লজ্জার, এরচেয়ে হতাশার আর কিছু হতে পারে না। এই লজ্জা ও হতাশা শব্দ দুটোর সঙ্গে আমাদের আবেগের সংশ্লেষ রয়েছে হয়ত কিন্তু কুয়েতে তিনি একদিকে যেমন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদকে ছোট করেছেন, ছোট করেছেন পুরো দেশকে।

পাপুল শ্রমিক তত্ত্বাবধায়ক থেকে কোটিপতি হয়ে এরপর সংসদ সদস্য হয়েছেন এই তথ্য কুয়েতের সংবাদমাধ্যমে তার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশের পর জানা গেছে। এরআগে তাকে নিয়ে চর্চা খুব বেশি হয়নি। এই না হওয়ার পেছনে তার প্রভাব, তার অঢেল সম্পদের মালিকানা, তার সাংসদ পরিচয়, একজন সাংসদের স্বামীর পরিচয় বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। কিছুদিন আগের তথ্য প্রযুক্তি আইনের সাতান্ন ধারার পর এই সময়ের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আমাদের বাকস্বাধীনতায় যে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাতে করে প্রভাবশালী কারও বিরুদ্ধে সত্য উচ্চারণ করতে গেলেও অসম-সাহসের প্রমাণ দিতে হয়। ফলে অনেক কিছুই গোপন থেকেছে এতদিন, অন্য অনেকের অনেক গোপন কিছুও গোপন থাকছে। তাদের নিয়ে চর্চা তখনই ব্যাপক হয় যখন এদের কেউ বেকায়দায় পড়েন। এবারও তাই হয়েছে। তাকে নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে; কুয়েতে তার গ্রেপ্তারের পর, আদালতের তার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার পর তাকে নিয়ে তাই সকল মাধ্যমে অনেক আলোচনা।

কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল বিপুল বিত্ত বৈভবের মালিক হয়েছেন। তার এই সম্পদ অর্জন বৈধ নাকি অবৈধভাবে হয়েছে এটা নিয়ে দেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আগে গুরুত্ব দেয়নি। কুয়েতে তার বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া শুরুর পর নড়েচড়ে বসেছে দুদক। সাংসদ পাপুল, তার সাংসদ স্ত্রী, মেয়ের বিরুদ্ধে তারা এখন কঠোর হতে বসেছে। রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটি আগে থেকে কেন ভূমিকা পালন করেনি, এটাও প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর অবশ্য আরও অনেককে দিয়েও খোঁজা যায়; কেউ বেকায়দায় পড়লে দুদকও কঠোর হয়, কষ্টকঠিন বাস্তবতা তেমনই বলছে। এটা দুদকের অন্যতম দুর্বল দিক।

সাংসদ কাজী পাপুলের বিরুদ্ধে কুয়েতে কারাদণ্ড ঘোষিত হওয়ার পর এখন নানা মাধ্যম থেকে জানা যাচ্ছে এবার তার সংসদ সদস্যপদ চলে যেতে পারে। সংবিধান ও আইন বিশেষজ্ঞদের সূত্রে জানা যাচ্ছে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬৬ (২) অনুসারে, ‘‘কোন ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ-সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি (ক) কোন উপযুক্ত আদালত তাঁহাকে অপ্রকৃতিস্থ বলিয়া ঘোষণা করেন; (খ) তিনি দেউলিয়া ঘোষিত হইবার পর দায় হইতে অব্যাহতি লাভ না করিয়া থাকেন; (গ) তিনি কোন বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন কিংবা কোন বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করেন; (ঘ) তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোন ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বৎসরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাহার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে।’’ লক্ষ্মীপুর-২ আসনের এই সাংসদের বিরুদ্ধে দণ্ড ঘোষিত হওয়ার পর একটি গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন, ‘‘যেহেতু রায়টি বিদেশের আদালতে হয়েছে তাই আগে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের জানতে হবে। তারা (কুয়েত) আমাদের আনুষ্ঠাকিভাবে জানালে, আমরা জানার পর বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে দেখব। আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ এই এই ‘আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা’ নেওয়ার প্রসঙ্গে যে প্রশ্নের উদ্রেক হয় তা হলো- সংবিধানের যে ধারায় সাংসদের পদ শূন্য হবে সেটা ধারার যে সংবিধান সেটা ত আমাদের প্রজাতন্ত্রের জন্যে প্রযোজ্য, এখানে কুয়েতের আদালতের ঘোষিত দণ্ড কি আমাদের এখানের জন্যেও প্রযোজ্য হবে? এখানে দরকার সাংবিধানিক ব্যাখ্যার, আশা করি সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল ও বিশেষজ্ঞরা এর সুরাহা করবেন। এছাড়াও প্রশ্ন হলো- আমাদের জাতীয় সংসদকে এই তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে জানাবে কে? কুয়েত কি সাংসদ কাজী পাপুলের দণ্ডপ্রাপ্তির তথ্য বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাবে? যদি আনুষ্ঠানিকভাবে না জানায় তবে কি এই যাত্রায়ও পার পেয়ে যাবেন মানবপাচারকারী সাংসদ কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল?

কাজী পাপুল রাজনীতি না করেও আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টির স্থানীয় সবাইকে টপকে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টির মহাজোট প্রার্থীর হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের স্বতন্ত্র প্রার্থী পাপুলের পক্ষে কাজ করার পেছনে যে রহস্য সেটার উত্তর হয়ত ‘অর্থের প্রভাব’। স্রেফ টাকার কাছে আদর্শ-নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দেওয়ার ঘটনাগুলো আমাদের রাজনীতিতে এখন নিয়মিতই। মাঠের রাজনীতি না করেও এমপি, মন্ত্রী, মেয়র ও রাজনৈতিক দলগুলোর কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা করে নেওয়া এখন স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর এই নীতিবিচ্যুতি কাজী পাপুলদের মত ব্যক্তিদের সামনে নিয়ে আসছে। এসবের দায় রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিনির্ধারকেরা এড়াতে পারে?

পাপুল কী থেকে কী হয়েছেন- এসবের অনেক চর্চা হয়েছে, কিন্তু এই চর্চার সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের কাছে রাখার আওয়াজ ওঠেনি। ফলে ব্যক্তি পাপুলের কৃত অপরাধের খেসারৎ দেশকে এত কঠিন ও লজ্জাজনকভাবে দিলেও রাজনীতিকে শুদ্ধ করার প্রত্যয় কারও মাঝে দৃশ্যমান হয়নি। ফলে বলা যায় দেশের এমন ক্ষতির পরেও আমরা এসব দুর্বৃত্তদের ওঠে আসার পথ বন্ধ করতে আগ্রহী না। অথচ এটা জরুরি ছিল।

কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল দেশের ললাটে কলঙ্কের যে তিলক এঁটে দিয়েছেন এই ভাবমূর্তিজনিত ক্ষতির ক্ষতিপূরণ অসম্ভব প্রায়। দেশের ইতিহাসের প্রথম সাংসদ হিসেবে তিনি দেশের বাইরে লজ্জাজনকভাবে দণ্ডিত হয়েছেন। তিনি প্রথম নিশ্চিতভাবে, তবে তাকে দিয়েই যে এর শেষ হবে এমনটা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উচ্চারণ করা যাচ্ছে না, কারণ আইনপ্রণেতা, নীতিনির্ধারক আর রাজনীতিবিদদের জায়গা ইতোমধ্যেই দখল করে বসে আছেন অনেক ব্যবসায়ী এবং এই অনেকের মধ্যে এইধরনের দুর্বৃত্ত ব্যবসায়ীরাও যে নাই সে নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। সাংসদ কাজী পাপুল দুর্বৃত্ত ব্যবসায়ী, সেখান থেকে স্রেফ টাকার জোরে আইনপ্রণেতা হয়ে চেপে বসেছেন আমাদের ঘাড়ে; জগদ্দল পাথরের মত। অন্য নামের এমন কাজী পাপুল আরও আছেন হয়ত, যাদের এক ঠিকানা দেশে, অন্য ঠিকানা বিদেশের আবিস্কৃত-অনাবিস্কৃত কোন ‘বেগমপাড়ায়’। শঙ্কা তাদের নিয়েও। কে জানে তাদের কে কখন যে আমাদের আইনপ্রণেতা-নীতিনির্ধারক হয়ে যায়!

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank