প্রিয় দেশবাসী, মেয়েটি মরে গেছে!
প্রিয় দেশবাসী, মেয়েটি মরে গেছে!
‘‘মিটিং করতে গিয়ে, গ্রুপ স্টাডি করতে গিয়ে, আড্ডা দিতে গিয়ে, কাজে কিংবা অকাজে গিয়ে, প্রেম করতে গিয়ে এমনকি সেক্স করতে গিয়ে হলেও যদি কেউ ধর্ষিত হয় তবে ধর্ষণের জন্য একমাত্র ধর্ষকই দায়ী #StopVictimBlaming.’’ কথাগুলো কাল থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখছি। এই বার্তা মানুষের মনের মাঝে গেঁথে গেলে ভালো হতো। আরও ভালো হতো মানুষ এই বার্তাকে তার বিশ্বাসের অংশ হিসেবে ভেবে ব্যবহারিক জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে নিলে। কিন্তু সেটা হয়নি, সমাজে সে বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত হয়নি, এবং সেটা বিশ্বাসের অংশ হয়ে যাবে এমনটাও এই মুহূর্তে ভাবা যাচ্ছে না।
ধর্ষণের পর হত্যার আরও এক ঘটনা ঘটেছে। রাজধানীর ধানমন্ডির একটি ইংলিশ মিডিয়ামের এক শিক্ষার্থীকে তার বন্ধু(রা) ধর্ষণ করেছে। ধর্ষণের কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মেয়েটির মৃত্যু হয়েছে। ময়নাতদন্তে রিপোর্টে জানা যাচ্ছে, মেয়েটির ওপর বিকৃত যৌনাচারে প্রবৃত্ত হয়েছিল ধর্ষক চক্র। ধর্ষণ এমনিতেই বিকৃত মানসিকতা ও বিকৃত রুচির পরিচায়ক, তার ওপর মেয়েটির ওপর যেভাবে হামলে পড়েছিল তারা তাতে মেয়েটির অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়। মেয়েটিকে হাসপাতালে নেওয়ার পর সেখানে তার মৃত্যু হয়।
মেয়েটির মৃত্যুর পর ‘অনলাইন ট্রায়াল’ যথারীতি হয়েছে। বরাবরের মত সেখানেও দায় চাপানো হয়েছে ভিক্টিমের ওপর। এই অনলাইন ট্রায়ালের একপাক্ষিক রায়দাতারা প্রতি ঘটনার মত মেয়েটিকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। এবার অবশ্য মেয়েটির পোশাক নিয়ে কথা এবার ওঠেনি, কথা ওঠেছে সে গ্রুপ স্টাডিতে কেন যাবে এমন! ছেলেবন্ধুর বাসা ফাঁকা এটা জেনেই গেছে এমনও কথা ওঠেছে। ভিক্টিমকে ব্লেইম দেওয়ার মত এইধরনের কথাগুলো সমাজে নজিরবিহীন নয়, বলা যায় ধারাবাহিকতা। প্রতি ঘটনার পর যথারীতি নারীর ওপর দোষ চাপিয়ে দেওয়ার অনগ্রসর চিন্তা এখানেও কাজ করেছে। এই চিন্তায় আচ্ছন্ন সমাজের যে শ্রেণির লোকজন তারা কোনো না কোনো অজুহাত বের করবেই, এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। অথচ আগের অনেক ঘটনার মত এবারও মেয়েটি মরে গেছে। হ্যাঁ, মেয়েটি সত্যি-সত্যি মরে গেছে!
কতই ছিল বা বয়স? এই ষোলো/সতেরো! কিশোরী। ইংরেজি মাধ্যমের ‘ও’ লেবেলের শিক্ষার্থী। পৃথিবীটা বুঝতে শেখার আগেই তাকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। শারীরিক ভাষা শেখার আগেই শারীরিক নির্যাতনে মৃত্যু হয়েছে তার। যে বা যারা তাকে খুন করেছে তারাও কিশোর। তারাও শারীরিক ভাষা-আচরণ শেখার আগেই বিকৃত শারীরিক আচরণ শিখে গেছে। বিকৃত মানসিকতা, নৈতিক শিক্ষার অভাবের কারণে পাশবিকতা ভর করেছিল তাদের ওপর। ফলে একটা মেয়ের অকাল মৃত্যু হয়েছে।
মেয়েটির এই মৃত্যু নাড়া দিতে পারেনি অনেককেই। তারা অনাকাঙ্ক্ষিত চিন্তায় আবিষ্ট, অপরাধীর অপরাধ দেখার চাইতে অপরাধের শিকার মেয়েটিকে অপরাধী হিসেবে দেখতে বরং আগ্রহী। এই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা কথিত পুরুষের দোষ খুঁজে পায় না। এখানে পৌরুষের প্রকাশ দেখতে চাওয়ার মানসিক এই বিবৃতি তাদের পশ্চাৎপদ দৃষ্টিভঙ্গির আরও এক নজির। শঙ্কার কথা এই দৃষ্টিভঙ্গিভুক্ত মানুষের সংখ্যা অগণন, সমাজেও তাদের অবাধ বিচরণ। তাদের অনেকেই আবার নেতৃত্বস্থানীয় স্ব স্ব ক্ষেত্রে, অধিকাংশই আবার সাধারণের কাতারে থেকেও নিজেদের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে অসাধারণ ভাবতেও পছন্দ করে। ফলে এই মানসিক বিকৃতি দিন দিন বাড়ছে; বাড়বাড়ন্ত এই বিকৃত রুচির মানুষেরা প্রতি ঘটনা শেষে তাদের কথিত অনলাইন ট্রায়ালের মাধ্যমে বিকৃত মানসিকতার প্রচার চালিয়ে থাকে। এতে করে নারী সমাজ, ভিক্টিমের পরিবার(গুলো) ফের নানাবিধ বিপত্তির মুখে পড়ে।
ধর্ষণের ঘটনাগুলো শেষে আমাদের সমাজের অনেকেই অপরাধের শিকার মেয়েটির পরিচয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অপরাধের শিকার মেয়েটিকে ‘ধর্ষিতা’ আখ্যায় সামাজিকভাবে আরও একবার হেনস্তা করে। ধর্ষককে ধর্ষক বলতে এখানে যেন সমূহ আপত্তি তাদের! অথচ এখানে অপরাধের শিকার নারীর পাশে দাঁড়ানো উচিত ছিল সমাজের। ‘মেয়েটি ধর্ষিতা’ না বলে বলা দরকার ‘ছেলেটি/ছেলেগুলো ধর্ষক’; ‘আপনার মেয়েকে সামলান’ এমন অভিযোগ না করে ‘আপনার ছেলেকে সুশিক্ষা দিন’ এমন বার্তা পৌছানো দরকার। পোশাক নিয়ে মাতামাতি না করে ধর্ষকদের মানসিকতা নিয়ে প্রশ্ন করাই উচিত ছিল আমাদের সকলের। কিন্তু সেটা প্রায়োগিকভাবে দৃশ্যমান নয়। এখানে দৃষ্টিভঙ্গিগত যে পার্থক্য দৃশ্যমান সেটা কমিয়ে আনতে না পারলে সমাজে অপরাধীর জন্ম ও বিস্তারলাভ ঠেকানো অসম্ভব।
ধর্ষণ অসামাজিক কর্মকাণ্ড, ধর্ষণ অমানবিক, সম্মতি ব্যতিরেকে এইধরনের যেকোনো আচরণ ধর্ষণ- এমন বিশ্বাস, এমন বার্তা সমাজের সকল স্তরে পৌঁছাতে হবে। শারীরবৃত্তিক ব্যাপারগুলোকে নিষিদ্ধ ব্যাপার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে থাকলে কথিত নিষিদ্ধের প্রতি মানুষের সহজাত আগ্রহ বাড়তেই থাকবে। মানুষের জীবন, বংশবৃদ্ধি প্রক্রিয়ায় যেখানে শারীরবৃত্তি অনুঘটক হিসেবে কাজ করে সেখানে নৈতিক শিক্ষা সহযোগে শারীরবৃত্তি শিক্ষার যোগ করতে হবে। এটা করতে না পারার কারণে কিশোর অপরাধী বৃদ্ধি পাচ্ছে। নারীরা অপরাধের শিকার হচ্ছে, প্রাণও হারাচ্ছে। একইসঙ্গে ভিক্টিম ব্লেইমিং প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানে আমাদের মনে রাখা জরুরি যে ভিক্টিমকে ব্লেইম দিয়ে দিয়ে আমরা এই সমাজকে অপরাধীদের অভয়ারণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চলেছি; ভিক্টিম ব্লেইম দিয়ে দিয়ে আমরা ধর্ষণ প্রবণতা বাড়িয়ে চলেছি; ভিক্টিমকে ব্লেইম দিয়ে দিয়ে ধর্ষণ যে অপরাধ, ধর্ষণ যে আইনবিরুদ্ধ কাজ, ধর্ষণ যে পাশবিক আচরণ, ধর্ষণ যে অনৈতিক সেই বার্তাকে আমরা দুর্বল করেই চলেছি। এতে করে আমরা ধর্ষকদের পরোক্ষ সহযোগী হয়ে ওঠছি। ক্রমবর্ধমান ধর্ষণপ্রবণতার দায় তাই এই ভিক্টিম ব্লেইমদাতাদের ওপরও এসে যে পড়ছে সে কি আমরা খেয়াল করছি?
অদ্য যারা নানাভাবে মেয়েটিকে দোষারোপ করছেন তাদের প্রতি বিনীত আবেদন দয়া করে ভিক্টিম ব্লেইমিং বন্ধ করুন। কারণ আপনাদের এই আচরণগুলো ভিক্টিমের শোকাহত পরিবারের শোক আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। একই সঙ্গে আরও অনেক অপরাধী জন্মের পথ দেখিয়ে দিচ্ছে।
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
- ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১: জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ’
- সুনীল অর্থনীতি ও রূপকল্প-২০৪১
- শিক্ষার ধরন ও বেকারত্ব: দেশে অশিক্ষিতদের চেয়ে শিক্ষিত বেকার ৩ গুন
- ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়
- ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস-১৯৬১ ও দ্বিপক্ষিয় কূটনীতিক সম্পর্ক
- মিডিয়ার শক্তি বা আসক্তি: ম্যাজিক বুলেটের বাকের ভাই ও বদি
- গণমাধ্যমে গণরুচির বিকার
- হালকা বিনোদনের প্রাধান্যে সংস্কৃতির অবনতি
- বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণার দিন শেষ, চার উপায়ে মধ্য আয়ের দেশ