শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪ || ৯ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ || ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

‘জিন্দাবাদ’ নয়, ‘জয় বাংলা’!

কবির য়াহমদ, সাংবাদিক ও লেখক

১০:৪৮, ১৬ ডিসেম্বর ২০২০

আপডেট: ১৩:০৬, ১৭ ডিসেম্বর ২০২০

১৩২০

‘জিন্দাবাদ’ নয়, ‘জয় বাংলা’!

একাত্তরের গণযুদ্ধের গণস্লোগান ছিল ‘জয় বাংলা’। এই স্লোগানে বাঙালি মুক্তির সংগ্রামে নেমেছে, মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, আবার এই স্লোগানে ভর করে বিজয় অর্জন করেছে। ২৬ মার্চ একাত্তর থেকে ১৬ ডিসেম্বর একাত্তর দীর্ঘ এই সময়ে মুক্তিকামী বাঙালি যে শব্দবন্ধে আত্মপরিচয় খুঁজেছিল, প্রাণের মায়া ত্যাগ করে মা-মাতৃভূমি দখলদার পাকিস্তানিদের কবল থেকে মুক্ত করতে নেমেছিল সেটা ছিল এই ‘জয় বাংলা’। এ স্লোগানের বিশেষত্ব, এ স্লোগানের মাধুর্য তাই ব্যাখ্যাতীত; কেবল তারাই ধারণ করে যাদের শোণিতে এখনও বহমান একাত্তর, তারাই ধারণ করে যারা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশকে সেই চারনীতির আলোকে দেখতে উদগ্রীব।

আমার দেখা হয়নি একাত্তর। আমার বাবার দেখা হয়েছিল। সোনালী যৌবন তাই বিলিয়ে দিয়েছিলেন দেশের তরে। এলাকার যুবকদের সংগঠিত করে পাড়ি দিয়েছিলেন ভারতে। সেখানে প্রশিক্ষণ শেষে ফিরে আসা তাঁর। প্রাণের মায়া আর পরিবার ফেলে রেখে তাঁর সেই যৌবন বিসর্জনের যে ইতিহাস সেটা একটা দেশকে স্বাধীন করার অদম্য অভিপ্রায়ে। আমার বাবা সফল হয়েছিলেন। সাত কোটি বাঙালির অধিকাংশের মত স্বাধীনতাকামী বাবার স্বপ্নের বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছে। তাঁর দীর্ঘজীবন এই ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। আমরা গর্ব অনুভব করি তাঁকে নিয়ে, তিনি নিজেও গর্বিত ছিলেন এই বাংলাদেশের জন্মপ্রক্রিয়ার একটা অংশ হতে পেরে। আমার বাবার মত এমন লক্ষ-লক্ষ লোক ছিলেন যাঁরা প্রাণের মায়া ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তাঁদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞ আমরা।

প্রতি বিজয়ের দিনে আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার বাবাকে ‘ধন্যবাদ’ জানাতাম। গতবারের মত এবার আর সেই সুযোগ আমার নাই, কারণ তিনি তাঁর জন্ম দেওয়া বাংলাদেশে নেই, পৃথিবীতেও নেই। গত বছরের জুনে তিনি পৃথিবী ছেড়েছেন। সরাসরি তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে না পারলেও এখনও ধন্যবাদ জানাই একটা স্বাধীন দেশের মালিকানা আমাদের দিয়ে যেতে পেরেছেন বলে। প্রতিবার বিজয়ের দিনে উচ্চারণ করি- ধন্যবাদ ৩০ লক্ষ শহীদ; ধন্যবাদ দুই লক্ষ মা-বোন; ধন্যবাদ একাত্তরের রণাঙ্গনের সকল প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ যোদ্ধা; ধন্যবাদ বাংলাদেশি শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া ভারত; ধন্যবাদ মুক্তিসংগ্রাম থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত নিয়ে আসা সকল বাংলাদেশপ্রেমিক; ধন্যবাদ আমার বাবা আজিজ উদ্দিন চৌধুরী; ধন্যবাদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান; ধন্যবাদ বাংলাদেশ, ধন্যবাদ; তোমাদের কারণে আমি স্বাধীন দেশে বুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে বিজয়ী বেশে বলতে পারি- জয় বাংলা!

এই বাংলাদেশ, এই ‘জয় বাংলা’ আমাদের গর্বের উপলক্ষ। এই স্লোগান এখন আমাদের জাতীয় স্লোগান। গতবছর হাই কোর্ট ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। আদালত এক রিটের নিষ্পত্তি করতে দেওয়া রায়ে বলেছিলেন, প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা এবং সাংবিধানিক পদে যারা আছেন, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে তারা যখন বক্তব্য দেবেন, তখন বক্তব্যের শেষে তাদের ‘জয় বাংলা’ বলতে হবে। স্কুলগুলোতে প্রাত্যহিক সমাবেশ শেষেও ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে হবে। যদিও আদালতের এই স্লোগান নির্ধারণের পরও এই স্লোগানটির ব্যবহার জোরালোভাবে পরিলক্ষিত হয়নি।

‘জয় বাংলা’ স্লোগান একাত্তরে ছিল জাতীয় স্লোগান। এরপর সেটা ক্রমে আওয়ামী লীগের দলীয় স্লোগানে রূপ লাভ করেছিল। এখানে আওয়ামী লীগের দায় আছে কিছুটা, যদিও সবচেয়ে বেশি দায় ছিল পাকিস্তানদরদি মানসিকতার সরকারগুলোর, যারা একটা সময়ে মুক্তিযুদ্ধ আর ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে দেশে প্রায় নিষিদ্ধ করার অবস্থায় ঠেলে দিয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের ওই স্লোগান দলীয় গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। সে সময় থেকে দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ ওই স্লোগানকে লালন করেছে, আর লালনের ধারাবাহিকতায় একটা সময়ে মুক্তিযুদ্ধের সর্বজনীন স্লোগান দলীয় স্লোগানে রূপান্তর ঘটেছে।

আওয়ামী লীগের দলীয় দখল থেকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে ফের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের মানুষের কাছে পাঠানোর বড় এক বার্তা পাওয়া যায় ২০১৩ সালের গণজাগরণ আন্দোলনে। যুদ্ধাপরাধী আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন রায়ের পরিবর্তে ফাঁসির দাবিকে কেন্দ্র করে তারুণ্যের স্ফুলিঙ্গ এই আন্দোলনের সময়ে ‘জয় বাংলা’ মানুষের কাছে পৌঁছায়। তখন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান আওয়ামী লীগের দখলমুক্ত হয়েছে বলে মনে করা হয়েছিল। গণজাগরণ আন্দোলনের সমাপ্তির পর গণমানুষের স্লোগান ফের হাতছাড়া হয় মানুষের, ফিরে যায় ফের এককভাবে আওয়ামী লীগের দখলে। এছাড়াও এই আন্দোলনকে বানচাল করতে ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী যখন হেফাজতে ইসলামের মোড়কে রাস্তায় নেমে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে নানা অপবাদ ও বিরুদ্ধাচরণ শুরু করে তখন সরকারও এই আন্দোলনকে সহ্য করতে পারেনি। ফলে বাঙালির অন্যতম এই জাগরণের জাগরণী স্লোগান একাত্তরের মত এবার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করতে গিয়েও চূড়ান্তভাবে সফল হয়নি।

‘জয় বাংলা’ স্লোগানের দলীয় এই দখলি স্বত্বের কারণে যে শ্রেণির মানুষ এখনও এই স্লোগানকে গ্রহণ করতে পারেননি তারা ভাবতে পারেন তাদের ছেড়ে দেওয়ার কারণেই মূলত এই স্লোগানের একক মালিকানা মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগের। অথচ এই স্লোগান কেবল আওয়ামী লীগের নয়, এই স্লোগান একাত্তরকে ধারণ করা সকল নাগরিকের। এখানে দলীয় মালিকানার চাইতে স্লোগানের শক্তির দিক বিবেচনা করলে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে গ্রহণ না করার কোন যুক্তি থাকতে পারে না। একবার ভেবে দেখুন যে একাত্তরের জন্মযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত যে দেশের মালিকানা নাগরিকের সে দেশে সেই একাত্তরের গণযুদ্ধের গণস্লোগানকে ধারণ ও লালন করাই সঙ্গত। এখানে সংকীর্ণতার সুযোগ নেই, কারণ এ সংকীর্ণতায় আপনি-আমি হারাতে পারি একাত্তরের গগনবিদারী স্লোগান ও চেতনাকেই।  

মনেপ্রাণে হয়ত আপনি বাংলাদেশকে ধারণ করেন, হয়ত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গর্ব করেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন, ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণে অনুভব করতে চান একাত্তরকে; কিন্তু তবু ‘জয় বাংলা’ দূরের স্বজন হয়ে যায় দলীয় লেবাসের ভয়ে। এই ভয় আততায়ীর, আত্মপরিচয়ের উন্মোচনের স্বার্থে ওই ভয়কে ঠেলে দিন দূরে! একাত্তরে এই ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের কম্পনে কেঁপেছিল দেশ, আত্মসমর্পণের লজ্জায় নত হয়েছিল পাকিস্তান, সেই পাকিস্তানের ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’-এর আদলে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ আদতে আমাদের ‘ফেলে দেওয়া থুথু ফের মুখে নেওয়ার চেষ্টা’। পাকিস্তানের স্লোগানের অনুকরণে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ স্লোগান তাই আত্মপ্রবঞ্চনা।

একাত্তর দেখা হয়নি, তবে টের পাই ‘জয় বাংলা’র শক্তি। এইতো বছর ছয়েক আগেও যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাইতে গিয়ে আমরা ফিরে পেয়েছিলাম একাত্তরের শক্তি, টের পেয়েছিলাম ‘জয় বাংলা’র শক্তি। বুঝতে পারি এই ‘জয় বাংলা’ আমাদের; একান্তই আমাদের। ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বাংলাদেশে খতম হয়েছে একাত্তরে। প্রতিস্থাপন হয়েছে ‘জয় বাংলা’র। এই ৪৯ বছর পরেও খতম হয়ে যাওয়া শব্দ দুইয়ের একটাকে কেন আঁকড়ে ধরে রাখবেন? বাংলাদেশে পাকিস্তানকে যেমন ‘গুডবাই’ বলা হয়েছে, তেমনিভাবে জিন্দাবাদকেও।

এখানে স্লোগান বিষয়ক কোন রাজনৈতিক সমীকরণকে প্রশ্রয় দিচ্ছি না। সিদ্ধান্ত সাফ-সাফ; পাকিস্তানের সঙ্গে খতম জিন্দাবাদও। জিন্দাবাদ স্লোগানের সঙ্গে পাকিস্তান চলে আসে; আর এ দুই শব্দের কোন একটাকে ধরে রাখলে মনে হয় অপরটা উহ্য, ভেতরে ভেতরে উচ্চারিত; একটার মৌখিক উচ্চারণে অন্যটার উচ্চারণ অন্তর্গত। লোকলজ্জায় অস্বীকার- এ যে আত্মপ্রতারণা! পাকিস্তান যেমন আমাদের ছিল না, জিন্দাবাদও আমাদের নয়। তাই ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’-এর সুর ধরে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ নয়; আমাদের স্লোগান ‘জয় বাংলা’। হ্যাঁ, ‘জয় বাংলা’ আমাদের স্লোগান; বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান!
 

কবির য়াহমদ: সাংবাদিক ও লেখক।

Kabir Steel Re-Rolling Mills (KSRM)
Rocket New Cash Out
Rocket New Cash Out
bKash
Community Bank