সৌরভের মাইল্ড অ্যাটাক, মুখ কি ঢেকে গেলো বিজ্ঞাপনে?
সৌরভের মাইল্ড অ্যাটাক, মুখ কি ঢেকে গেলো বিজ্ঞাপনে?
কবি শঙ্খ ঘোষ কি আক্ষরিক অর্থেই শঙ্খ বাজিয়ে গগনবিদারী সুর হেঁকেছিলেন ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’ কবিতায়? পুঁজির প্রবল প্রতাপের যুগে শঙ্খের সেই অমোঘ উচ্চারণটি মনে পড়ে- ‘একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি/ তোমার জন্য গলির কোণে/ ভাবি আমার মুখ দেখাব/ মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’।
একলা-নিরালা অপেক্ষার পালা ফুরায় না আমাদের, প্রিয় মুখগুলো ঢেকে যায় কোন না কোন রঙ-বাহারি বিজ্ঞাপনে! সৌরভ গাঙ্গুলি মৃদু হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পর গণমাধ্যম থেকে একটি বিজ্ঞাপন প্রত্যাহারের ঘটনা নিয়ে কবিতাটি মাথা থেকে নামছে না।
ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিআই) সভাপতি সৌরভ গাঙ্গুলি। সৌরভ এক বছর আগে ভারতীয় ফরচুন রাইস ব্র্যান অয়েলের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হন। সেই কোম্পানির হয়ে তিনি একটি টিভিসি (বিজ্ঞাপন) করেন। বিজ্ঞাপনে সৌরভ বলেছিলেন- ‘হৃদপিণ্ড স্বাস্থ্যকর রাখবে এই ভোজ্য তেল’। দুপয়সা আয় হচ্ছিলো, ভক্তরাও গিলছিলো; যাকে বলে তেল-চপচপে ভালোই চলছিলো বিজ্ঞাপনটি। ‘দেখতে ফিট, দাদা ঠিক’ সৌরভও বেশ আয় করছিলেন সেই বিজ্ঞাপন থেকে। সেভাবে ভালোই চলছিলো। কিন্তু সম্প্রতি সেই সৌরভই হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পরই বাঁধে বিপত্তি।
অন্তর্জালজুড়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় সেই বিজ্ঞাপনের সূত্র ধরে। সৌরভের ‘হৃদয়’ যখন প্রকাশ হল মৃদু ব্যাথায় তখন ফেসবুক, টুইটারে বিজ্ঞাপনটির কারণে ট্রোলের শিকার হতে হলো সৌরভকে! এতটুকু পড়েই প্রশ্ন জাগবে- সৌরভকে নিয়ে যখন সমালোচনা তখন কি ভূমিকা নেয় বিজ্ঞাপনের ভোজ্যতেলের কোম্পানিটি?
‘শ্যাম রাখি না কূল রাখি’ অবস্থা তখন বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানের। অন্তর্জালজুড়ে ট্রোল, হাসি, তামাশা দেখে হতভম্ব তারা। কোম্পানিটির সাথে ভারতীয় শাসক দল বিজেপির সংস্পর্শও খুঁজে পায় নেটিজেনরা। সব মিলিয়ে লেজেগোবরে দশায় ফরচুন তেলের সব বিজ্ঞাপন স্থগিত করে দিল আদানি উইলমার। ৫ জানুয়ারি ভারতীয় অনলাইন পোর্টাল ইকনমিকটাইম.ইন্ডিয়াটাইমস.কম এ সংক্রান্ত একটি ইংরেজি খবর পরিবেশন করে। খবরটির শিরোনাম ‘Adani Wilmar halts all Fortune ads featuring Sourav Ganguly’। যে খবরে বলা হয়েছে- ‘Adani Wilmar has halted all advertisements of its Fortune Rice Bran cooking oil featuring Sourav Ganguly who suffered a heart attack on Saturday even as social media users ridiculed the campaign that promoted heart health’।
কেন প্রত্যাহার করতে হলো বিজ্ঞাপনটি? হলো, কারণ- সৌরভ বিজ্ঞাপনে বলেছিলেন, হৃদপিণ্ড স্বাস্থ্যকর রাখবে এই ভোজ্যতেল। কিন্তু কে জানতো আচমকা মুদৃ হৃদরোগ আক্রান্ত করবে ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে প্রভাব জাগানিয়া অধিনায়ক প্রিন্স অব ক্যালকাটাকে? ‘গড অব অফসাইড’ খ্যাত এই সাবেক ওপেনারের ‘হৃদয়’ কি এখন ওপেন সার্জারি হবে? নাকি স্ট্যান্ট পরালেই চলবে? এমন আলোচনা বা আশঙ্কায় মাঝেই আলোচনায় এলো আদানি গ্রুপের তেলের বিজ্ঞাপনটি। যাকে বলে ঘোরতর আলোচনা। কারণ, আগামী আইপিএলে নতুন ফ্র্যাঞ্জাইজি কিনতে চান এই গ্রুপ। শুধু কি তাই? না। ভারতীয় গণমাধ্যমে পরিবেশিত কয়েকটি খবর বলছে- দুর্ঘটনাচক্রে ভোজ্যতেল কোম্পানিটি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপি’র ঘনিষ্ঠ শিল্পগোষ্ঠী!
সৌরভের বয়স ৪৮। এই বয়সেও কিভাবে এতটা ‘ফিট' রেখেছেন, তার দাদাগিরি জানতে উৎসুক ভক্তরা। সেই উৎসুক্য মানসিকতায় নির্মিত হয়েছে এই বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপন দোষের কিছু নয়। বিজ্ঞাপন মানে বিশেষভাবে জ্ঞাপন। সৌরভের মতো ব্যক্তিত্ব যখন রায় দেন যে, এই বিশেষ ভোজ্যতেলটি স্বাস্থ্যকর, বিশেষ করে হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য জরুরি, সেটি নিশ্চয় ভক্তদের প্রলুব্ধ করবে। সেটিই হওয়ার কথা বিজ্ঞাপনের নিয়ম মেনে। তাই হিতে বিপরীত হতে গিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঠেকাতে উল্টো রাতারাতি বিজ্ঞাপনটি সরিয়ে ফেলতে সময় নেয়নি কোম্পানি। কারণ, বিজ্ঞাপন মানেই গ্রাহকদের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন। ফলে সৌরভ সুস্থ না হওয়া অবধি ফরচুন কিভাবে গ্রাহকদের ফরচুনকে পাশে পাবে সেটিই এখন আলোচনার বিষয়।
ভারত এখন নিশ্চিতভাবেই বিশ্ব ক্রিকেটের প্রভু। একটি ঘরোয়া টুর্নামেন্টকে কিভাবে বৈশ্বিক পুঁজিতে পরিণত করতে হয়, জাতীয়তাবাদের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বায়নের রূপ দেয়া যায় তা রংঢংয়ের বাহারি আয়োজন আইপিএল দেখলেই বোঝা যায়৷ আমরা বর্তমান সমাজকে করোনা পূর্ববর্তী ও করোনা পরবর্তী এই দুটি বিভাজনে ব্যাখ্যা করবো। এর আগেও গত শতাব্দীর তিরিশের দশককে মন্দার যুগ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর সময়কে স্নায়ুযুদ্ধের সময়, সত্তরের দশককে মহাকাশ যুগ বা স্পেস এজ হিসেবে ভেবেছি আমরা। ঠিক একই কায়দায় ক্রিকেটের উন্মাদনার সাথে পুঁজির মেলবন্ধন আমাদেরকে ক্রিকেট বিশ্বের নতুন একটি বিভাজনরেখা স্পষ্ট করে দিয়েছে। ক্রিকেট এখন ‘আইপিএল-পূর্ব ও আইপিএল পরবর্তী’ বিভাজন রেখায় অবস্থান করছে। শ্বেতশুভ্র ভিক্টোরিয়ান যে রাজকীয় খেলাটির প্রচলন হয়েছিলো তার গভীর প্রতীক আম্প্যায়ার হলেন মাঠের লর্ড, তাঁর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। সেই আম্প্যায়ার সিস্টেমেও পরিবর্তন এসেছে সময়ের সাথে সাথে। এমনকি ক্রিকেট আর দিনে-রাতের নির্ভোজাল উত্তেজনার ম্যাচ নেই, ক্রিকেট এখন আর নিছক ইংল্যান্ডের বৈকালিক বিনোদনের টি-টোয়েন্টি নয়; পুঁজিবাদ ক্রিকেটকে আমূল বদলে দিয়েছে। সেই বদলে দেওয়ার কৃতিত্ব সিংহভাগই বিজ্ঞাপনের। পুঁজির সাথে যখন থাকে উন্মাদনা তখন ক্রিকেট হয়ে উঠে অপ্রতিরোধ্য, অব্যর্থ। যেমন ধরা যাক ২০০৫ সালের একটি উদাহরণ। যে বছর সৌরভের ক্যারিয়ারের খারাপ সময়, ভারতীয় নতুন কোচ গ্রেগ চ্যাপেলের অমিলের কারণে ছিটকে পড়ে দল থেকে। প্রিন্স অব ক্যালকাটাকে কাটাকুটি করে বাদ দেয়ার এই ঘটনার প্রতিশোধ নিয়েছিলো পশ্চিমবঙ্গবাসী অভিনব কায়দায়। সেবছর কলকাতার পূজা মণ্ডপে দেখা যায় দুর্গা ত্রিশুল হাতে অসুর বিনাশ করছেন কিন্তু অসুরের মুখের গড়ন ছিলো গ্র্যাগ চ্যাপেলের!
এভাবেই আমাদের হিরোরা আমাদের প্রতীক হয়ে উঠেন। আবার কখনো কখনো আমাদের হিরোরা জিরোতে পরিণত হন। সঞ্চরণশীল পুঁজি গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে কাউকে ‘হিরো’ ইমেজ দেয়, পুঁজি তার নিজের স্বার্থ রক্ষা করেতে তাঁকেই আবার ‘জিরো’ বানিয়ে ছুঁড়ে ফেলতে দ্বিধা করে না। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাই পলিটিক্যাল সাট্যায়ারও ভাইরাল হয়েছে যে, ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)এর মতো উগ্র সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদী দলের সংস্পর্শে থাকা একজন উদার ‘হৃদয়’বান বাঙালির জন্য কতটুকু ভালো? সৌরভ এখন ‘হৃদয়’ নিয়ে হাসপাতালে লড়ছে। ফরচুন তেল কোম্পানির দিকে তাকিয়ে শঙ্খ ঘোষের কবিতা ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’র শেষ স্তবকটির স্মরণ করা যায়- ‘মুখের কথা (বিজ্ঞাপনের কথা) একলা হয়ে/ রইল পড়ে গলির কোণে/ ক্লান্ত আমার (সৌরভ গাঙ্গুলি) মুখোশ শুধু/ ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে’।
লেখক: রাজীব নন্দী
সহকারী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশ ভারতের গণমাধ্যম গবেষকদের প্ল্যাটফর্ম ‘ইন্দো-বাংলা মিডিয়া এডুকেটর্স নেটওয়ার্কের সমন্বয়ক’ ইমেইল: [email protected]
আরও পড়ুন
জনপ্রিয়
- সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
- ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১: জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ’
- সুনীল অর্থনীতি ও রূপকল্প-২০৪১
- শিক্ষার ধরন ও বেকারত্ব: দেশে অশিক্ষিতদের চেয়ে শিক্ষিত বেকার ৩ গুন
- ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়
- ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশনস-১৯৬১ ও দ্বিপক্ষিয় কূটনীতিক সম্পর্ক
- মিডিয়ার শক্তি বা আসক্তি: ম্যাজিক বুলেটের বাকের ভাই ও বদি
- গণমাধ্যমে গণরুচির বিকার
- হালকা বিনোদনের প্রাধান্যে সংস্কৃতির অবনতি
- বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণার দিন শেষ, চার উপায়ে মধ্য আয়ের দেশ