শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪ || ৯ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

নাঈম ভাইকে নিয়ে লিখতে চেয়েছিলাম

মাহমুদ মেনন, সাংবাদিক ও শিক্ষক

১৯:৪০, ২১ জানুয়ারি ২০২১

আপডেট: ১৯:৫৯, ২১ জানুয়ারি ২০২১

১৭৭৪

নাঈম ভাইকে নিয়ে লিখতে চেয়েছিলাম

নাঈমুল ইসলাম খান
নাঈমুল ইসলাম খান

নাঈম ভাইকে নিয়ে যেকোনও সময়-কাল-পাত্র থেকে লেখা শুরু করা যায়। নাঈমুল ইসলাম খান একটি প্রতিষ্ঠানের নাম, নাঈমুল ইসলাম খান দেশে আধুনিক সাংবাদিকতা চর্চার পথিকৃৎ, নাঈমুল ইসলাম খান সাংবাদিকতা শিক্ষণ ও চর্চাকে একসূতোয় গেঁথেছেন- এমন অনেক কথা লেখা যায়।

১৯৯১ থেকে ২০২১। ঠিক ঠিক ত্রিশ বছর। কিন্তু আজ তার জন্মদিনে স্মৃতির পাতা খুঁজে প্রথমেই যে কথাটি স্মরণে পড়ছে সেটি ২০২০ সালের। এই লেখার শেষভাগে সে বিষয়ে লেখার ইচ্ছা পোষণ করছি। শুরুতেই লিখি শুরুর দিনটির কথা। সেটি ১৯৯১ সাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হয়ে সাংবাদিকতাকে ভবিষ্যতের পেশা হিসেবে মনস্থির করে, প্রথম যে মানুষটির সঙ্গে দেখা করি তিনি নাঈমুল ইসলাম খান। ১৯৯১'র কোনো একটি দিন যাই আজকের কাগজের ঝিগাতলার অফিসে। দেখে আসি লুঙ্গি পরে এক তরুণ সম্পাদক সম্পাদনা করছেন। মফস্বলীয় ভাবনার আমি কেনো, শহুরে ভাবনায় অনেকেই যে এই দৃশ্যে ভ্যাবাচ্যাকা খাবেন, তা হলফ করে বলতে পারি। আমিও খাই। হয়তো সেদিন তারও আমাকে দেখে তেমন কিছু করতে পারবো বলে মনে হয় নি। সুতরাং সাংবাদিকতার ক্যারিয়ার আর নাঈমুল ইসলাম খানের সঙ্গে শুরু করা হলো না। আমি কাজ করা শুরু করলাম চিত্রালিতে। তবে দিনকয়েকে বুঝলাম চিত্রালি আর যাই করে সাংবাদিকতা করে না। তাই ছাড়লাম। ফলে ছাত্রাবস্থার গোড়ার দিকে সাংবাদিকতা আর জমলো না।

এরপর ১৯৯৩ সাল। কোনো এক দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়েকটি রিকশা চেপে আমরা জনা কয় ছাত্র গেলাম ১৮৭ গ্রিন রোড। তৃতীয় তলার এক ফ্ল্যাটে ঢুকেই সেই লুঙ্গি পরা সম্পাদককে দেখলাম বসে আছেন। আমরা সবাই তার সঙ্গেই দেখা করতে গেছি। আজও তিনি লুঙ্গি পরা। ফিসফিস করে আমাদের সঙ্গে থাকা এক সিনিয়র আপাকে জানতে চাইলাম- উনি কি সবসময়ই লুঙ্গি পরেন? তিনি তার চমৎকার হি হি হাসি হেসে বললেন- নাঈম ভাই শোনেন, মেনন কি বলে! আপনি কি সবসময় লুঙ্গি পরেন? শুনে নাঈমভাই হাসেন। না, ওর সঙ্গে আমার এ নিয়ে দুইবার দেখা হয়েছে। আর দুইবারই বিকেলের দিকটায়। সাধারণত লাঞ্চের পরে যখন অফিসে আসি, বাইরে কোনো কাজ না থাকলে লুঙ্গি পরি। 

যা! লুঙ্গি কাহিনী লিখতে বসিনি। তা ছাড়া তখন আর লুঙ্গি আমার মাথায়ও ছিলো না- আমিতো মর্মে মর্মে বর্তে গেছি- নাঈম ভাই আমাকে মনে রেখেছেন। প্রায় দুই বছর আগে একবার দেখা হয়েছিলো। এই যে বর্তে গেলাম। এরপর নাঈম ভাইয়ের সঙ্গে আমি কাজ করি টানা পাঁচ বছর। বিসিডিজেসিতে। বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট, জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। কি না করেছি? কি না হয়েছে? এই পাঁচ বছরে। 

চেনা হলো অনেক কিছু। অনেক মানুষ। সাংবাদিকতা বিভাগের করিডোরে থাকলেই চেনা জানা যায় অনেক কিছু, সে কথা সবাই বলে। কিন্তু আমার চেনার-জানার-বোঝার গণ্ডি অনেক বেশি বিস্তৃত হলো বিসিডিজেসিতে কাজ করে। এখানে কাজ করার সুবাদে দেশের সব নামকরা সাংবাদিকদের চিনলাম। তাদের বাসায় যাতায়াতের সুযোগ হলো। নাঈম ভাই চাইতেন- কোনো প্রোগ্রামে কাউকে নিমন্ত্রণের চিঠিটি যেনো আমি নিয়ে যাই, কথা বলে আসি। এতে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও নিমন্ত্রিত ব্যক্তিটিকে সম্মান দেখানো হবে। তিনি নিশ্চিত হতে পারবেন। আর আমার জন্য তৈরি হবে বিখ্যাত মানুষগুলোকে ব্যক্তিগতভাবে চেনার সুযোগ। ফলে সেই দিনগুলোতেই ওবায়দুল হক, ওয়াহেদুল হক, সন্তোষ গুপ্ত, ফয়েজ আহমদ, গাজীউল হক, এবিএম মুসা ভাইদের চিনতে পারলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষকদের ক্যাম্পাসে দেখি তাদের বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ পেলাম। কেমন হয় একেকজন বিদ্বানের নিজস্ব ঘর-গন্ডি ইত্যাদি। এসব জীবন গঠনে ভূমিকা রেখেছে বৈকি।
 
সেখানে আরও পেলাম- দেশের প্রথম দিককার একজন হয়ে নিজস্ব কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ। ডস সিস্টেমে সেই কম্পিউটারের একটি আমার জন্য বরাদ্দ দিলেন নাঈম ভাই। এক কোনায় নিজের জন্য একটি টেবিল দিলেন। আর কি চাই! সেই সব দিনে কম্পিউটারে লেখার জন্য শিখলাম টাইপ রাইটিংয়ের ব্যাকরণ। শিখলাম চিঠি লেখা। বাংলা ও ইংরেজিতে। একদিন নাঈম ভাই ডেকে শিখিয়ে দিলেন, কিভাবে চিঠিটি ভাঁজ করে খামে ঢুকাতে হয়। যাতে যার কাছে চিঠিটি যাবে তিনি চিঠি খুলে যেনো প্রথম অংশ টুকুই দেখতে পান। 

শেখার এমন আরও হাজারো সুযোগ তৈরি হলো পাঁচ বছরে। সঙ্গে সুযোগ হলো গবেষণা করা। একাডেমিক কনটেন্ট প্রোডাকশন। প্রশিক্ষণ দেওয়া, পরিচালনা করা। সবচেয়ে বড় সুনাম হলো র‌্যাপোর্টিয়ার হিসেবে। নাঈম ভাই আমাকে রেফার করতে শুরু করলেন বাইরের প্রতিষ্ঠানেও। ইউসিস, বিশ্বব্যাংক এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মসূচিগুলোর র‌্যাপোর্টিয়ারের কাজ করে ভালো অংকের পারিশ্রমিক পাওয়া যেতো।

শিখলাম অনুবাদ। ইংরেজি কনটেন্টকে বাংলা করা, বাংলাকে ইংরেজি করা বিসিডিজেসি থেকে শিখলাম। অনুবাদ করেও আয় করতে পারতাম বড় অংকের টাকা। 

আরেক সুযোগ তৈরি হলো- দেশের সে সময়ের দ্বিতীয় সারিতে থাকা, এখন যারা প্রথম সারির, বড় বড় সাংবাদিকদের সঙ্গে কাজ করার। আরো পেলাম বিসিডিজেসিতে ফেলোশিপ নিয়ে আসা বিদেশি সাংবাদিক শিকাগো ট্রিবিউনের পল স্যালোপেকের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ। 

একবার নাঈম ভাই গেলেন আমেরিকা। ফিরে এসে সে যে কতো গল্প। মনে হলো আমেরিকাকে চেনা হয়ে গেছে। 

কোনো মিডিয়া হাউজে নাঈমুল ইসলাম খানের সঙ্গে কাজ করা হয়নি কখনোই। তবে বিসিডিজেসিতে কাজ করে আমি স্পষ্টতই বুঝেছি তার সঙ্গে কাজ করা মানে প্রতিনিয়ত শিক্ষা। নিজের জ্ঞান ও ধ্যান ধারনা তিনি গল্পে গল্পে অন্যের মধ্যে প্রোথিত করার চেষ্টা করেন। এতে উপকার হয়। তবে একটু সাবধানও থাকতে হয়, কারণ- নাঈম ভাইয়ের সব পথ অনুসরণ করা সম্ভব নয়। এই জন্য নয়, সে অনুকরণ ক্ষতিকর, বরং এই জন্য যে সে পথে হাঁটার কৌশল ও ধী-শক্তি সকলের নেই কিংবা থাকে না। 

বিসিডিজেসিতে নাঈম ভাই আমাকে বেতন দিতেন না। তিনি যখন আমার প্রয়োজন হতো টাকা দিতেন। অর্থাৎ যখনই প্রয়োজন হতো দিতেন। তিনি বলতেন- আমি টাকা চাইলে তার মনে হয়, তার ছোটোভাই টাকা চাইছে। ফলে যখন চেয়েছি তখনই পেয়েছি। এই তো সেদিন আমাকে ফোন করে বললেন, অপরাজেয় বাংলা কিভাবে চালাচ্ছো। বললাম ভাই ফাইন্যান্সার ছাড়াই একটি মিডিয়া তৈরি করতে চাই। তিনি সাধুবাদ জানালেন। বললেন, সাহস রাখো এগিয়ে যাও। কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলো। যেনো ছোট ভাইয়ের কোনো উদ্যোগ- বড় ভাই সকল অনুপ্রেরণা যুগিয়ে চলেছেন।

গত বছর জন্মদিনে লিখেছিলাম, কোনও কিছু স্ক্র্যাপ থেকে তৈরি করা... পরিচালনা করা ও সেরা করে তোলার সেরা কারিগর নাঈম ভাই... কোনও বিষয়ের গভীর থেকে... ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ও ফ্রেমের বাইরে থেকে ভাবনার দারুণ সব চর্চা তাকে করতে দেখেছি নব্বইয়ের দশকের দিনগুলোতে...কতটুকু শিখতে পেরেছি জানি না... তবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ক্লাশের বাইরে আমার সেরা শিক্ষক ছিলেন নাঈমুল ইসলাম খান। এই বিশ্বাস আমার অন্তকরণের। ভেবেছিলাম সুযোগ পেলে আরও বিস্তারিত লিখবো। শুভ জন্মদিন নাঈম ভাই।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank